বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের এক যাত্রার গল্প

in আমার বাংলা ব্লগ2 months ago

আসসালামু আলাইকুম আমার প্রিয় বন্ধুরা, কেমন আছেন আপনারা সবাই। অবশ্যই আপনারা ভালো আছেন, সুস্থ আছেন, আপনাদের দোয়ায় আমি অনেক ভালো আছি। আজকে আমি আপনাদের মাঝে একটি সুন্দর গল্প শেয়ার করতে চলেছি। আর এটি শুধু গল্প নয়, এটি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা। যেটা আমি অনেক সময় মনে করে অনেক দুঃখ ফিল করি।

balazs-busznyak-El5zuQAtfeo-unsplash.jpg
Src

আজকে আমি আপনাদের মাঝে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের এক যাত্রার গল্প শেয়ার করতে চলেছি। যে যাত্রাটি আমার জীবনে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আসলে মানুষের জীবনে কখন যে কি হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না, এটা আমরা কম বেশি সবাই জানি সবার জীবনেই সমস্যা আসে সবার জীবনেই এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় সে চাইলেও সেটাকে ভুলতে পারে না। ঠিক তেমনটা আমার সাথে হয়েছিল অনেক বছর আগে।

সময় কি খুব ভালো মনে নেই তবে সম্ভবত ২০০৮ কিংবা ২০০৯ সালের ঘটনা। যখন আমি জীবিকার তাগিদে আমাদের পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলাম। আমি গিয়েছিলাম ইন্ডিয়ার মুম্বাই শহরে কাজের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে গিয়ে খুব বেশি কাজ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কারণ কি জানেন আমার চেনা জানা তেমন কেউ ছিল না ওখানে। তাই আমার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র সাথে কথা বলে আমি চলে যাই মুম্বাই থেকে এক দিনের রাস্তা পুনা শহরে।

সেখানে গিয়ে আমি কনস্ট্রাকশনে কাজ শুরু করি, আমার সাথে অনেক বাঙালি ভাই ছিল। তবে তারা কেউই বাংলাদেশের ছিল না। তারা ছিল ইন্ডিয়ার কলিকাতার। তবে আস্তে আস্তে তাদের সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেহেতু একসাথে কাজ করি। এভাবে কাজ করতে করতে প্রায় তিন মাসের মত আমরা একটি প্রজেক্টে কাজ করি। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়, আমরা তিন মাস কাজ করার পরে আমরা বেতন পায়নি কেউই। তাই বাধ্য হয়ে আমরা সেই কাজ বন্ধ করে অন্য জায়গায় কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ি।

কিন্তু অচেনা শহরে কে দেবে আমাদের কাজ, কোথাও কাজ মিলাতে না পেরে আমি ভাবলাম আমি পুনরায় মুম্বাইতে চলে আসব। এই তিন মাসে আমার হাতের অবস্থা এতটাই খারাপ যে নিজে একটা কিছু যে কিনে খাবো এমন পয়সাও নেই কাছে। তারপরও ভাবছি কি করে আমি আবার পুনরায় মুম্বাইতে যাব, এভাবেই ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো এতো দিনে কম বেশি আস্তে আস্তে অনেক চেনা জানা মানুষ হয়ে গিয়েছে মুম্বাইতে, আর আমার সাথে কয়েকজন রাজি হল তারাও মুম্বাইতে আসবে। তাদের চেনাজানা অনেক মানুষ আছে, তাদেরকে কাজ দিবে। তাই তাদের সাথে দলবেঁধে আমি চাচ্ছিলাম নতুন একটি কাজে যোগ দেব।

কিন্তু আমাদের কারোর কাছে টাকা নেই, কারন আমরা তিন মাস ধরে কোন বেতন পাই না, টাকা থাকবে কোথা থেকে। তাই বাধ্য হয়ে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তিনজন ছিলাম আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠবো। পরে টিটি সাহেব যা পারে করবে, যা আমাদের কপালে আছে তাই ঘটবে।

তাই আমরা আমাদের সেই পুরনো জায়গা থেকে বেরিয়ে পড়ি মুম্বাইতে আসার উদ্দেশ্যে ট্রেন স্টেশনে। এসে আমরা অপেক্ষা করছিলাম কখন ট্রেনে আসবে, আর সেই ট্রেনে আমাদের চুরি করে ঢুকতে হবে। তাছাড়া তো কোনো উপায় নেই কারণ আমাদের কারো কাছে টাকা নেই।

mateo-broquedis-VqG8ebyxKvk-unsplash.jpg
Src

প্রায় দেড় ঘন্টা বসার পরে আমাদের ট্রেনটি আসল, এসে থামল স্টেশনে। আর আমরা সব মানুষ উঠে গেলে সব শেষে আমরা উঠে পড়ি ট্রেনে। ভালোই যাচ্ছিল প্রায় দুই ঘন্টা চলে গেছে কারো সাথে আমাদের দেখা হয়নি। আমাদের মনে তো ভয় আছেই আমাদের কাছে টাকা নেই যদি টিটি এসে আমাদের ধরে আমরা কোন জবাব দিতে পারব না, কেন আমরা টিকিট কাটেনি।

