( পর্ব দুই )★প্রোফেসর সোম ও তার রহস্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা★ সিরিজ ।। [ 10% for shy-fox bro ]

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

image.png

image source

★★★★★ প্রোফেসর সোম ★★★★★

দ্বিতীয় খন্ড

প্রথম খন্ডের লিঙ্ক

source

*************

গত পর্বের পর

এই লোকটাকে দেখে যদিও তেমন বিশেষ কিছু মনে হয় না। তবে একটা জিনিস যেটা এই আমিনুল্লা কে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করেছে, তা হল ওর ওই বীভৎস ঠান্ডা নিস্তেজ অস্বস্তিকর ঘোলাটে চোখ গুলো। তবে তার কথাবার্তা, তার চেহারার তুলনায় যেন কিছুটা বেশিই ধারালো। লোকটাকে দেখে আপাত দৃষ্টি তে, অতি সাধারণ বৃদ্ধ মুসলমান ভিখারি মনে হতে পারে। কিন্তু ভালো ভাবে লক্ষ্য করলে লোকটির চেহারা ছবির মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা বা বলা ভালো বিচিত্রতা চোখে পরতে পারে। যদিও প্রফেসর সোম, ওই জীর্ণ চেহারার আমিনুল্লার থেকে বিশেষ কিছু জানতে পারার, আশাবাদী নন। তাও শুধুমাত্র কিছুটা বাজিয়ে দেখে নিতেই এর সঙ্গে গল্প জমালেন। সিকিম ট্রিপের অভিজ্ঞতা তাকে কাউকে হেলা করতে দেয় না।

প্রফেসর সোম, আমিনুল্লার উদ্দেশ্যে বলেন, - "আপনি কি কিছু বলতে চান? তাহলে চলুন কোন হোটেলে বসে, চা খেতে খেতে না হয় আপনার কথা শোনা যাবে, আর আমি আপনার কথা গুলো টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখব।" আমিনুল্লা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, " বিলকুল! হমার কোই অস্ বিধা না আছে সাহেব। পাস্ হি মে একঠো ভালো চায়ে কা দুকান আছে। সিরাজ সিং কা। চলিয়ে ওয়া্হা। লেকিন চা সুধু আপনি খাবেন সাহেব। আমি বহুত দিন হল চা ছোড়ে দিয়েছি। "

সিরাজ সিং এর চা সত্যিই চমৎকার। মালাইয়ের ছোঁয়া আছে। সেটুকু এক চুমুকে সাবাড় করে দিয়ে প্রফেসর সোম বলেন, - তাহলে, আমি কি আমার টেপরেকর্ডারটা চালাতে পারি? নিস্পৃহ কন্ঠে সম্মতি জানায় লোকটা। প্রফেসর সোম চালিয়ে দেন টেপ রেকর্ডার টি। তারপর প্রতিটি শব্দ বন্দি হতে থাকে রেকর্ডারের বুকে। লোকটি বলতে শুরু করে-

মেরা নাম আমিনুল্লা হ্যায় সাহেব। আমিনুল্লা হুসেন। আমার বয়েস কত হামি জানি না। যখন, আমি জন্মেছিলাম তখন৷ দ্বারভাঙ্গাতে দেখা দিয়েছিল ভীষণ বাণ । মনে মনে হিসাব করতে শুরু করেন প্রফেসর। 1948 নাগাদ ভয়ানক বন্যা হয়েছিল সেবার বিহারে। মেইনলি এফেক্টেড হয়েছিল দ্বারভাঙা তার মানে এই লোকটির বয়েস এখন হবে চুয়াত্তর বছর।

প্রফেসর তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষন করেন আমিনুল্লা কে বয়সের তুলনায় লোকটার শরীর ভেঙে গেছে অনেক বেশি। মাথার চুল উঠে গিয়ে টাক পরেছে কপালে। বলি রেখায় ছেয়ে গেছে মুখাবয়ব। নিস্তেজ ঘোলাটে দৃষ্টিতে ছায়া ফেলেছে ধুসর অতীত। অস্থিচর্মসার মুখে সাদা দাড়ির জঙ্গল। কুজো হয়ে পরেছে শরীর। আসলে অনেক ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে যায়। কেন হয়ে যায় তার উত্তর, প্রফেসর সোম তা জানেন না। অনেকে, সত্তরের কোঠায় এসেও, যৌবন নামক পাখি টিকে আঁকড়ে রাখে শরীরের আকাশে। অনেকে আবার ষাট বছর পেরোতে না পেরোতেই পা রাখে বার্দ্ধক্য দৈন্য জগতে। এই লোকটি মনে হচ্ছে শেষোক্ত বাসিন্দা।

আমিনুল্লা চা না খেলেও, প্রফেসরের থেকে পাওয়া সিগারেট ধরিয়েছেন সযত্নে। তারপর এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলতে শুরু করে, - " আমার কাছে আপনি সব পাবেন স্যার। "সব মানে? " অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন প্রফেসর। " ফিরোজ শাহ কা মন্ পসন্দ, বেহেতরিন আতর, হুমায়ুন কা পাক কুরান শরীফ, সম্রাট আকবরের পসন্দিদা খঞ্জর, অউর ভি বহুত সারি নায়াব জিনিস, হামি আমার গরীব খানায় সাজাকে রেক্কেছি" লোকটা বলে কি? পাগল না ফেরেব্বাজ? মনের মধ্যে এই দুটো সম্ভাবনার কথা তখন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রফেসর সোমের মনে।

