কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের বসতবাড়ীতে কাটিয়ে এলাম কিছুক্ষণ
ভারত চেতনার আত্মা স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর বসতবাড়ীতে কিছুক্ষণ
আজ আপনাদের একটা বাড়ি দেখাব৷ ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতায় যে বাড়িটার অবদান অন্যতম। একটা দেশের সংস্কৃতি সেই দেশের পরিচয়। সারা বিশ্বের কাছে একটি দেশকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরতে ও উপস্থাপন করতে সেই দেশের মানুষ ও তাদের উপলব্ধির দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এমন এক দেশ, তার সংস্কৃতি সারা বিশ্বের থেকে ভিন্নধর্মী। আর সেই দেশের জাতির কণ্ঠকে সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন একজন উত্তর কলকাতার বাঙালী। তিনি আজ সারা ভারতের কাছে তথা বিশ্বের দরবারে পরম পূজ্য ও প্রাতঃস্মরণীয়।
আমি যাঁর কথা বলছি তাঁর নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাবা মা ছেলেবেলায় বিলে বলে ডাকতেন। দুরন্ত সেই শিশুই একদিন হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান মুখ। সারা বিশ্ব তাঁর মাধ্যমেই চিনতে পেরেছিল আমাদের এই বিশাল দেশকে। তখন অবিভক্ত ভারতীয় ভূখণ্ড। বাংলাদেশ, পাকিস্তান তখনও জাতীয়তাবাদের আগুনে পুড়ে দেশবাসীকে যন্ত্রণা দিয়ে দেশ থেকে আলাদা হয়ে যায়নি। আমরা তখন এক এবং অদ্বিতীয় ভারত। সম্মিলিত ভারত। অভিন্ন ভারত। সেই সময় এক যুবক সংকল্প নিলেন ভারতকে সারা বিশ্বে তার নিজস্বতায় তুলে ধরতে। হ্যাঁ, আমি যাঁর কথা বলছি তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং ভারতের আত্মা স্বামী বিবেকানন্দ। আজকের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠাতা৷ সুদূর আমারিকায় শিকাগো শহরে তিনি জলদগম্ভীর স্বরে যখন বলে উঠেছিলেন,
ডিয়ার ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টারস অফ আমেরিকা...
তখন সারা বিশ্ব জেনেছিল কোন সাংস্কৃতিক আলো প্রতিদিন এসে পড়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের গায়ে। হাজার মানুষের করতালিতে সেদিন গমগম করে উঠেছিল শিকাগোর ধর্ম মহাসভার প্রাঙ্গন।
অনেকেই জানেন তাঁর পৈত্রিক ভিটে ছিল উত্তর কলকাতার সিমলা স্ট্রিটের দত্তবাড়িতে। সেখানেই বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবীর কোল আলো করে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তারপর সেই বাড়িতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। সেই বাড়িই তাঁর যৌবনের তপোবন। হাজার গল্প সেই বাড়িটি ঘিরে। বিবেকানন্দ রোডের লাগোয়া সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি আজ সংরক্ষণ করে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। বেলুড় মঠে প্রধান কার্যালয় হলেও এই বাড়িতে রয়েছে মিশনের কার্যালয় ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারা ও দর্শনকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে অহরহ কাজ করে চলেছে এই সংস্থা। প্রচলিত আছে, এই বাড়িতেই তিনি শিশুবেলায় মা বাবার অলক্ষ্যে জানলা দিয়ে মায়ের শাড়ি, বাবার ধুতি গরীব দুঃখীদের ছুঁড়ে দিয়ে দিতেন।
