স্মৃতিচারণ: শীতের রাতে আখের খুলায় চাচাদের গল্পের আসর।
হ্যালো
আসসালামু আলাইকুম।
কেমন আছেন বন্ধুরা? আশা করি সবাই অনেক ভালো আছেন। আজকে আমি আমার ছোটবেলার সুন্দর একটা স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করব। আমি নিশ্চিত যাদের বাড়ি গ্রাম অঞ্চলে তাদেরও এরকম স্মৃতি আছে।
আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম। হয়তো ক্লাস ফোর ফাইভে পড়তাম। আমার বাবা তার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তাঁরা মোট তিন ভাই। আমার চাচারা সবাই আমার বাবার সাথে প্রতিবছরই আখ চাষ করতেন। আর এ ধারাবাহিকতা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছিলো ৷ আমার দাদা অনেক আখ চাষ করতেন প্রতিবছরই। জমিগুলো ছিল আমাদের বাড়ির আশেপাশেই। বেশি দূরের জমিতে আখ চাষ করতেন না। তো আখ যখন কটার সময় হতো তখন সেগুলো গুড় বানানোর জন্য খুলায় আনা হতো। অনেকেই খুলা নাও চিনতে পারেন ৷ যেখানে আখ মারাই করে গুড় প্রস্তুত করা হয় ওটাকেই আমাদের গ্রামে খুলা বলে। অন্যান্য জায়গায় ভিন্ন নাম থাকতে পারে।
যাইহোক, প্রতি বছর শীতে যখন আখ কাটার সময় আসতো তখন আমার চাচারা সবাই মিলে আমাদের বাড়ির পাশের জমিতে ইয়া বড় একটা খুলা বানাত। আমাদের আশেপাশের কোন জায়গাতেই এত বড় খুলা বানাতে দেখিনি আমি। আমার চাচাতো দাদার সাতটি ছেলে ছিল। তারাও আমার আব্বুদের সাথে কাজ করতো। আমার ঐসকল চাচারাও প্রতিবছর আখের চাষ করতো। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অনেক সুন্দর খুলা বানানো হতো প্রতিবছরই। গ্রামে আমরা যে সকল ছেলেপেলে একসাথে খেলাধুলা করতাম, তাদের সব সময় দেখা মিলত খুলাতেই। যতোদিন খুলা থাকতো, ততোদিন অন্যান্য জায়গায় আর খেলতে যেতাম না আমরা।
ওই সময় বাইনের খুলার প্রচলন ছিল। আমাদের বাইনের খুলা বানাত প্রতি বছরই। আর এখন তো সব কড়াইয়ের খুলা। কড়াইয়ের খুলা বানাতে বেশি একটা জায়গার প্রয়োজন হয়না আর পরিশ্রম ও কম। বাইনের খুলা গুলোতে উপরে একটা চরাটের মতন বানিয়ে রাখা হতো, ওটার উপর বসে প্রত্যেকটা বাইনের অবস্থা বিবেচনা করে রস উঠানো নামানো করা হতো। আমার মেজ কাকু এই কাজটা করতেন। উনি খুব দক্ষ ছিলেন এই কাজে। আর আমার আরও এক চাচা ছিলেন উনি সবসময়ই জ্বাল দিতেন। জ্বাল দেয়ার কাজে উনি ছিলেন উস্তাদ। গুড় জ্বালানো হতো অনেক রাত ধরে। আমার স্পষ্ট মনে আছে সন্ধ্যাবেলায় আমার আম্মু আমার হাতে বাতি দিয়ে খুলায় রেখে আসতে বলতেন। ওই সময়ে বিদ্যুতের কোন ব্যবস্থা ছিল না। খুলায় কেরোসিন চালিত বাতির আলোতেই সব কাজ করা হতো ।
সন্ধ্যা নামার পর আমি বই নিয়ে দ্রুত পড়তে বসে যেতাম। কারণ চাচারা সবাই খুলাতে থাকে আর অনেক মজার মজার গল্প বলে। এই জন্য রাত একটু গভীর হলেই লেখাপড়া শেষ করে আমি চাচাদের কাছে চলে যেতাম গল্প শুনতে। আমার চোখে এখনো এই স্মৃতিগুলো ভেসে বেড়ায়। শীতের রাত, চাঁদর গায়ে দিয়ে চলে যেতাম খুলায়। বাতির মিনমিন আলোতে কাজ চলছে। সবাই জ্বাল দেওয়ার ওইখানে বসে আছে। বড় চাচা জ্বাল দিচ্ছে আর আমার মেজ চাচা গুড়ের দেখভাল করছে। আর বাকি সবাই গোল হয়ে বসে আছে। কেউ কেউ আবার বিড়ি ফুঁকছে। ওইখানে গিয়ে খড়ের গাদার উপর বসে পড়তাম। উপরে চাতাল থাকায় কুয়াশা পড়তো না। সবাই জ্বাল দেওয়ার ওইখানে গিয়ে বসে থাকতাম। এতে আগুনের আঁচ লাগত। বেশ উষ্ণতা অনুভব করতাম সবাই।
এভাবে গোল হয়ে বসে শুরু হতো গল্পের পর্ব। চাচারা বিভিন্ন রকম গল্প বলতো। তাদের সেই ছোটবেলার ঘটনা, অনেক পুরনো দিনের ঘটে যাওয়া অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাহিনী, তারা বিভিন্ন জেলায় কাজ করতে যেত সেখান থেকে ঘটে যাওয়া মজার স্মৃতি, এসব গল্প দিয়েই তখন জমে উঠত গল্পের আসর। আমার ওইখান থেকে বাড়িতে আসতেই মন চাইত না। যত রাত পর্যন্ত খুলার কাজ চলতো, আমিও চাচাদের সাথে থাকতে চাইতাম। আর মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে আলু নিয়ে আসতাম গুড়ের মদ্ধে দিয়ে সেদ্ধ করে খেতে। আমার বন্ধুদের সাথেও আলু আর বেগুন ওই গরম গুড়ের মধ্যে রেখে সেদ্ধ করে খেতাম।
আমার ওই দিনগুলোর মধ্যে চাচাদের সাথে গল্পের সুন্দর মুহূর্তগুলোই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। তাছাড়া শীতের সময় বন্ধুদের সাথে খুলাতে বিভিন্ন ধরনের খেলায় মেতে থাকার মুহুর্তগুলোও স্মৃতিতে এসে কড়া নাড়ে। সত্যিই ওই দিনগুলোতে যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম!! এরকম যদি সিস্টেম থাকতো তাহলে সত্যিই আমি ঐ দিনগুলোতেই গিয়ে পড়ে থাকতাম। এই পোস্ট লিখতে গিয়ে অনেক স্মৃতি আবার মনে পড়ে যেতে লাগলো। যাই হোক আমি এখানেই বিদায় নিচ্ছি। দেখা হবে নতুন কোন পোস্টে। ভাল থাকবেন সবাই। আল্লাহ্ হাফেজ।
250 SP | 500 SP | 1000 SP | 2000 SP | 5000 SP |
ফেলে আসা অতীতে আর ফেরা যায় না ভাই। আগে ইলেকট্রিসিটি টিভি মোবাইল এসব ছিল না। গ্রামের মানুষ রাতে একসঙ্গে বসে গল্প করত। এবং আখের খোলা এইরকম জায়গাই রাতে যেন আসরটা আরও বড় হয়ে উঠতো। আমাদের এলাকায়ও আগে আখের খোলা ছিল কিন্তু ক্রমেই আখের আবাদ কমছে😩। দারুণ একটি মূহুর্ত শেয়ার করে নিলেন ভাই আমাদের সঙ্গে। ধন্যবাদ আপনাকে।।
আমাদের এলাকায় শত শত ইকর জমিতে আখের চাষ হতো। কিন্তু বর্তমানে এখন আর তেমন আখেরে চাষ হয় না। ছোটবেলায় শীতের সময় গরম গরম আখের গুড় দিয়ে মুড়ি মেখে খেতাম কি মজাই না পেতাম। ছোটবেলার দারুন স্মৃতি চারণ করেছেন ভাই। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল।
ভাইয়া স্মৃতি আসলে সব সময় অনেক মধুর হয়। আর আপনার ছোটবেলার আখের গুড় বানানোর স্মৃতিগুলো পড়তে পড়তে আমারও অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এখন তো কোথাও এসব দৃশ্য চোখে পড়ে না। আগে আমরা ছোটবেলায় যখন গ্রামে যেতাম শীতকালে অনেক জায়গায় এমন দৃশ্য চোখে পড়তো। আমার নানা বাড়িতে প্রচুর আখের চাষ হতো সেখানেও আখের রস দিয়ে গুর বানাতো। আমরা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সেই জায়গায় চলে যেতাম টানা খাওয়ার জন্য। গুর বানানোর সময় আঠালো কিছু অংশ বের হতো আমরা সেটাকে টানা বলতাম। আপনার স্মৃতিগুলো পড়ে নিজেও অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারলাম।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ভাইয়া খুব সুন্দর একটি গল্প পড়লাম। ছোট সময়ের সৃতি গুলো মনে হলে আবার ফিরে যেতে মন চাই। যায়হোক ভাইয়া সব গুলো ভাষায় বুঝলাম শুধু বাইনের খুলা এই জিনিষটা চিনলাম না। যদি সম্ভব হয় ছবি দিলে ভাল হতো । ধন্যবাদ ভাইয়া।
আহ কি মধুর ছিল সময়গুলো। আমিও আপনার মতো আখের গুড় বানাতো খুলার মধ্যে সেটা দেখেছি। আমার কাছে দারুণ লাগতো। একদিক দিয়ে গুড় হতো আরেক দিক দিয়ে খেতে থাকতাম। শীতের রাতে আগুনের উষ্ণ স্পর্শে শরীরও গরম হয়ে যেত। শৈশবের দিনগুলি কখনো ভুলার নয়। মিস করি দিনগুলিকে খুব 🙂
আপনার ছোট বেলার গল্প শুনে আমিও নস্টালজিক হয়ে গেলাম। এরকম মজার স্মৃতি প্রতিটি মানুষের আছে। আপনার চাচাদের সাথে রাতে খুলায় সময় কাটানো, গুরের মধ্যে আলু সিদ্ধ করে খাওয়া, বন্ধুদের সাথে খুলায় সময় কাটানো এগুলো সত্যিই অনেক মজার বেপার। আমি বাইনের খুলা আর কড়াইয়ের খুলার পার্থক্য জানতাম না পরে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম। ধন্যবাদ ভাইয়া এতো সুন্দর একটি ছোটবেলার গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
ভাইয়া আপনার এ স্মৃতিচারণ মূলক পোস্টটি পড়ে আমার খুবই ভালো লেগেছে। খুবই ছোট বেলায় শীতের সময় অর্থাৎ মাঘ মাসে যখন আমার দাদা এবং চাচারা আখের রস করে গুড় তৈরি করত তখন সেই গুড় থেকে তৈরি খাজা খাওয়ার জন্য তাদের সাথে রাতের পর রাত থেকেছি। রাতে দাদার মুখে কত যে গল্প শুনেছি সে কথাগুলো মনে হলে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমি ছোটবেলায় আমার মা-বাবার তুলনায় আমার দাদা এবং দাদীর শাসনে এবং আদরে সবচাইতে বেশি সময় কাটিয়েছি। শীতের সময় রোদ ওঠার সাথে সাথে দাদী মামাকে জোর করে গোসল করিয়ে দিত, জোর করে গোসল করানোর দৃশ্য দাদা দেখে দাদিকে আবার বকাবকি করতে, বিকেল বেলায় বন্ধুদের সাথে শীতের সময় খেলা করা, এই সবগুলো এখন হয়ে গেছে অতীত স্মৃতি। এখনো আমাদের আখের চাষ রয়েছে তবে পূর্বের তুলনায় অনেকটাই কম কিন্তু সেই ছোটবেলার সময় তার নেই, নেই আমার সেই প্রিয় দাদুভাই। পূর্বে সেই সময়টা খুবই মিস করি। ভাইয়া আপনার এ পোষ্টটি পড়ে সত্যি বলতে আমি নিজেও আমার ছোটবেলায় কেমন যেন হারিয়ে গেলাম।
এই খুলা সম্পর্কে জ্ঞান একেবারে নেই বললেই চলে তাই প্রথম শুনলাম।আফসোস হচ্ছে এমন কোনো স্মৃতি নেই বলে।
দাদা আলু ও বেগুন মিষ্টি হয়ে যেত না গুড়ের মধ্যে দিয়ে সেদ্ধ করলে! দারুণ মজার বিষয় ছিল এটি,তাছাড়া আপনার বাবা কাকার গল্প পড়ে ভারী ভালো লাগলো।স্মৃতিগুলো খুবই আনন্দের ছিল,ধন্যবাদ আপনাকে।