৩য় পর্বঃ গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা [ দাড়িয়াবান্ধা ]
12-01-23
২৯ পৌষ,১৪২৯ বঙ্গাব্দ
আসসালামুআলাইকুম সবাইকে
২য় পর্বের পর
গ্রাম বাংলার চিরায়ত একটি খেলার মধ্যে দাড়িয়াবান্ধা একটি! দাড়িয়াবান্ধা খেলে নাই এমন ছেলে অথবা মেয়ে পাওয়া দুষ্কর! বিশেষ করে যারা গ্রামে বড় হয়েছে তারা নিশ্চয় এই খেলা সম্পর্কে বুঝে গেছে! গ্রামের সবাই এই খেলায় পারদর্শী ছিল! তবে সবথেকে বেশি পারদর্শী হতো যারা লাফ ও স্পিডে দৌড়ঁ দিতে হতো! যে বেশি বুদ্ধি খাটিয়ে খেলতে পারতো সে টিমই জয়ী হতো!
এই খেলাটা গ্রামে শুরু হতো শীতের মাঝামাঝি সময়ে! অর্থাৎ ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বলা যায়! তখন সবার স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত! পাড়ার কয়েকজন ছেলে মিলে শুরু করে দিতাম দাড়িয়াবান্ধা ঘর বানাতে! আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল একটি জমি! সেখানে তেমন চাষাবাদ করা হতো না! পরেই থাকতো জমিটা! দাড়িয়াবান্ধা খেলার জন্য ছিল একদম পারফেক্ট! সকাল সকাল পাড়ার কিছু ছেলে মিলে শুরু করা হতো ঘর বানানো! নীল রঙের লম্বা দড়ি! দড়িটা অনেক মোটা ছিল! মিলন কাকার দড়ির ছিল! আমরা যখন দাড়িয়াবান্ধা কোর্ট বানাতাম তখন কাকার কাছ থেকে দড়ি নিয়ে যেতাম! আমাদের তেমন কিছু বলতেন না! দুইপাশে দুজন দড়ি ধরে মাঝ খানে সোজা লাইন দাগ কাটা হতো! সেইম ওয়তে দুইপাশে দাগ কাটা হতো! ঘরের দৈর্ঘ অনেক বড় হবে! এজন্য দুইপাশে লম্বা করে লাইন কাটা হতো! তখন আমরা এতো মাপজোখ বুঝতাম না! চোখের আন্দাজে যতটুকু মাপ দেয়া যায়!
৬-৭ জন একসাথে খেলার জন্য তৈরি করা হতো ঘর! মাঝ খান দিয়ে ডাবল দাগ কাটা হতো! এই ডাবল দাগের ঘর করা হতো কারণ বিপক্ষ দলের প্লেয়ার যেন দাড়িঁয়ে পক্ষ দলের কাউকে স্পর্শ করতে পারে! এছাড়া হাটাহাটিঁ বা দৌড়ঁ দিতে পারে! যেহেতু ছয় থেকে সাতজন একসাথে খেলা হতো এজন্য আমরা ছয়টা দাগ কেটে নিতাম! আমাদের জমির একদম শেষ মাথা পর্যন্ত হয়ে যেত ঘর করা! ঘর তৈরি করতেও অনেক সময় লেগে যেত! তবে একটা ভালো লাগা কাজ করতো! কারণ একটু পরেই আমরা সবাই মিলে খেলা শুরু করে দিতাম! খেলা দেখার জন্য আবার পাড়ার অনেক মানুষজন এসে যেত। সবাই মিলে খেলা উপভোগ করতো! দর্শক সারিতে থাকা অনেকেই আবার পক্ষ বা বিপক্ষ দলকে বুদ্ধি দিতো কোনভাবে খেললে ভালো হতো! এই নিয়েও লেগে যেত গন্ডগোল! কোনো পরামর্শ দেয়া যাবে না বাহির থেকে! দলের পরামর্শ অনুযায়ী খেলতে হবে।
খেলার শুরুতে একজন একজন করে ঘরের ভিতর প্রবেশ করতো! তবে সেটা সাবধানে! তিনজন একসাথে এক ঘরে আসলে হয়ে যেত জল্লা। আমাদের দিকে আঞ্চলিক ভাষায় তাই বলতো! অন্যদিকে হয়তো অন্য নামেও ডাকতে পারে! জল্লা হয়ে গেলে সেই দল তখন ঘরে গিয়ে দাঁড়াতো! খেলার নির্দিষ্ট গোল সেটা করা হতো! দশটা গোল্লা হলে গেম ওভার! অর্থাৎ যে দল আগে দশ গোল্লা দিয়ে দিতে পারবে তারাই আবার জয়ী হবে! আপনারা আবার গোল্লা বলতে দোকানের মিষ্টি বুঝিয়েন না, হাহাহা! এই গোল্লা ছিল পুরোটাই কাল্পনিক! খেলার প্রথম কোর্ট থেকে শেষের কোর্ট পর্যন্ত গেলে হয়ে যেত পাকা! যারা শেষ ঘরে যেতে পারতো না তারা কাচাঁ ! শেষ ঘরের পাকা একজন , কাচাঁ ঘরে প্রবেশ করতো তখন আবার জল্লা হয়ে যেত! বিপক্ষ দল সবসময় ট্রাই করতো কিভাবে জল্লা করানো যায়! কিভাবে পক্ষ দলের প্লেয়ারকে স্পর্শ করা যায়! স্পর্শ করতে পারলেই একটি দলের খেলা শেষ! এজন্য দলের সব প্লেয়ারকে সাবধানে ঘর পার হতে হতো! সব থেকে বেশি জামেলায় থাকতো মাঝ ঘরের প্লেয়াররা! যারা একটু দৌড়েঁ দক্ষ তারা বিপক্ষ দলের প্লেয়ারকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারতো।