আজ একটি বিশেষ আমন্ত্রণে পৌঁছে গেছিলাম এই ঐতিহাসিক বাড়ির মধ্যে৷ এতদিন বাইরে থেকে তাকিয়ে দেখেছি বাড়িটির চারপাশ। কিন্তু আজ সৌভাগ্য হয়েছিল বাড়িতে অন্দরমহলে প্রবেশ করার। আজ আর সেই পুরনো রূপ নেই। আজ রামকৃষ্ণ মিশন পুরো বাড়ির খোলনলচে বদলে ফেলেছে। প্রথমে বাড়িতে দিয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে ছবি তুলে রাখলাম বিশাল স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তির। তারপর ভেতরে প্রবেশ। সাজানো গোছানো চারটি তল সম্পূর্ণই বিবেকানন্দের বিভিন্ন বয়সের নানান পর্যায়ের ছবি দিয়ে ঘেরা। কোথাও ধ্যানরত বিবেকানন্দ, কোথাও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, আবার কোথাও কলকাতার এক আদ্যোপান্ত যুবক বিবেকানন্দ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বারবার চোখে পড়েছে বাড়িটির অসাধারণ রক্ষণাবেক্ষণে। ভেতরে রয়েছে বিবেকানন্দ হল, লাইব্রেরী, সংগ্রহশালা, রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যালয় ইত্যাদি। বাড়ির দেয়াল এবং দরজা-জানলা দেখে বারবার যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই প্রাচীন দিনগুলোর কথা। যখন এই বাড়ির আনাচে-কানাচে খেলে বেড়াতেন শিশু নরেন। এখান থেকেই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন যুবক নরেন। এ যেন এক আত্ম উপলব্ধির বিষয়। এই বাড়ি আজ আমার চোখে ধরা দিল নতুন করে। বহুদিন কলকাতায় যাতায়াত করার সূত্রেও কোনদিন সৌভাগ্য হয়নি এই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার। আজ জীবনে প্রথম এই মন্দিরে প্রবেশ করে নিজের চেতনাকে নতুন করে বুঝতে শিখলাম। বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন স্বনির্ভর ভারত। বারবার মনে হল আমরা কতটা তাঁর দর্শনকে আত্মস্থ করতে পেরেছি?
![]() | ![]() |
---|
আজ সিমলা স্ট্রিটে বিবেকানন্দের বাড়ি ঢুকে যেন ভারতের আত্মাকে চেতনায় নিলাম। ভারতভূমিকে মানবসত্ত্বায় উপলব্ধি করিয়েছিলেন তিনি। সেই যুগে দাঁড়িয়ে সাম্যবাদের যে ভিত তিনি বুনে দিয়েছিলেন ভারতের শিড়দাঁড়ায়, তা আধুনিক ভারতের রূপায়ণে প্রধান মানদণ্ড হয়ে ওঠে। আজকের স্বাধীন ও আধুনিক ভারত যেন দাঁড়িয়ে আছে শিমলা স্ট্রিটের এই বাড়িটির ভিতে। আর সেই প্রণম্য জমিতে দাঁড়িয়ে আজ একবার দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে এলাম শ্রদ্ধায়।
উচ্চারণ করে এলাম -
হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা—এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে? এই লজ্জাকর কাপুরুষতাসহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে? হে ভারত, ভুলিও না—তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী; ভুলিও না—তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না—তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের—নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে, ভুলিও না—তুমি জন্ম হইতেই ‘মায়ের’ জন্য বলিপ্রদত্ত; ভুলিও না—তোমার সমাজ সে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র; ভুলিও না—নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই! হে বীর, সাহস অবলম্বন কর; সদর্পে বল—আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই।
(চিত্রগ্রহণ - আমার ইনফিনিক্স হট ৩০ মোবাইল)
(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
আপনার লেখা খুবই ভালো লাগে। বিশেষ করে আপনি যেভাবে ঐতিহাসিক স্থানগুলো নিয়ে লিখেন। সেখানে ইতিহাসের ছায়া উঠে আসে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও বরাবরই ইতিহাসের প্রতি দুর্বল। আজ স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে কিছু জানতে পারলাম। ভালো লাগলো। নিয়মিত একজন পাঠক পেলেন কিন্তু। 😉
আপনার সুচিন্তিত মন্তব্য ভীষণ ভালো লাগলো। এমনভাবে আমার লেখার সঙ্গে জড়িত হলেন তা আমার প্রাপ্তি। আমার লেখা আপনার ভালো লাগলে তা আমার অন্যতম ভালোলাগার জায়গা। ইতিহাস নিয়ে আমার কিছু কাজ আছে। তিনটি বইও আছে। চেষ্টা করি হারানো ঐতিহ্য মানুষের সামনে তুলে আনার। এখন এই ব্লগিং প্ল্যাটফর্মেও এই কাজটি একনিষ্ঠতার সাথে করতে চেষ্টা করি। ভালো থাকবেন এবং অবশ্যই আমার লেখার সঙ্গে থাকবেন।
অবশ্যই আছি। ❤️