দিনবদলের গল্প। ১০% সাই-ফক্স।
সবুজ বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ওর বস আসাদ সাহেব ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। কিছুক্ষণ পর সে সবুজকে জিজ্ঞেস করলোঃ কি ব্যাপার তোমার কোথাও যাওয়ার তাড়া আছে নাকি?
সহজ বললোঃ না স্যার তেমন কিছু না। আসাদ সাহেব আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আসাদ সাহেব সবুজের দিকে তাকিয়ে দেখেন সবুজ এখনো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
তখন তিনি সবুজকে বললেনঃ তোমার কোন কাজ থাকলে তুমি চলে যেতে পারো। আমি কাজ শেষ করে তারপর অফিস থেকে বের হবো।
সবুজ বললোঃ স্যার এটা কেমন হয়? আমার পরে আপনি অফিস থেকে বের হবেন। আসলে স্যার আমার আগামীকাল থেকে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। এজন্য একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে পারলে ভালো হোতো। আপনি বের হলে তারপর আমি যাবো বাড়িতে।
আসাদ সাহেব একথা শুনে বললেনঃ তুমি এখনই বাড়ি চলে যাও। আমার জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে না। আমি সময় মতো চলে যাবো।
সবুজ তাও ইতস্তত করতে লাগলো। আসাদ সাহেব তাকে আবার তাড়া দিলো কি হলো এখনো যাচ্ছ না যে? তারপর সবুজ তার সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে সাইকেলে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
সবুজ পরিবারের বড় ছেলে। তার ছোট আরো দুটি ভাইবোন আছে। সাথে আছে বাবা-মা। এই পাঁচজনের সংসারের পুরোটা সবুজকে চালাতে হয়। কারণ সবুজের বাবা দীর্ঘদিন অসুস্থ্য হয়ে ঘরে পড়ে আছে। তিনি ঘরে পড়ে যাওয়ার পর থেকে সবুজের এই সংগ্রামী জীবনের শুরু। সবুজ ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় বেশ ভালো। এসএসসি পরীক্ষায় মোটামুটি ভালো ফলাফল করেছিলো।
তারপর ভর্তি হয়েছিল ওদের এলাকার সবচাইতে ভালো কলেজে। সেখান থেকে ভালো ফলাফল করে ইন্টার পাশ করেছে। তারপরে সবুজের বাবা অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে যায়। তখন এলাকার লোকজন সবুজের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। তারপর থেকে এভাবেই চলছে। কিন্তু সবুজ নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান মনে করে। কারণ তার অফিসের সবাই তাকে খুব সাহায্য করে। এই যে চারটি বছর সে অনার্সে পড়েছে। যখনই তার ছুটির প্রয়োজন হয়েছে তার বস তাকে কখনোই নিষেধ করেনি।
সবুজ ফাইনাল পরীক্ষার কথা অনেক আগেই তার বসকে বলে রেখেছিলো। তার বস তাকে বলেছে যে কদিন পরীক্ষা সে কটা দিন সে ছুটি পাবে। সবুজ অবশ্য তার বস কে বলেছে আমার পুরো দিন ছুটি লাগবে না। পরীক্ষা দিয়ে এসে আমি অফিসের কাজ করে তারপর বাড়িতে যাব। সবুজের সততা এবং কর্মদক্ষতায় অফিসের সবাই তার উপর খুশি। এতটাই খুশি হয়েছে যে তার বস তাকে বলেছে। যদি সে অনার্সে ভালো ফলাফল করতে পারে তাহলে তাকে এই অফিসেই ভালো পোস্টে একটি চাকরি দেয়া হবে।
এই কথা শোনার পর থেকে সবুজ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভালো রেজাল্ট করার। সারাদিন অফিসে কাজ করার পর সন্ধ্যার সময় বাড়িতে গিয়ে পড়তে বসে। গভীর রাত পর্যন্ত পড়তে থাকে সে। আবার পরদিন সকালে উঠে অফিস। এভাবেই গত কয়েকটি বছর চলছে। সবুজের মা বাবা ও ছেলেকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছে। সবুজ তার বাবা মার কাছে বলেছে যে তার বস তাকে ভালো চাকরি দিতে চেয়েছে। সবুজ এবং তার বাবা মা চিন্তা করছে আর মাত্র কটা দিন। একবার সবুজ ভালো রেজাল্ট করতে পারলে। তাদের আর কষ্টের দিন থাকবেনা। তারা অনেক ভালো একটা জীবন যাপন করতে পারবে।
সবুজ মনে মনে অনেক স্বপ্ন দেখছে। সারাজীবন তাদের কেটেছে অভাব-অনটনে। সবুজ জানে তাদের অফিসে পার্মানেন্ট চাকরি পেলে ভালো অঙ্কের বেতন পাবে। সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে যদি চাকরিটা করে হয়ে যায়। তাহলে সে তার পরিবারকে নিয়ে শহরে চলে যাবে। অফিসের আশেপাশে একটা বাসা নেবে। ছোট ভাই বোন দু'টিকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাবে। অনেক স্বপ্ন তার মনে। এই স্বপ্নই তাকে আরো পরিশ্রম করার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়।
এভাবে দেখতে দেখতে সবুজের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। সবুজ শতভাগ নিশ্চিত যে তার ফলাফল ভালো হবে। কারণ তার সবগুলো পরীক্ষা ভাল হয়েছে। আর ভালো না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ সে প্রচুর পরিশ্রম করেছে। এই কয় বছর সে অনেক লেখাপড়া করেছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর যথারীতি আবার সে কাজে মনোযোগ দিলো। আর মনে মনে দিন গুনছে যে কবে রেজাল্ট বের হবে।
অবশেষে দেখতে দেখতে চলে এলো সেই কাঙ্খিত দিনটি। সবুজ তার বসের কাছ থেকে ঘন্টাখানেকের ছুটি নিয়ে কলেজে গেলো তার রেজাল্ট দেখতে। নোটিশ বোর্ডে সবার রেজাল্ট টানানো আছে। কিন্তু সবুজ সেখানে পৌছানোর আগেই তার বন্ধু-বান্ধব এসে তাকে ঘিরে ধরলো। সবাই তার কাছে আবদার করলো আমাদের মিষ্টি খাওয়াতে হবে। সবুজ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো কেন কি হয়েছে? তারা সবাই সবুজকে বলল তুই ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিস। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করেছিস তুই। একথা শুনে খুশিতে সবুজের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। তার এতদিনের স্বপ্ন আজ সফল হতে চলেছে। সবুজ তার বন্ধুদেরকে কথা দিল খুব শিগ্রই তাদেরকে মিষ্টি খাওয়াবে। সেখান থেকে সবুজ সরাসরি অফিসে চলে এলো।
কিন্তু সে অফিসে ঢুকে অবাক সে দেখে অফিসের সবাই একটি কেক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ ঢুকতেই সবাই হাততালি দিয়ে সবুজকে অভিনন্দন জানালো। তারপর সবুজকে সাথে নিয়ে সবাই মিলে কেক কাটলো। কেক কাটার পর তার বস নিজ হাতে তাকে কেক খাইয়ে দিলো। তারপর সবুজের হাতে একটি খাম দিলো। সবুজ খামটি হাতে নিয়ে তার বস কে জিজ্ঞেস করল এটা কি স্যার? তার বস তাকে বলল তুমি নিজেই খুলে দেখো। সবুজ খামটি খুলে ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করলো।
কাগজটি পড়ে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাকে অফিসে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এটা সেই নিয়োগপত্র। বেতনের ঘরের সংখ্যা গুলো দেখে তার মাথা ঘুরে গেলো। মাসে ৭০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি। সবুজ চিন্তা করতে লাগলো তার স্বপ্ন ও এতো বড়ো ছিল না। কিন্তু পরক্ষণেই সে তার বস কে জিজ্ঞেস করল যে স্যার আমি তো আপনাদেরকে রেজাল্ট এর কথা বলিনি। তাহলে আপনারা আগে থেকে জানলেন কিভাবে? সবুজের বস তখন তাকে মনে করিয়ে দিলো। কিছুদিন আগে আমি তোমার কাছ থেকে তোমার রোল নাম্বার নিয়ে রেখেছিলাম। তুমি মনে হয় ভুলে গিয়েছো। তুমি যখন কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে তখন আমি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে তোমার রেজাল্ট চেক করেছি।
