জাতির উন্নতিতে বই নয়, আজ কেক পেস্ট্রি বেশি দামি। লজ্জা।
শ্রীরামপুর স্টেশনে উঠিয়ে দেওয়া হল বহু পুরনো ঐতিহ্যবাহী বইয়ের স্টল
☘️ হুগলি জেলার একটি প্রধান শহর শ্রীরামপুরে রেল কোম্পানি তুলে দিল একটি প্রাচীন বইয়ের দোকান৷ পরিবর্তে তারা নিজেরা তৈরি করল খাবারের স্টল। একটি প্রতিবাদ। ☘️
আজ একটা জিনিস দেখে খুব অবাক হলাম। ভাবলাম সেই বিষয়টি আপনাদের সামনে তুলে আনি। যেটি প্রকাশ্যে আনা ভীষণ প্রয়োজন। আজকের যুগে ডিজিটাল কার্যকলাপ এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক অ্যাক্টিভিটি এমনভাবে মানুষকে গ্রাস করেছে যে সবথেকে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের মধ্যে বই একটি অন্যতম বিষয় হিসেবে মাথাচাড়া দিয়েছে। কিছুদিন আগেও বইয়ের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু আজ আমরা বেশি অভ্যস্ত মোবাইল পিডিএফ বা ই-বুকের মাধ্যমে কোন কিছু পড়তে। গতকাল একটি বিশেষ কাজে গেছিলাম শ্রীরামপুর। আপনারা জানেন শ্রীরামপুর হুগলি জেলার একটি প্রধান শহর। যেখানে প্রচুর বর্ধিষ্ণু পরিবারের বাস। ঐতিহাসিক এই শহরে একসময় ছিল ইউরোপিয়ান ঘাঁটি। আজও সেই সব ইতিহাস ছড়িয়ে আছে শহরের আনাচে-কানাচে। শ্রীরামপুরের সব থেকে খ্যাতি হল ভারতবর্ষে তথা এশিয়ায় প্রথম ছাপাখানায় বাংলা হরফ আবিস্কারের জন্য। এই শহর থেকেই ১৮০০ সালের পরে পরপর প্রকাশিত হতে থাকে উইলিয়াম কেরি, রামরাম বসুদের মত বিশিষ্ট মানুষদের বাংলা বই। যার মধ্যে রামরাম বসুর 'প্রতাপাদিত্য চরিত্র' বইটিকে প্রথম ছাপা অক্ষরে বাংলা বই হিসেবে ধরা হয় যা তৎকালীন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পাঠ্যবই ছিল। তাই সব মিলে ঐতিহাসিক শহর এই শ্রীরামপুর।
গতকাল শ্রীরামপুর স্টেশনে নামার পর চোখে পড়লো একটি IRCTC খাবারের স্টলের দিকে। এক নম্বর প্লাটফর্মে মাঝামাঝি এই স্টল একেবারেই নতুন। দেখেই আঁটকে উঠলাম। সেই জায়গাটি জুড়ে দীর্ঘদিন ধরে ছিল একটি বইয়ের স্টল। যেখানে পাওয়া যায় না এমন কোন বই বা সংকলন কোনদিন আমি চোখে দেখিনি৷ সেই স্টলটি ছিল স্থানীয় অভিষেকদার। দীর্ঘদিন শ্রীরামপুর যাতায়াতের সুবাদে তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ ছিল। এমনকি আমার প্রচুর বইও সে তার স্টল থেকে বিক্রি করেছে একসময়।
কয়েকদিন আগে অভিষেকদা বার কয়েক আমাকে ফোন করে বলেছিল যে তার বইয়ের স্টল আজ বিপন্ন। রেল কোম্পানির তরফে বারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে তার স্টল ভেঙে ফেলার। তখন বুঝিনি কী তাদের অভিপ্রায়। সময়ের অভাবে তখন অভিষেকদার সঙ্গে দেখা করাও হয়নি। ওই বার কয়েক ফোনে কথা। তারপর কাল শ্রীরামপুর স্টেশনে নেমে দুচোখে নেমে এলো জল। এক সময় যে বইয়ের স্টল দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সারা শ্রীরামপুর শহরকে পড়াশুনা করিয়েছে এবং শিক্ষিত করেছে, সেই স্টল আজ ভেঙে রেল কোম্পানি বেমালুম তৈরি করে দিল একটি নিজেদের খাবার দোকান। যেখানে এখন বইয়ের বদলে বিক্রি হচ্ছে নরম পানীয় থেকে শুরু করে কেক প্যাস্ট্রি এবং চিপস। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি সত্যিই কি আর কিছু হয়? একা একা সেই স্টলের দিকে তাকিয়ে অদৃষ্টের প্রতি ছুড়ে দিলাম প্রশ্নটা। কে যেন খিল খিল করে হেসে উঠলো আমার আড়ালেই।
