দৈনন্দিন জীবনের বাইরে মনোরম বিলের ধারে কিছুক্ষণ।
দৈনন্দিন জীবনের বাইরে মনোরম বিলের ধারে কিছুক্ষণ
চিরকালই প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকতে ভালোবাসি। ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে বসবাস বলে মাঝে মাঝে ভালো লাগে ফাঁকা এবং কিছুটা জনমানবহীন এলাকা। আমরা কলকাতা শহরের ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু এই শহরের অদূরেই যে বিভিন্ন জায়গায় বহু এলাকা একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে মানুষকে দুহাতে আহ্বান করে, তা আমরা অনেকেই চিনতে পারি না। প্রকৃতি আসলে বরাবরই অকৃপণ। আমরাই সেই সৌন্দর্য কে নষ্ট করে নিজেদের সুবিধামতো তৈরি করি কংক্রিটের জঙ্গল। তারপর আবার নিজেরাই হাঁসফাঁস করি সেই দমবন্ধ করা পরিবেশের ফাঁসে। আসলে মানুষ বড় বোকা। চিরকালই নিজের ক্ষতি করার আগে মানুষ দুবার ভাবে না। তাই কত সহজে আমরা প্রকৃতিকে নষ্ট করি, নির্দ্বিধায় বৃক্ষচ্ছেদ করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলি। আর তার ফল হল আজকের বিশ্ব উষ্ণায়ন। আজ এই বিশ্ব উষ্ণায়নের দিনে একটুখানি শুদ্ধ বাতাসের স্পর্শ এবং তুলনামূলক জনমানবহীন প্রান্তর কার না ভালো লাগে? তাই আমিও খুঁজে বেড়াই এমন বিভিন্ন দিক যেখানে গিয়ে সমস্ত দৈনন্দিন জীবনের ক্লেশ ছেড়ে এক টানে মিশে যাওয়া যায় প্রকৃতির সাথে। কলকাতার কাছেপিঠে এমন বিভিন্ন জায়গা আছে যেগুলি এখনো মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আদর্শ পরিবেশের ডালি সাজিয়ে বসে আছে অপেক্ষায়। আমাদের কাছেপিঠে সল্টলেক বা রাজারহাট নিউটাউনের খুব কাছাকাছিও এমন বিভিন্ন মাছের ভেড়ি বা ক্ষেত রয়েছে। এইসব জায়গায় গুটিকয়েক মানুষের বাস। পেশা হিসেবে তারা বেছে নিয়েছেন সেই গ্রামেই মাছের ভেড়ির কাজ বা ক্ষেতের কাজকে৷ সেখানে নেই গাড়ি ঘোড়ার অত্যাচার। সেখানে নেই কারখানার ধোঁয়া আর দূষণের অনিয়ন্ত্রিত বিষাক্ত গ্যাস। এসবের বাইরে সামান্য এক টুকরো সবুজ এবং তার মধ্যে মিশে থাকা শুদ্ধ নিঃশ্বাস খুঁজে নিতে আমি কখনো কখনো পৌঁছে যাই এইসব গ্রামের প্রান্তরে। নিজের সঙ্গে থাকে বাহন বাইকটি। তার পিঠে চড়েই আমার ঘুরে বেড়ানো।
ঠিক এভাবেই একবার পৌঁছে গিয়েছিলাম বারাসাতের নিকটে একটি দিগন্ত বিস্তৃত বিলের সামনে। বিভিন্ন কাজে ব্যারাকপুর বারাসাত অঞ্চলে আমার নিত্য যাতায়াত। আর সেই সূত্র ধরেই খুঁজে খুঁজে পৌঁছে যাই বিভিন্ন গন্তব্যে। এখানে আজও নিয়মিত দেখা যায় কাঠঠোকরা পাখি, যেখানে পানকৌড়ি আজও সাঁতার কাটে জলে। এমন জায়গায় দুদন্ড বসে আবার যাত্রা শুরু করি নিজস্ব গন্তব্যের দিকে। শুধু মাঝের সময়টুকু বুকে ভরে নিই অনাবিল নিঃশ্বাস আর কিছুটা বেঁচে থাকার রসদ। তাই পথে যেতে যেতে একাই পৌঁছে গিয়েছিলাম বারাসাতে এই বিশাল বিলটির পাশে। সেখানে শাপলা ফুলের চাষ এবং আখের ক্ষেত আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। সেদিন একটি পরীক্ষা ছিল আমার। সেই পরীক্ষাটি দিয়ে ফেরবার পথে অদূরে এই বিলটি দর্শন করে আসার সুযোগ আমি নষ্ট করিনি। আর ওই মূল্যবান একটুখানি সময় আজও আমার স্মৃতির মণিকোঠায় সোনালী অক্ষরে লেখা আছে।