অনেক সময় দেখা যেত মাঝ খানের প্লেয়ার পরের ঘরে যেতে পারছে না! সুযোগ খুজঁতো তখন! সুযোগ পেলেই দাগ বরাবর হাত দিয়ে অপর ঘরে যেত! আরেকটা মজার ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝে এমন হতো যে কাচাঁ প্লেয়ার আর পাকা প্লেয়ার মুখোমুখি ঘরে অবস্থান করতো! তখন শুধু একটা মাত্র উপায়! এক, দুই, তিন বলে লাফ দিতো! তখনও যদি বিপক্ষ দলের কেউ স্পর্শ করতে পারতো তখন বিপক্ষ দল খেলার সুযোগ পেত! ঘরের মাঝখানে বিপক্ষ দলের প্লেয়াররা দাড়িঁয়ে থাকত যাতে এদিক সেদিন না যেতে পারে! পক্ষ দলের চেষ্টা থাকতো যেন জল্লা আবার না হয়ে যায়।
তবে সব থেকে কঠিন কাজ হতো যেকোন দলের জন্য দশ গোল্লা দেয়া! দশ গোল্লা না দিলে জয়ী হতে পারবে না! আর এই দশগোল্লা পূরণ করতে সন্ধ্যা হয়ে যেত! খেলার অর্ধেক খেলা হতো সকালে, বাকিটা বিকালে খেলা হতো! পুরোটা সময় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করতো! দাড়িয়াবান্ধা খেলতে গিয়ে কতো যে ব্যথা পেয়েছি হিসেব নেই। হাতের এখানে চামড়া থেতলিয়ে, পায়ে ব্যথা তো পেয়েছি! তবুও খেলা ছাড়েনি! খেলার মজাটাই ছিল অন্যরকম!
শীতের সকালের সময়টাতে এই দাড়িয়াবান্ধা খেলা হতো! সবাই ঘুম থেকে উঠে সোজা আমাদের এখানে চলে আসতো! খেলা শেষ হলে হাত-ধুয়ে সকালের নাস্তা করা হতো! মায়ের বকুনির কি বাকি আছে! সকাল সকাল হাত, পা, জ্যাকেটে ময়লা জমে থাকতো! এসব দেখেই মা তো ঠিকই বুঝে যেত কোথা থেকে এসেছি! তেমন কিছু বলতো না । কারণ তখন পরীক্ষা থাকতো না! জানুয়ারীর শুরুতে আবার পড়ার চাপ শুরু হয়ে যেত। খেলাটাও তখন কমিয়ে দিতাম! সেই কবে দাড়িয়াবান্ধা খেলেছি মনেও নেই! মাঝে মাঝে সময়গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে!
গ্রামে যারা বড় হয়েছেন তারা দাড়িয়াবান্ধা খেলেছেন! শৈশবের সেরা সময়গুলো তখনই তো ছিল! মাথায় কোনো টেনশন কাজ করতো না। সন্ধ্যা হলে পড়তে বসা শুধু! সেটাও আবার রাত নয়টা অবধি! এইতো ছিল দিনগুলো, এভাবেই কেটে যেত। যাক, আজ এই পর্যন্তই! আবারো হাজির হবো গ্রাম বাংলার নতুন কোনো খেলার অনুভূতি শেয়ার করার জন্য! সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। আল্লাহ হাফেজ 🌼🦋
চলবে.....
10% beneficary for @shyfox ❤️
ধন্যবাদ সবাইকে
VOTE @bangla.witness as witness
OR
আমি কে?
আমার নাম হায়দার ইমতিয়াজ উদ্দিন রাকিব। সবাই আমাকে ইমতিয়াজ নামেই চিনে। পেশায় আমি একজন ছাত্র। নিজেকে সবসময় সাধারণ মনে করি। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয় এবং তা মেনে চলার চেষ্টা করি। বাংলা ভাষায় নিজের অভিমত প্রকাশ করতে ভালো লাগে। তাছাড়া ফটোগ্রাফি,ব্লগিং,কুকিং,রিভিউ,ডাই ইত্যাদি করতে ভালো লাগে। অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ভালো লাগে। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। ভবিষ্যতে প্রিয় মাতৃভূমির জন্য কিছু করতে চাই।
twitter share link
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
মোটামুটি এই খেলাটার নাম জানতাম আমরা কিন্তু আমাদের এলাকায় কখনো এমন খেলা দেখি নাই। তবে একটা বিষয় বেশ ভালো লাগলো আপনি পুরনো স্মৃতি সহ বিস্তারিত তুলে ধরেছেন এই প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে। আমাদের এখানে বেশিরভাগ গাড়িয়াবান্দা খেলার নয় বরং বেশি হতো গাদিখেলা শীতের কারণে।
আমাদের দিকে এই খেলাটা খুবই জনপ্রিয় ছিল তখন! শীতের বেলা তো অনেক খেলা হতো