বাঙালির গর্ব হাওড়া ব্রিজ। আসুন জেনে নিই তার কিছু কথা।

in আমার বাংলা ব্লগlast month (edited)

কলকাতা হাওড়া সংযোগকারী প্রথম সেতু হাওড়া ব্রিজ


☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️


Pink & Green Watercolor Thank You Wish Card_20240725_002455_0000.jpg

☘️ সকলকে স্বাগত জানাই ☘️

আজ কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রধান দ্রষ্টব্য নিয়ে আপনাদের সামনে আলোচনা করব। এই দ্রষ্টব্য সারা পৃথিবীর কাছে কলকাতার ও বাংলার পরিচয় বহন করে। হাওড়া ব্রিজ। পোশাকি নামে যার পরিচয় রবীন্দ্র সেতু বলে। এই সেতু ভারতবর্ষের তথা এশিয়ার প্রথম ক্যান্টিলিভার সেতু, যেখানে সম্পূর্ণ সেতুটি কিছু ইস্পাতের সজ্জায় ও ওজনে ঝুলে আছে গঙ্গার উপরে। সেতু থেকে গঙ্গার তলদেশ পর্যন্ত কোন স্তম্ভ বা পিলার নেই।

বিভিন্ন কাজের সূত্রে প্রতিনিয়ত হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে এপার ওপার করতে হয় আমায়। আবার কখনও স্টিমারে চেপে হাওড়া ব্রিজের তলা দিয়ে পৌঁছে যাই বিভিন্ন গন্তব্যে। এক এক সময় যেন এক এক রূপ এই সেতুর। দূর থেকে দেখলেও অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকতে হয় এর দিকে। হাওড়া এবং কলকাতা এই দুই শহরকে যে সেতু প্রথম সংযুক্ত করে, তারই নাম ঐতিহ্যের হাওড়া ব্রিজ। এই ব্রিজের ঐতিহ্য নিয়ে যতই বলা যায় ততই যেন কম পড়ে। এমনকি এই ব্রিজের নামে হলিউডের সুপারহিট সিনেমা পর্যন্ত তৈরি হয়ে গেছে একসময়। দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক আসেন এই ব্রিজ চোখের সামনে থেকে পরিদর্শন করতে। আজও বহু গবেষকের দল এই ব্রিজে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করেন সম্পূর্ণ আর্কিটেকচারটি।

IMG_20240722_172036_927.jpg

ইতিহাস বলে, বহু ঘটনার সাক্ষী এই ব্রিজ। একসময় এই ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রামও চলত। যদিও তা আজ আর নেই। বর্তমানে যে সেতুটি আমরা দেখতে পাই সেটি নির্মাণ শুরু হয় ১৯৩৬ সালে এবং শেষ হয় ১৯৪২ সালে। এরপর ১৯৪৩ সাল থেকে শুরু হয় এই ব্রিজে যান চলাচল। তার আগেও একটি হাওড়া ব্রিজের অস্তিত্ব ছিল ওই একই জায়গায়, যা হাওড়া এবং কলকাতাকে যুক্ত করত। কিন্তু সেই ব্রিজ ভেঙে তৈরি হয় নতুন এই অত্যাধুনিক ব্রিজটি৷

ইংরেজ সরকারের আমলে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ হলে কলকাতার সঙ্গে হাওড়াকে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা প্রবল হয়ে ওঠে। একসময় কলকাতা - হাওড়া যাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল নৌকা। কিন্তু স্টেশনের উপযোগিতা বাড়াতে ইংরেজ সরকার ১৮৫৫-৫৬ সালে গঙ্গার উপর একটি সেতু নির্মাণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কমিটি তৈরি করেন। এরপর ১৮৭১ সালে তৎকালীন বাংলা সরকার একটি বিল পাস করিয়ে হাওড়া ব্রিজ আইন নিয়ে আসেন। তারপর শুরু হয় হুগলি বা ভাগীরথী নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ। যদিও সেই ব্রিজ আজকের ব্রিজটি নয়। তখন ইংল্যান্ড থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এবং উপকরণ নিয়ে সেগুলো জুড়ে তৈরি করা হয় একটি পল্টুন ব্রিজ। অর্থাৎ ভাসমান সেতু। সেই ব্রিজটি সারা ভারতে নিয়ে আসে এক যুগান্তকারী উন্নয়নের বার্তা। কিন্তু সেই ব্রিজটি অত্যধিক পরিমাণ যানবাহন এবং মানুষ বহনের অনুপযোগী হলে পরবর্তীকালে বাংলা সরকার নতুন একটি অত্যাধুনিক ব্রিজ তৈরীর পরিকল্পনা করেন। তারপরই শুরু হয় বর্তমান হাওড়া ব্রিজ বানানোর নকশা।

IMG_20240722_172221_114.jpg

আজকের হাওড়া ব্রিজ ভারতবর্ষের গর্ব। এই ক্যান্টিলিভার ব্রিজ প্রতিদিন লক্ষাধিক যানবাহন ও মানুষকে হাওড়া কলকাতা যাতায়াত করতে সাহায্য করে। পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত ব্রিজ এটি। আজ এত বছর পরেও এটি একইভাবে পরিষেবা দিয়ে আসছে বাংলার প্রতিটি মানুষকে। ১৯৩৬ সালে নির্মাণ শুরু হওয়ার পর কাজ শেষ হয় ১৯৪২ সালে। এরপর পুরনো ব্রিজের বদলে শুরু হয় নতুন ব্রিজে যান চলাচল। আর এই দীর্ঘ ৮০ বছর আমাদের হাওড়া ব্রিজ একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাওড়া স্টেশনের গা ঘেঁষে।

১৯৬৫ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় রবীন্দ্র সেতু। যদিও পরবর্তী সময়ে ভাগীরথীর উপর বিবেকানন্দ সেতু তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাতে গুরুত্ব কমেনি আমাদের প্রিয় হাওড়া ব্রিজের। আজও প্রতিদিন সমান সংখ্যক যানবাহন বুকের উপর বয়ে নিয়ে চলেছে এই ব্রিজ। হাওড়া ব্রিজ কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত ইতিহাস। বার্ন অ্যান্ড জেসপ কনস্ট্রাকশন কোং এই ব্রিজের নকশা করে। ইংরেজ সাহেবদের তত্ত্বাবধানে এই সেতু বাংলায় ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করে। ১৯৩৯ সালে মেসার্স ক্লিভল্যান্ড ব্রিজ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সব থেকে মজার ব্যাপার হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কারণে এই ব্রীজের জন্য প্রয়োজনীয় ইস্পাতের সামান্য পরিমাণ ইংল্যান্ড থেকে আনা সম্ভব হয়েছিল। তারপর কাজ থমকে যায়। এরপর কাজে গতি আনতে বেশিরভাগ ইস্পাতই সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতীয় কোম্পানি টাটা স্টিল এর ওপর। তাই এই ব্রিজের বেশিরভাগ ইস্পাতই টাটা স্টিলের। এই বরাত টাটা স্টিলকে আজকের টাটা সাম্রাজ্যে পরিণত হওয়ার পিছনে এক বিশাল অনুঘটকের কাজ করে। আজও সেই বিপুল পরিমাণ ইস্পাত সাজিয়ে নিজের আলোয় আলোকিত হয়ে হাওড়া কলকাতার মধ্যভাগে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে হাওড়া ব্রিজ।

IMG_20240722_170803_977.jpg

আমি যখনই হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়ে যাতায়াত করি, তখনই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি সেতুর দিকে। কি অসাধারণ এর নির্মাণ নকশা। একটিও নাটবল্টু ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে যে ব্রিজ ইংরেজ সরকার নির্মাণ করে দিয়ে গেছে, তা আজও যেন বাঙালির বিস্ময়। আপনারাও নিশ্চয়ই বিস্ময় চোখে একবার হলেও তাকিয়ে দেখেছেন এই ঐতিহ্যমন্ডিত সেতুর দিকে। আর যারা দেখেননি তারা অবশ্যই জীবনে একবার হলেও দেখে যাবেন হাওড়া ব্রিজের আশ্চর্য করা প্রযুক্তি। আজও এই ব্রিজের দিকে তাকিয়ে ভাবি কি করে একটিও স্তম্ভ ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ ঝুলন্ত অবস্থায় এতগুলি যানবাহন ও মানুষের ওজন বুকে নিয়ে নির্বিকার দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের প্রিয় হাওড়া ব্রিজ।


চিত্রগ্রহণের বিবরণ
চিত্রগ্রহণ
ইনফিনিক্স হট ৩০
ক্যামেরা
৫০ মেগাপিক্সেল
চিত্রগ্রাহক
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
কভার ছবি সৌজন্য
ক্যানভা অ্যাপ
তথ্যসূত্র
ক্লিক ১ ক্লিক ২

(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)


Banner_New.png


new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।


Sort:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

 last month 

এতদিন তোমার মুখে ছাড়া ছাড়া গল্পগুলো শুনেছি, এবার একসাথে গুছিয়ে যে সুন্দর করে লিখেছ। হাওড়া ব্রিজ আমাদের গর্ব। ইংরেজরা এসেছে সব কিছু লুটেপুটে নিয়ে গেছে এমনটা না। অনেক ক্ষেত্রে তারা কিছু করেছে, হয়তো নিজেদের সুবিধার্থে। কিন্তু সেই সব ঐতিহ্য এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

 last month 

একদম ঠিক কথা। ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে যেমন নিয়েছে তেমন কিছু দিয়েছেও৷ আজও আমরা সেই সুবিধা গুলি ভোগ করতে পারি।

Coin Marketplace

STEEM 0.16
TRX 0.16
JST 0.030
BTC 58389.55
ETH 2482.59
USDT 1.00
SBD 2.38