ঐতিহাসিক যশোর রোডে একটি নাতিদীর্ঘ যাত্রা। গাছগাছালি মোড়া এক স্বপ্নের যাত্রাপথ।
যাত্রাপথ যখন ঐতিহাসিক যশোর রোড
একটি বিশেষ কাজে আজ নিজের বাইকে চেপে চলে গেছিলাম অনেকটা দূর। আর নিজের মধ্যে একটা আগ্রহ ছিল রাস্তাটা ঘিরে। যদিও কলকাতা লাগোয়া এই রাস্তায় বহুবার যাতায়াত করেছি, কিন্তু সেই রাস্তা ধরে অনেকটা দূর যাত্রা করিনি এর আগে কখনো। এই প্রথম এখান দিয়ে পৌঁছে গেছিলাম অনেকটা দূরে। রাস্তাটির নাম যশোর রোড। কলকাতার শেষ প্রান্তে যে রাস্তার সূচনা হয় এবং যা পৌঁছে যায় অধুনা বাংলাদেশের যশোর পর্যন্ত, সেই রাস্তার নামই যশোর রোড। কিন্তু আমি হঠাৎ একটা রাস্তার কথা নিয়ে পোস্ট লিখতে গেলাম কেন? এই প্রশ্ন অনেকের মনে উঁকি ঝুঁকি দিতে পারে। তো এবার আসুন বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বলি।
যশোর অবস্থিত বাংলাদেশ থেকে কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত। আঞ্চলিকভাবে দেশের বেড়াজাল দুই জায়গাকে আলাদা করে দিলেও আলাদা করতে পারিনি একটি প্রকাণ্ড লম্বা রাস্তাকে। যা প্রথম বানিয়েছিলেন নাটোরের মহারানী ভবানী। আজ সেই ঐতিহাসিক যশোর রোড দিয়ে বাইকে পৌঁছে গিয়েছিলাম কলকাতা থেকে একেবারে হাবড়া পর্যন্ত। অংকের হিসাবে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু রাস্তার শোভা দেখতে দেখতে আমার পৌঁছতে খুব একটা দেরি হয়নি। বিশেষ আগ্রহী ছিলাম এই রাস্তা দিয়ে যাব বলে। কারণটা সেই রানী ভবানী। চিরকালই ইতিহাসের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ কাজ করে ভেতরে। সেই আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারিনি কোনদিন। গোটা কয়েক বইও লিখে ফেলেছি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ এক করে। আজ তাই এই ঐতিহাসিক যশোর রোড দিয়ে যাবার সময় শিহরণ একটা অনুভব হচ্ছিল অবশ্যই।
নাটোরের রানী ভবানী কলকাতায় গঙ্গাস্নানে আসবেন বলে সরাসরি রাস্তা তৈরি করলেন যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত। কিন্তু এখানেই ক্ষ্যান্ত দিলেন না। মহারানী আসবেন পালকিতে করে। সঙ্গে আসবে সৈন্য সামন্ত লোক লস্কর। তাই সে রাস্তা কি যে সে রাস্তা নাকি? সেই যুগেই রাস্তায় ছায়া দানের ব্যবস্থার জন্য রানী রাস্তার দুই ধার ভরে দিলেন গাছে গাছে। আজ এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় এই রোডে দুই পাশে বিখ্যাত গাছের সারি লক্ষ্য করতে করতে গেলাম। আজও বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে রানী ভবানীর গাছগুলি। যেন কেউ মরেনি। সমস্ত গাছ আজও নির্বিকারী ছায়া দান করছে সম্পূর্ণ রাস্তার। যদিও এরমধ্যে দুঃখজনক সংবাদ রয়েছে অনেকগুলি। কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি যশোর রোড থেকে