সেই বিলে নৌকা দাঁড়িয়েছিল সারি সারি। চাইলেই চড়া যায় নৌকাগুলিতে। ডাঙ্গার আশপাশ দিয়ে শাপলা বনের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে সেই নৌকায় এগিয়ে যায় আখের ক্ষেতকে এক পাশে ফেলে। এই সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ একেবারে মোহিত করে দেবে আপনাকেও। হয়তো আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দূরবর্তী গন্তব্যে পাড়ি দিই। কিন্তু নিজের খুব কাছে থাকা জায়গাগুলি সম্বন্ধ আমাদের কাছে কোন তথ্য থাকে না। তাই আমি মাঝে মাঝে ইন্টারনেট ঘেঁটে বিভিন্ন গন্তব্য বের করি। আর সময় সুযোগ বুঝে অল্প সময়ের জন্য হলেও একবার ঘুরে নিই সেই গন্তব্যে। ঠিক যেমন ভাবে পৌঁছে গিয়েছিলাম বারাসাতের এই বিলটিতে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর যখন গিয়ে দাঁড়ালাম এই বিলটির সামনে, তখন সেখানে গোধূলি নেমে এসেছে। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমের প্রান্তে। আর তার মধ্যেই এক অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে ঘিরে ধরেছে চারপাশ থেকে। আমি আজও ভুলতে পারিনা সেই দৃশ্য। যতদূর তাকাই শুধু জল আর জল। আমায় কয়েকজন মাঝি এসে জিজ্ঞাসা করলেন, নৌকা চড়বেন বাবু? আমি বললাম, একা মানুষ, নৌকা চড়ে আর কি করবো বলুন ভাই? তারা একগাল হেসে চলে গেলেন। পরিবর্তে এক কাপ গরম চা খেয়ে সেই জায়গা থেকে আমি বেরিয়ে এলাম। তারপর আবার আঁকাবাঁকা গ্রামের পথ ধরে চলে এলাম বারাসাত টাউনে। আধ ঘন্টার এই বিল ভ্রমণ আমার কাছে আজও এক ব্যাতিক্রমী সময় হিসেবে ধরা আছে। আবার ইচ্ছে আছে যাওয়ার। যদি কখনো সুযোগ সময় পাই, নিজের প্রিয় মানুষের সাথে নিশ্চয়ই আবার পৌঁছে যাব এই বিলের ধারে। হয়তো শাপলা বনের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা নৌকায় চড়ে কিছুক্ষণ হারিয়ে যাব প্রকৃতির মাঝখানে।
আজ এই পর্যন্তই। আবার নতুন ব্লগ নিয়ে হাজির হব আপনাদের সামনে। ততক্ষণ পর্যন্ত সকলে ভালো থাকবেন। আর আমার বিবরণের এই বিল আপনাদের ভালো লাগলে অবশ্যই কমেন্ট করে তা জানাবেন।
(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
প্রকৃতির সঙ্গে আমার গভীর একটা ভালোবাসা আছে। কিন্তু বাধ্য হয়েই প্রকৃতি থেকে দূরে আছি। চমৎকার একটা বিকেল কাটিয়েছেন আপনি চমৎকার একটা পরিবেশ। বিলের এমন সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করে দিতে পারে। আপনার ফটোগ্রাফি গুলো দেখে জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেছি।