প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গঃ পর্ব ২৪ || শিক্ষক কি বাস ড্রাইভারের মত নাকি ট্রেন ড্রাইভারের মত || Teaching Style [10% @shy-fox]
ভূমিকাঃ
মাঝে মাঝে আমাদের চারপাশের জীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ, সৌন্দর্য্য ও নানাবিধ বিষয় নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হয় যেসব লিখার বিষয়বস্তুকে কোন নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ্যে ফেলা যায় না। এরকম বিষয়বস্তুগুলোকে নিয়ে আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটি
-তে আমি একটি সিরিজ লিখছি যার নাম দিয়েছি প্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ
যেখানে কোন বিষয় বা প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যাক্তিগত মতামত ও পর্যালোচনা করে থাকি। এই লিখার বিষয়গুলো হচ্ছে ব্যাক্তিগত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সমন্বয়। পড়ে দেখুন, আশা করি ভাল লাগবে।
পর্ব ২৪ : একজন শিক্ষকের দায়িত্ব ট্রেন ড্রাইভার এর মত নাকি বাস ড্রাইভারের মত
অনেক সময় আমরা এ কথা বলে থাকি যে, শিক্ষক মানে হচ্ছে ড্রাইভার অর্থাৎ পথপ্রদর্শক। ছাত্রদেরকে, সমাজকে কিংবা একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষকরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান এবং পথ প্রদর্শন করে থাকেন। তার মানে হচ্ছে একজন ড্রাইভার। কিন্তু ড্রাইভিং এর বিভিন্ন ধরন রয়েছে যেমন বিমান চালনা, ট্রাক চালনা, ট্রেন বা বাস চালনা ইত্যাদি। তাহলে শিক্ষকরা কোন ধরনের ড্রাইভার। আসুন ব্যাপারটা একটু বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
আমরা যদি ট্রেন ড্রাইভার এবং বাস ড্রাইভার এর কার্যক্রম এর পার্থক্য দেখি তাহলে এই ব্যাপারটি আমাদের মাঝে স্পষ্ট হয়ে যাবে। একজন বাস ড্রাইভারকে সম্পূর্ণ বাসের পুরো নিয়ন্ত্রণ সবসময় মাথায় নিয়ে সামনের দিকে আগাতে হয়। অর্থাৎ বাস কখনো ডানে, কখনো বামে, কখনো জোরে, কখনো আস্তে ইত্যাদি বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সামনে আগাতে হয় তাই ড্রাইভারকে প্রত্যেকটি মুহূর্তে তার বাসকে নিয়ন্ত্রন করতে হয়। অর্থাৎ পথ প্রদর্শন করতে হয়।
অন্যদিকে একজন ট্রেন ড্রাইভার এর মূল কাজ হচ্ছে, ট্রেনকে শুরু করে দেওয়া। ট্রেনের ট্র্যাক আগে থেকে নির্ধারণ করা আছে আর সেই ট্র্যাক মোতাবেক ট্রেন সামনের দিকে আগাতে থাকবে। এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক বিষয়। এখানে বারবার কিছুক্ষণ পরপর বিপথে যাওয়া ট্রেনকে ট্র্যাকে নিয়ে আসা কিংবা ব্রেক করা বা গতি বাড়ানো এই বিষয়গুলো খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না।
Source: Image by Peggy und Marco Lachmann-Anke from Pixabay
তাহলে এই দুইটি পার্থক্য থেকে আমরা সহজেই এ ব্যাপারটি বলে দিতে পারে যে, একজন শিক্ষক মানে হচ্ছে একটি ছাত্র বা সমাজের জন্য একজন ট্রেন ড্রাইভার। অর্থাৎ শিক্ষক ছাত্রদের-কে রেললাইনে তুলে দিবেন আর তারা অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। এখানে কোন ছাত্র সঠিক লাইনটা হয়ত খুঁজে পাবেনা তাই একজন শিক্ষক ট্রেন ড্রাইভার এর মত ট্র্যকে তুলে দিবেন (যেরকম করে ট্রেনকে লাইনে রাখেন তেমনি ছাত্রকে পড়াশোনার লাইনটা বুঝিয়ে দিবেন কিংবা ধরিয়ে দিবেন)। এটাই হচ্ছে মূল কাজ।
বাস ড্রাইভারকে যেরকম বাসকে বারবার লাইনচ্যুত হওয়া থেকে লাইনে আনতে হয়, গতি বাড়াতে হয়, কমাতে হয় অর্থাৎ সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। এই কাজটি একজন শিক্ষকের নয়। একজন ছাত্রের পড়া শিক্ষক পড়ে দিবে না বরং তাকে কেবলমাত্র পড়াশোনার পদ্ধতিগুলো ধরিয়ে দিতে পারে কিংবা বুঝিয়ে দিতে পারে। আর সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে সে নিজেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে অর্থাৎ তাকে পড়তে হবে ঠিক যেভাবে রেললাইনে উঠে যাওয়া একটি ট্রেন সামনের দিকে আগাতে থাকে।
কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা মাঝে মাঝে উল্টা ঘটনা দেখতে পাই অর্থাৎ কিছু অভিভাবক তাদের সন্তানদেরকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে একেবারে নিশ্চিত হয়ে যান। ব্যাপারটা এমন যে, শিক্ষক তার সমস্ত দায়ভার এবং দায়িত্ব নিয়ে নেবে। আবার অনেক প্রাইভেট টিউটর-কে দেখা যায়, ছাত্রের জন্য নোট করে দিতে এবং পড়াগুলো বাসায় গিয়ে গিলিয়ে দিয়ে আসছে। এর মূল কারন কমার্শিয়াল চিন্তাভাবনা। একজন ছাত্রের কাজ নিজের পড়া নিজে পড়ে নেওয়া এবং এই ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা দরকার হলে বা কিছু না বুঝতে পারলে শিক্ষকের কাছে থেকে সহযোগিতা নিবেন।
Source: Image by Ciara Houghton from Pixabay
কিন্তু আমাদের সমাজে এখন পরিস্থিতি উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমরা দেখতে পাই শিক্ষক ছাত্রকে বিভিন্ন ধরনের নোট করে দিচ্ছেন এবং পড়া গুছিয়ে একেবারে যতোটুকু পড়তে হবে যেভাবে পড়তে হবে সেটা মুখস্থ না করা পর্যন্ত শিক্ষক তার সাথে লেগে থাকছেন। এটা কখনোই একজন শিক্ষকের কাজ হতে পারে না। আর যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে একটা সময়ে গিয়ে এই ছাত্র আর তার লাইনে থাকতে পারবেনা। এক্সিডেন্ট অবশ্যম্ভাবী।
আর যেসব ছাত্র শিক্ষকের কাছ থেকে কেবলমাত্র গাইডলাইন ও সহযোগিতা নিয়ে নিজের লাইন নিজেই ধরে রাখে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যায় তাদের কখনো লাইনচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় না। শিক্ষাকে আসুন আমরা পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করে এবং বাণিজ্যিক না করে বরং স্বাভাবিক রাখি। আসুন শিক্ষাকে সবার জন্য অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি আর তাহলেই আমাদের শিক্ষকবৃন্দ ট্রেন ড্রাইভার এর মত ভূমিকা পালন করবেন এবং আমাদের সবার মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হবে যে, শিক্ষক মানেই হচ্ছে একজন ট্রেন ড্রাইভার এর মত বরং বাস ড্রাইভার এর মত নয়।
আজকে আমি যে বিষয়টি আপনাদের মাঝে শেয়ার করেছি এটি আমাদের সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের জানা দরকার এবং বোঝা দরকার বলে আমি মনে করি কারণ আমরা অনেকেই হয়তোবা শিক্ষার্থী নই বা শিক্ষক নই কিন্তু আমাদের আত্মীয়-স্বজন, ছোট-বাচ্চারা, পরিবার-প্রতিবেশী অনেকেই শিক্ষা গ্রহণ করছে বা প্রদান করছে। তাই তাদের মধ্যেও যখন এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হবে তখন আমরা শিক্ষার যে প্রকৃত মাধ্যম সেটাকে সবার মাঝে সহজে ছড়িয়ে দিতে পারব এবং সঠিক ধারণা জানাতে পারবো। ধন্যবাদ
এই সিরিজে পূর্বের পোস্টগুলোর তালিকাঃ
আমি কেঃ
কি অসাধারন লিখেন আপনি সাইফুল ভাই। আসলেই তাই অনেক অভিভাবক এটাই চিন্তা করে যে মাসের শেষে বেতন দেই সব দায়িত্ব ওনার । এই জন্যই দিন শেষে শিক্ষার হার বাড়ছে ঠিক কিন্তু ছাত্র ছাত্রী শিক্ষীত হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। কি আর করা স্যার দের এমন প্যারা দেয় স্যার ও পরে প্রশ্ন ধরিয়ে দিয়ে পাশ করিয়ে দেয়।
জি ভাই। শিক্ষকের কাজ ট্রেন ড্রাইভারের মত
সু শিক্ষায় শিক্ষীত মানুষ ই ভাল শিক্ষক হতে পারে। নতুবা আপনার কথা মত সে ছাত্র সমাজ কে এগিয়ে দিতে পারবে না। আমাদের শিক্ষার মান বাড়ছে কিন্তু সু-শিক্ষার মান কি আদেও বাড়ছে। ছাত্র সমাজ এখন দিক ভ্রান্ত পথিকের মত এদিক সেদিক ছুটা ছুটি করছে। আপনার লেখায় বাস্তবতার মিল রয়েছে। ধন্যবাদ ।
সাইফুল ভাই আমি আপনার লেখাগুলো বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ি। তবে মন্তব্য আসলে খুব বড় না করাই ভালো তাই দু এক কথাতেই শেষ করি। আমার মনে হয় আমাদের দেশের শিক্ষা এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক। যার টাকা আছে তিনি তার ছেলে বা মেয়ে কে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিতে পারছেন আর যাদের টাকা নেই তারা হচ্ছেন বঞ্চিত। অন্যদিকে শিক্ষক শ্রেণী নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেখা যায় না না রকম দুর্নীতি ও অনিয়ম।প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রত্যেকটি জায়গায় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে থাকে কোন সুপারিশ না হলে ওপর মহলের চাপ অথবা ঘুষ এর প্রভাব। এর উপর আছে আবার বিভিন্ন কোটার ব্যবস্থা। এত কিছুর পরে শতকরা কতজন উপযুক্ত ব্যক্তি শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আসতে পারেন?