আসলে আজকের পৃথিবী বড় যান্ত্রিক। শুধুমাত্র নিজের লাভের বাইরে আমরা কী বুঝি আজ? তাই কত অনায়াসে একটি প্রধান বইয়ের দোকান ভেঙে সেখানে কেকের দোকান খুলে দিতে পারি আমরা। এই আমরা আসলে কে? রেল কোম্পানি কি আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া সত্ত্বাটি নয়? সত্যিই কি কোনো ভাবনা চিন্তার দরকার নেই? এভাবে একটা বিখ্যাত বইয়ের দোকান যা যুবসমাজকে দীর্ঘদিন চাকরীর ফর্ম পর্যন্ত বিক্রি করে এসেছে, তা আজ অনায়াসে প্রাক্তন হয়ে গেল, আর আমরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম সেই অদৃষ্টের দিকে।
আসলে এটাই প্রমাণ হয় এই সমাজ ক্ষমতার। ক্ষুদ্র পুঁজির অভিষেকদার ক্ষমতা হয়নি, রেল কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করার। তার সাধ্যমত সেই সময় সে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আন্দোলনের বীজ পুঞ্জিভূত করতে চেষ্টা করেছিল। নিজের মতো করে স্টেশনে অনশন করে চেষ্টা করেছিল রেল কোম্পানির এই চক্রান্ত নষ্ট করার। কিন্তু সে তা করে উঠতে পারিনি। রেলের সাথে চুক্তি থাকা অবস্থাতেও সেই চুক্তি আর পুনর্নবীকরণ না করে রেল কোম্পানি কেমন অনায়াসে ভেঙে দিল তার সেই প্রাচীন বইঘরটি। যেখানে অবাধে বিক্রি হত লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনও, গল্পের বই, চাকরির পরীক্ষার বই অথবা পেন পেন্সিল রবার, কাগজপত্র৷
শ্রীরামপুর স্টেশন ফেলে আমি চলে গেলাম আমার কাজে। কিন্তু প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খেতেই থাকলো। এই ক্ষমতার দাপটে পড়ে আমরা আমাদের সত্বা হারিয়ে ফেলছি না তো? বাঙালি বই প্রিয় জাতি। সেই বাঙালির কাছ থেকে শ্রীরামপুরের মত একটি স্টেশনে যেভাবে বইয়ের দোকানটি তুলে নেওয়া হল এবং সেখানে জাঁকিয়ে বসানো হলো একটি রেলের খাবারের স্টল, তার তীব্র ধিক্কার জানাই।
গতকালের এই ঘটনা আমাকে আজও পীড়া দিচ্ছে। ক্ষমতার আস্ফালন কিভাবে যে আমাদের জাতিসত্বাকে নষ্ট করছে তার একটি উদাহরণ হলো এই ঘটনা। আজ সমাজে ক্ষমতা যার, অস্তিত্বও তার৷
আসুন না আমরা একটু ভাবি। এভাবে কি সত্যিই আমরা দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারবো? যেখানে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিনা পয়সায় ম্যাগাজিনের ট্রে রাখা থাকে, সেখানে আমরা নিজেদের ক্ষমতার আস্ফালন দেখাতে বইয়ের দোকান তুলে খাবারের দোকান বানাচ্ছি। প্রতিবাদ হওয়া কি দরকার নয়? একটু ভাবুন প্লিজ। এই বিষাদভরা মনে এটুকুই আবেদন সকলের প্রতি।
৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
বাঙালি জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য চরম লজ্জার। অভিষেক দাদার জন্য সত্যিই খুব খারাপ লাগছে। রেল কোম্পানির এমন একটা জঘন্য কাজ করা মোটেই উচিত হয়নি। বই হচ্ছে জ্ঞানের ভান্ডার, অথচ বইয়ের স্টল ভেঙ্গে খাবারের দোকান দেওয়া হয়েছে, এটা ভেবে সত্যিই বেশ অবাক লাগছে। এমন নিকৃষ্ট ঘটনার জন্য তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। যাইহোক পোস্টটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।
হ্যাঁ৷ বড় সংস্থার আগ্রাসনে অনেকেরই ক্ষতি হয়। রেল কোম্পানি এমন বারবার করে। ছোট ছোট দোকান যে কোনো সময় ভেঙে সরিয়ে দেয়৷ কারো কথা ভাবে না। সবটাই যেন তাদের মর্জি ভাই৷
আরেহ! এখানে কবিতার আলো রাখতে যেতে না? এই বুকস্টলটার জন্যই ওই ২৫ টা ফ্রেডেরিক নগর আনা করিয়েছিলে আমাকে দিয়ে? এটা নেই এখন! লোকজনের কি মাথা খারাপ ? শ্রীরামপুরে তো বিরাট কবি লেখক গোষ্ঠী! সবাই চেপে গেল নাকি? এতো ভারী অন্যায়! আর কত খাবে লোকে?
হ্যাঁ তো৷ কত স্মৃতি এই স্টলে৷ সেদিন এমন দেখে খুব কষ্ট হয়েছে। কত পুরনো দোকান৷ কিন্তু তুলে দিল৷ কেউ কিচ্ছু করে উঠতে পারলো না।
Books will never be unimportant! And I'm sure there would have been room for both on the platform...