সবুজ কৃতজ্ঞতায় তার বসকে সালাম করতে গেলো। সবুজের বস আসাদ ছাহেব সবুজ কে বুকে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ করে সবুজ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এদিকে তার বস তাকে বলতে লাগলো স্যার আপনি না হলে আমি কখনোই আমার লেখাপড়া শেষ করতে পারতাম না। সবুজের বস তখন তাকে বলল এখন তুমি বাড়ি যাও। আজকে আর তোমাকে কাজ করতে হবে না। কালকে থেকে তুমি তোমার রুমে বসবে। চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে সবুজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। (সমাপ্ত)
@tipu curate
Upvoted 👌 (Mana: 4/7) Get profit votes with @tipU :)
ভাইয়া সবুজের গল্প পড়ে খুবই ভালো লাগলো। আমাদের সমাজে এখনো এত সখ পরিশ্রমই ছেলে আছে বলেই জগৎটা এত সুন্দর। তবে সবুজের এই অবস্থান আসার পেছনে তার বস আসাদ সাহেবের অবদান অনেক বেশি। কারণ তিনি যদি সহযোগিতা না করতেন তাহলে কখনই সবুজ এই অবস্থানে আসতে পারত না। একটি অফিসের বস যদি সৎ মানবিক হয় তাহলে অফিসের পরিবেশটা অনেক সুস্থ থাকে সবাই কাজ করে শান্তি পায়। অন্যদিকে সবুজের স্বপ্ন পরিশ্রম করার মন-মানসিকতা তাকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এক জীবনে চলার পথে আশেপাশের সবার সহযোগিতা ও দোয়া লাগে। শত সমস্যার মাঝেও নিজের স্বপ্ন যদি বুকে লালন করা যায় তাহলে অবশ্যই একদিন স্বপ্নটাকে পূরণ করাও যাবে। এত সুন্দর একটি লেখনী আমাদের মাঝে তুলে ধরার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া।
আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপু । তবে এই ধরনের গল্প কিন্তু আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে । একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন ।
এইরকম একটা গল্প পড়ে মনটা অনেক খুশি হয়ে গেল তৃপ্তিতে ভরে গেল। সবুজের মতো অসংখ্য ছেলে আমাদের বাংলাদেশে আছে। তাদের সবার পরিণতি যেন সবুজের মতো হয় সেই কামনা করি।
ঠিক বলেছেন ভাই ভবিষ্যতের কিছু স্বপ্ন আমাদের পরিশ্রম করতে সাহায্য করে। স্বপ্নটা পূরণ করার জন্যই সবুজের মতো অসংখ্য ছেলে স্ট্রাগেল করে যায়। এবং সবুজের বস আসাদ সাহেবের মতো বস সবার কপালে থাকে না। উনি বেশ ভালো মানুষ।
দারুণ লিখেছেন ভাই এককথায় অসাধারণ।।
ঠিকই বলেছেন এই ধরনের বস পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার । তবে আমরা কিন্তু ঠিকই পেয়েছি আসাদ সাহেবের মত একজন বস ।
হুম ভাই আমাদের সবার প্রিয় দাদা💖💖
এরকম কিছু বস যদি সত্যিই সমাজে থাকতো তাহলে সমাজটা কতোটাই না সুন্দর হতো।হয়তো আছে এমন মানুষ তবে খুব বেশি নেই।
অল্প হলেও আছে কিন্তু । আমার আপনার সামনেই এমন একজন দাঁড়িয়ে আছেন । দাদার কথা চিন্তা করুন ।
গল্পটি পড়তে পড়তে কোন সময় যে গল্পের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলাম বুঝতেই পারি নি। যতই পড়ছিলাম ততই আগ্রহ জন্মাচ্ছিলো সবুজ কে ঘিরে। কত পরিশ্রম আর সহ্য শক্তি থাকলে একজন মানুষ সব কিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে সব কিছু সামলে সামনে এগিয়ে যেতে পারে তা গল্পে খুব সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কাংখিত ফল পাওয়া শুধু ভাগ্যের উপর না বরং পরিশ্রম ও দৃঢ়তার সংমিশ্রণ। শেষের অংশে এসে সবুজের মতো আমারো চোখ ভিজে যাচ্ছিলো। সত্যই মানুষ পারে। তার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম আর ধৈর্য্য থাকাটা খুব বেশি দরকার।
একটু খেয়াল করলেই এ ধরনের চরিত্র আশেপাশে দেখতে পাবেন ।
তবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর লোকের সংখ্যা খুবই কম ।
জ্বি ভাই। আশে পাশে আমাদের অনেক মানুষ আছে যারা সবুজের মতোই। কেউ কেউ মাথা উচু করে দাঁড়ায় আবার কেউ কেউ ঝরে যায়।