🍁নমস্কার বন্ধুরা🍁

🙏🙏🙏

---

নীলমের লেখামিতে আপনাদের স্বাগত

---

নাগরিক অধিকার
--------------------------- নীলম সামন্ত

মনখারাপ আমাদের নাগরিক অধিকার-

কথা মত অর্ধেক জীবন আমি হেসেছি,
বাকি অর্ধেক কাঁদব না ভেবে নেশা করি বৃক্ষের।

মা বাড়ি নেই
বাবা হারিয়ে গেছেন গাছের শিকড়ে।

আমি এখনও সন্তান।

হাতের নক্ষত্র খসলে বুঝি
নিজেকে ঠিক ততটা পুড়িয়েছি যতটা বল্কলের রঙ।

.
.
.
আমি কোনদিন বাবা হতে পারব না৷ অথচ বাবার মৃত্যুর দিনে ছায়ার দিকে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে গিলে নিতে হবে -

অসতো মা সদ্‌গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।
আবিরাবীর্ম এধি।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং
তেন মাং পাহি নিত্যম্‌।

আমি কতটা কি উচ্চারণ করছি সেটা বড় কথা নয়, দেহের ভেতর যে জন্ম ক্রমশ বৃদ্ধ হচ্ছে আর মৃত্যু ক্রমশ কিশলয় হচ্ছে তা নিয়ে ধ্যানে বসা দরকার। কারণ আজ একটি মৃত্যু দিন৷ আর বহু প্রিয়জনের মৃত্যুর কথা হিসেব অনুযায়ী আওড়াতে গিয়ে আশ্রয় করে নিচ্ছি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা রবে

নাহ আমরা তো থাকতে আসিনি। চলে যেতেই এসেছি। অহেতুক আছি তা নয়, আমাদের থাকার কথা, সন্তানসন্ততিদের হাত ধরার কথা, অনেক কিছু না পারার মধ্যেই কিছু পারার কথা বলেই আছি৷ নইলে কবেই চলে যেতাম, দরজা হাট খোলা হয়ে পড়ে থাকত, বাতাসের অবাধ আনাগোনায় না জানি কত প্রেতের বন্ধু, মাচা, ইত্যাদি জুটে যেত৷ সেদিন মনখারাপ করার জন্য বেঁচে থাকতে পারে আমাদের কিছু সুখস্মৃতি। চোখের জল ফেলিয়ে সেগুলোই আওড়ে নেবে পৃথিবীর যোদ্ধারা৷ সবাই নয়, যাদের আপনজন বলে অনুমান করে এসেছি৷

এই অনুমানগুলো আসলে জীবনের এক একটা ধাপ। ঠিক যেভাবে সৃষ্টির ধাপে ধাপে পরিনতির দিকে এগোয় জীবনও সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যায়৷ শুধু তফাৎ, সৃষ্টি শেষ ধাপে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরে নিজের অপরূপ পরিনতি কথা বলতে চায়, আলোকিত হতে চায়। জীবন সব ধাপ পেরিয়ে গেলে ফুরিয়ে যায়৷ অথচ জীবনের মতো সৃষ্টি এই জগৎ সংসারে আর কিছুই নেই৷ অথচ জীবন ফুরিয়ে যায়। সব কিছুই ফুরিয়ে যায়। সময়ের হাত ধরে কে যে কখন নিঃশব্দে উড়ে যায় কিংবা চুরি হয়ে যায় আর সন্তানসন্ততিরা নিজেদের হাত খুলে খুঁজতে থাকে কোথায় তার বাবা-ছাপ, কোথায় মা-ছাপ।

মৃত মানুষের হাতেও আয়ুরেখা থাকে৷ সেই আয়ুরেখা বরাবর যে নক্ষত্রের ইস্কুল ঘর সেখানকার বেঞ্চে বসলে জানা যায় নক্ষত্র মরে গেলেও আলো রেখে যায়। সেই আলো বছরের পর বছর কোথাও না কোথাও থেকে দেখা যায়৷ যে বাবা আজ মারা গেছেন, তাঁর হাত খোলা ছিল, আয়ুরেখায় ধুলো জমেছিল, তাঁর সন্তান হাতের মুঠোয় আয়ুরেখা ধরে আগুন নিয়ে এগিয়ে গেছে৷ তাকে জ্বালিয়ে দিতে হবে ওই ধুলো জমা আয়ুরেখা। তারপর সে বাড়ি ফিরে আসবে। মৃত্যুর পর ফিরে আসা যায় না বলেই তার বাবা কোনদিন নিবিড় পাঠকের মতো তার মুখের দিকে তাকাবে না।

সন্তান, আপনি কি কাঁদছেন? আপনার বাবা অনন্তে ফিরে গেছেন বলে কাঁদছেন নাকি আপনি বাবা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছেন বলে কাঁদছেন, নাকি আপনার ভেতর সামান্য কিছু বছর বয়সি বাবা ভয় পেয়ে কাঁদছে? আপনি কাঁদুন। এতো অন্ধকার আবছা না হয়ে এলে আপনি কিভাবে দেখবেন জন্মের পাশে মৃত্যু নাচছে, তা তা থৈ থৈ।

আমিও তো কাঁদি, আমার ঠাকুমা চলে গেলেন যেদিন সেই দিন্টা বাদ দিলে বাকি প্রায় দিনই কাঁদি৷ আসলে সেদিন আমার কাঁদার সময় ছিল না। বাড়ি ভর্তি লোক, মাঝে রানীর মতো লাল পাড় ধপধপে শাদা শাড়ি পরে শুয়ে আছেন ঠাকুমা৷ তাম্রলিপ্ত রাজার মেয়ে! অসাড় শরীরেও যেন রাজার দাপট৷ চুপ করে বসে দেখছিলাম, শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছে, চুড়ি বের করা যায়নি, আঙুলগুলো সোজা সোজা। আমাকে ঘি মাখাতে বলা হয়েছিল। আমি পায়ে আলতা পরাতে শুরু করেছিলাম, সেদিন ঠাকুমার কাতুকুতু লাগেনি৷ আমাকে দ্বিতীয়বার বলেনি "তোর মা আসুক বলব"। তবে কপালের আগুন যখন সিঁদুর পুড়িয়ে দিচ্ছিল আমি দেখলাম সূর্য মুখের ওপর ঝুঁকে আছে৷ তারপর থেকে ঠাকুমা আর ফেরেনি৷ আমি একা আমার মতো। আমি কোলহারা।

আপনার ধরিয়ে দেওয়া আগুন নিভে গেলেই সব অহেতুক অস্বস্তি মুছে যাবে৷ হ্যাঁ অহেতুকই তো। নইলে কি আর আমরা এখানে উঁচু গলায় জায়গা দখলের লড়াই করি? আমাদের এই অনাবশ্য আগমনে বা প্রত্যাগমণে আমাদের মা, আমাদের বাবা সবাই-ই ক্ষণিক। আমরাও। শুধু ছাপা অক্ষর স্পষ্ট হলে নিজের চারপাশটা সুন্দর করে তুলি।

যাই করি, যতটাই করি, যেতে আমাদের হবেই৷ তারপরেও যদি কেউ নতুন করে গায়, তবে তার মুখের প্রতিটা হাসিতে লেখা হবে বৈচিত্র্যময় যতিচিহ্ন।

বন্ধুরা, ভালো থাকবেন। আজ আমাদের প্রিয় দাদার বাবা চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে৷ হয়তো ঘটনাটির ঘটানোর জন্যই তাঁর বেঁচে থাকা। আজ থেকে বাবাহীন নতুন অধ্যায়ে ঢুকে পড়লেন দাদা৷ পিতাহারানোর শোক যেভাবে আঁচড় দিয়ে গেছে তা কমবে না৷ তাও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করি আপনাকে শক্তি দিন৷ উনি আপনার ভেতরেই আছেন৷ ওনার ছায়াতে থাকতে থাকতে কবেই উনি আপনার ভেতর জন্ম দিয়ে নিয়েছেন আজ বুঝতে পারছেন না। কাল বা পরশু ঠিকই বুঝবেন আর আয়নায় দাঁড়িয়ে জামার বোতাম লাগানো দেখতে দেখতে ভুল করেই না হোক 'বাবা ' বলে ডাকবেন৷ বাবা আসবে৷

এপর্যন্তই থাক আজ। আবার আগামীকাল আসব।

টাটা

ছবি নিজের ফোন ক্যামেরাতে তোলা। এঁকেছি ছোট ড্রয়িং বুকে, পেন্সিল কম্পাস, পেন্সিল, ইরেজার, জল রঙ, তুলি দিয়ে৷