কিভাবে চোরাচালানকারীদের হাতে মৃত্যু হচ্ছে অসংখ্য মূল্যবান গাছের। তার কোন সুরাহা নেই। আর সারি সার গাছ কাটা পড়ছে প্রতিদিন। আজ সেই পথে যাওয়ার সময় বারবার বাইক দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে রাখলাম সেই অসাধারণ রাস্তার শোভার। যশোর রোড কলকাতা থেকে এয়ারপোর্টে মধ্যমগ্রাম বারাসাত এর উপর দিয়ে গুমা, হাবড়া দিয়ে সোজা পৌছে গেছে বনগাঁ পেট্রাপোল বেনাপোল সীমান্তে। আমি আজ যে পর্যন্ত গিয়েছিলাম, সেখান থেকে পেট্রাপোল সীমান্ত মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে।
যশোর রোড পশ্চিমবঙ্গের তথা বাংলাদেশের এক অন্যতম যোগসূত্রের মাধ্যম। প্রতিদিন প্রচুর গাড়ি এবং বাস এই পথে পার হয় ভারত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমানা। আমিও যাবার পথে দুটি আন্তর্জাতিক বাস প্রত্যক্ষ করলাম। পথে যেতে যেতে দুপাশে গাছেদের শোভা আমাকে এতই মুগ্ধ করলো যে বারবার দাঁড়িয়ে রাস্তার ছবি নিতে শুরু করলাম। এমন দৃশ্য পশ্চিমবঙ্গের আর কোন রাস্তায় দেখা যায় না। যশোর রোড বা NH35 যেন সম্পূর্ণটাই গাছের ছায়া দিয়ে মরা। প্রথমত রাস্তাটি একেবারেই সরলরৈখিক। এবং রানীর নির্বিঘ্নে কলকাতা আসবার জন্য গাছে গাছে ছায়া দুই পাশ। কিন্তু কয়েকটি জায়গায় নগরায়নের থাবা বসে গেছে এই রাস্তায়। সব থেকে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ বারাসাত শহর। বারাসাত ও মধ্যমগ্রামের দীর্ঘ অঞ্চল পরিণত হয়েছে সম্পূর্ণ কংক্রিটের জঙ্গলে। তাই সেখানে যশোর রোড প্রায় বিপন্ন। শুধুমাত্র বারাসাতের বেশ খানিকটা পর দত্তপুকুর থেকে সেই গাছ গাছালির শোভা শুরু হয়। যদিও যেতে যেতে দিকে দিকে দেখলাম কেটে ফেলা গাছেদের সারি। রানী ভবানীর বসানো সেই সব সাধের গাছ আজ মহীরূহে পরিণত হয়েছে। আর তার মধ্যেই চালানকারীদের হাতে মারা পড়েছে তেমন একাধিক গাছেরা। জানিনা এই করালগ্রাসের হাত থেকে বাকি সমস্ত গাছেরা উদ্ধার পাবে কিনা। কিন্তু যশোর রোড ও তার দুপাশের অসাধারণ পরিবেশকে বাঁচাতে এখনই উদ্যোগ নেয়া উচিত স্থানীয় প্রশাসনদের। অন্যথায় যশোর রোড জি. টি. রোডে পরিণত হতে বেশিদিন সময় নেবে না।
এটি ছিল আমার আজকের প্রতিবেদন। যশোর রোডের কিছু নিজের তোলা (ইনফিনিক্স হট ৩০ মোবাইলে) ছবি শেয়ার করলাম আপনাদের সঙ্গে। যে যশোর রোডের সঙ্গে মিশে আছে নাটোরের বিখ্যাত রানী ভবানীর ইতিহাস, সেই রাস্তা আমাদের কাছে সম্পদ। তাই ঐতিহাসিক সম্পদ রক্ষা করা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকেই প্রশাসন দের কাছে অনুরোধ করলাম যশোর রোড কে তার উপযুক্ত প্রাকৃতিক শোভাতেই সাজিয়ে রাখতে।
(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/KausikChak1234/status/1833952126588125674?t=GbWQ7-1DYcRkmkDWkJYvyg&s=19