দুই ঘন্টা পেরিয়ে তিন ঘন্টার মাথায় টিটি সাহেব আসলো, টিকিট চেক করার জন্য। সবার টিকিট চেক করছে সবশেষে আমাদের তিনজনের কাছে এসে টিকিট চাইলো, কিন্তু আমাদের কাছে তো টিকিট নেই। অনেক কাকুতি মিনতি করে টিটিকে বললাম ভাই আমরা টিকিট কাটেনি, কারণ আমাদের কাছে কোন টাকা নেই। আমরা মুম্বাইতে যাব সেখানে কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি।

টিটি আমাদের কোন কথাই শুনছে না, সে আমাদেরকে জা না তাই করে বলতে শুরু করলো, অবশেষে সে আমাদের বলল আচ্ছা তোমরা থাকো তোমাদের ব্যবস্থা মুম্বাইয়ের স্টেশনে হবে। অনেক ভয় পাচ্ছিলাম কারণ আমাদের কাছে টাকা নেই তেমন কোন ডকুমেন্টস নেই,আমরা যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ি তাহলে আবার অনেক সমস্যা হয়ে যাবে। কারণ এমন কাজ করলে স্টেশনের কর্মকর্তাদের পারমিশন আছে তারা পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারবে।

এমনটা ভাবতে ভাবতে অবশেষে ২৪ ঘন্টা পর আমরা এসে পৌছালাম বোম্বাইয়ের দাদর স্টেশনে, সেখানে আসার সাথে সাথে দেখলাম টিটি আমাদের কাছে চলে এসেছে এবং সাথে দুইজন রেল কর্মকর্তাকে নিয়ে এসেছে। তারা আমাদের সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করে বলল তোমরা তিনজন আমাদের সাথে এসো। সত্যি বলছি ভাই অনেক ভয় লাগছিল কারণ কি হবে আগে আমরা কেউই জানিনা।

toni-pomar-yju_2kfu0ow-unsplash.jpg
Src

তারপর আমাদেরকে নিয়ে একটি রুমে নিয়ে বসালো এবং বেশ ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর একজন বড় অফিসার আসলো, আর আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকলো তোমরা কোথা থেকে এসেছো, তোমাদের দেশের বাড়ি কোথায়, তোমরা এভাবে বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠেছ কেন। এমন অনেক প্রশ্ন করতে থাকলো অবশেষে আমি আমার সাথে থাকা দুইজনকে বললাম আপনারা চুপ করে বসে থাকবেন আমি দেখি একটু কথা বলে কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

তখন আমি ওই বড় অফিসারকে কান্না কান্না ভাবে বলতে থাকলাম স্যার আমরা খুবই গরীব ঘরের মানুষ, আর আমরা কোন আতঙ্কবাদী কিংবা চোর নই। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ, কাজের উদ্দেশ্যে আমরা পুনা শহরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমরা এই তিন মাস ধরে কাজ করে কোন টাকা পাইনি, তাই আমরা বাধ্য হয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠেছি। আমাদের দেশের বাড়ি কলকাতাতে। আমরা তেমন কেউ হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারি না, আমি একটু একটু পারি তাই আপনার সাথে কথা বলছি।

এমন বলতে থাকা দেখে ওই বড় অফিসার আমাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য বলছে এদের তিনজনকেই পুলিশের হাতে তুলে দাও। তখন আমি ওই বড় অফিসার কে বারবার মিনতি করতে থাকলাম স্যার আমাদের পুলিশের হাতে দিবেন না, আমরা খুবই গরীব মানুষ। আমাদের কাছে কোন টাকা নেই, আপনি চাইলে আমাদের ব্যাগগুলো চেক করতে পারেন। যদি একটি টাকাও আপনি খুঁজে পান তাহলে আমাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন।

এমন কথা শুনে ওই বড় অফিসার একজনকে বলল এই দেখ তো ওদের ব্যাগগুলো একটু চেক করে ওরা আসলেই কি সত্যি বলছে কিনা। তখন অন্য একজন অফিসার আমাদের তিনজনের ব্যাগ চেক করল, আর দেখল আমাদের ব্যাগে একটি পয়সা নেই। তখন ওই অফিসার টি বড় অফিসার কে বলল এরা সত্যি বলছে স্যার এদের কাছে একটি টাকাও নেই। তখন ওই বড় সাহেব আমাদেরকে বলল তোমরা এখন কোথায় যাবে, তখন আমরা একটা লোকেশনের কথা বললাম ।যে আমরা ওই জায়গায় কাজের জন্য যাব।

তখন ওই বড় সাহেব বলল তোমরা ওই জায়গায় যাবে কিভাবে ? তোমাদের কাছে তো দেখি কোন টাকা নেই, বললাম হ্যাঁ স্যার যেভাবে পোনা থেকে এসেছি আমরা ভাবছি এভাবেই চুরিচামারি করে কোন বাসে কিংবা ট্রেনে চড়ে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাব। এ কথা শুনে ওই বড় অফিসারটি আসলে কেমন জানি একটা অনুভব করল, তখন ওই বড় অফিসারটি পকেট থেকে ১০০ টাকা বের করে আমাদেরকে দিল বলল তোমরা তোমাদের গন্তব্যে পৌঁছাও। তোমরা কাজ করো কাজ করে তোমাদের বাড়িতে টাকা পাঠাও আজেবাজে কোন খরচ করবে না।

তার এমন ব্যবহার তার এমন সহানুভূতি পেয়ে আমরা সত্যি অনেক আনন্দ পেলাম, ভাবতে থাকলাম আসলেই পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে। যদি এই পৃথিবীতে ভালো মানুষ না থাকতো তাহলে আমাদের জীবনটা কি হয়ে যেত।

অবশেষে তার কাছ থেকে আমরা টাকা নিয়ে আমাদের গন্তব্যে এসে পৌঁছায়, আর পুনরায় শুরু করি আমাদের কর্মজীবন।

বন্ধুরা এটাই ছিল এক দুঃসাহসিক ট্রেন যাত্রা, যেখানে আমরা বিনা টিকিটে ভ্রমণ করেছিলাম, এবং একজন ভালো মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিল। যার কথা এখনো মনে পড়ে, ভাবি ভালো মানুষ যতদিন এই পৃথিবীতে থাকবে ততদিন এই পৃথিবী থাকবে।

যাই হোক আপনাদের কেমন লেগেছে গল্পটি, অবশ্যই কমেন্টসের মাধ্যমে জানাবেন। ভালো লাগলে অবশ্যই আপনাদের মতামত শেয়ার করবেন সবাই ভাল থাকবেন সুস্থ থাকবেন ধন্যবাদ।

আমি আমার এই পোস্টের ১০% বেনিফিশিয়ারি @shy-fox কে দিলাম

নিজের সম্পর্কে ছোট্ট কিছু বর্ণনা

mamun benner.jpg
text15.png
আমি মোঃ মামুন, বাংলাদেশী। তবে কাজের সুবাধে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রবাসি জীবন যাপন করছি। নিজের অনুভূতিগুলোকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করি এবং অভিজ্ঞতাগুলেোকে ভিডিওর মাধ্যমে শেয়ার করি। তবে গান করতে বেশী ভালোবাসি, আর গেম খেলতেও ভালোবাসি,তাই অবসর সময়ে গান করি, ও গেম খেলি। বন্ধুত্ব তৈরী করতে ভালোবাসি। জীবনকে ভালোবাসি এবং উপভোগ করার চেষ্টা করি।

text15.png

Sort:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

 2 months ago 

বেশ অজানা একটি গল্প জানতে পারলাম আপনার আজকের এই পোস্ট পড়ার মধ্য দিয়ে। তবে এ তো পূর্বে এমন অনেক ঘটনা আমি শুনেছি মানুষের বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ করে থাকে। আমাদের এক স্যার বলেছিল উনি দীর্ঘ পথ জার্নি করেছিলেন মাত্র এক টাকা পকেটে রেখে। যাইহোক ভালো লাগলো ঘটনাটা জেনে।

 2 months ago 

আসলে যখন আপনার পোস্টটি পড়ছিলাম তখন সত্যিই আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কারণ আপনারা যে কিভাবে আপনাদের সেই দিনগুলো কাটিয়েছেন তা ভাবতেই যেন আমার ভয় হচ্ছে। আসলে আপনি যে কতটা কষ্টে আপনার সেই দিনগুলো পার করেছেন তা আপনার পোষ্টটি পড়ে আমি কিছুটা বুঝতে পারছি। আসলে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এখন আপনি হয়তোবা ভালো আছেন। আসলে আজকের পোস্টটি পড়ে আমার বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।

Coin Marketplace

STEEM 0.21
TRX 0.14
JST 0.030
BTC 68220.71
ETH 3321.59
USDT 1.00
SBD 2.74