লোকটা মনে হয়, মনের কথা পড়তে জানে। কারন যে সময় প্রফেসর সোম, আমিনুল্লার কথা গুলি ভেবে দেখছিলেন সে হঠাৎ বলে ওঠে -
" আপনি স্যার আমাকে অবিশ্বাস করছেন তাইনা? ভাবছেন বানিয়ে বানিয়ে এইসব কথা বলে আপনার পকেট ফাকা করার চেষ্টা করছি আমি? সাহেব আপনারা ভদ্রলোক, বহুত পড়া- লিক্ষা আদমি আছেন। আপনারা কিনা আমার মোতো গরীব জাহিল ইনসান কে এতো নিচ ভাবছেন?

সত্যিই তো। প্রফেসরের মনে পড়ে, একথাই তো তিনি ভাবছিলেন, তার তো এটাই মনে হয়েছিল, " যা বলছে আমিনুল্লা, তার মধ্যে সত্যি নেই। হয়তো, এভাবেই ভুল ভুলাইয়ার পাশে, আসন্ন সন্ধ্যের অন্ধকারে একটা মুখরোচক গল্পের জন্ম দিতে চলেছে আমিনুল্লা। এ সমস্ত গল্প শুনিয়ে প্রফেসর সোমের মত লোক কে বোকা বানিয়ে কিই বা লাভ হবে তার।

আবার কথা বলে আমিনুল্লা, "যদি আপনি আমার সঙ্গে একটু কষ্ট করে আমার গরীবখানায় আসেন স্যার! তাহলে আমি আপনাকে আমার ওই অমুল্য সংগ্রহ দেখাতে পারি।" প্রফেসর ভাবেন, বিদেশ বিভুঁইতে দাড়িয়ে এমন অজ্ঞাতকুলশীল অদ্ভুত লোকের বাড়িতে যাওয়া কি নিরাপদ হবে?
চিরদিনই ডানপিটে রুস্তম ধরনের মানুষ সোম। ভয় বস্তুটির সাথে পরিচিতি প্রায় নেই বললেই চলে। এই জীবনে কম দুঃসাহসিক অভিযানে তিনি বের হননি। এমন পরিস্থিতিতে কাজ করেছেন, সাধারণ লোক যা করার আগে ভয়ে অন্তত দশবার ভাববে। স্মিত হেসে প্রফেসর বলেন, তবে চলুন, আপনার বাড়ি যাবো। কিন্তু কতদুর যেতে হবে। টাঙ্গা কিংবা রিক্সা নিয়ে নিলেই ভালো হয় কি?

লোকটি সম্মতি জানায়। হাত তুলে একটা টাঙ্গাকে থামিয়ে দেন প্রফেসর। তারপর বলেন কোথায় যেতে হবে আমিনুল্লা? আমিনুল্লা বলে, " হজরতগঞ্জ। " টাঙ্গা এগিয়ে চলে হজরতগঞ্জের উদ্দেশ্যে।

টাঙ্গায় করে হজরতগঞ্জ পৌছে, প্রফেসর এবং আমিনুল্লা যখন টাঙ্গা থেকে নামলেন তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে, রাতের পথে সরে এসেছে অনেকটাই৷
ওই এলাকার মানুষজন, দিনান্তের ক্লান্তি বুকে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরেছে। কয়েকটা পানওয়ারি আর ঘুমটি চায়ের দোকানে এখনো থিকি থিকি মাছির মত যেন ঘোরাফেরা করছে স্থানীয় মানুষজন । এখানে ওখানে ছোট ছোট আগুন জ্বেলে, গোল হয়ে বসে পা সেঁকছে একদল দিন মজুর। যেমনটি হয়ে থাকে আর কি, বস্তি ঘেঁরা ঘিঞ্জি পল্লি বাজার। এই বস্তিতে বেহারি মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের আধিক্য রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই দিনমজুরি অথবা সাইকেলের পাংচার সারানোর মিস্ত্রী মজুরের কাজ করেন। সেই বাজারেই হাঁটতে হাঁটতে, তারা একটি একতলা ছোট বাড়ির সামনে এস দাঁড়ালেন। বাড়ির সামনেটায় সেখানে যেন থমকে আছে শেষ সন্ধ্যার কুয়াশা। এই সন্ধ্যা রাতেও যেন সেখানে মাঝরাতের নিরবতা নেমে এসেছে, তার অতি প্রাচীন নৈরাশ্যের ঘন অন্ধকার চাদরে মুখ ঢেকে।

স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে আমিনুল্লা বলে ওঠে, - " খুশামদিদ্ সাহিব খুশামদিদ্.... !! আইয়ে, য়ে গরীবের গরীবখানায় আপনাকে খুশামদিদ সাহিব! " ধীর পায়ে আমিনুল্লাকে অনুসরণ করে, বাড়ি টা তে প্রবেশ করলেন প্রফেসর সোম। বাড়িটিতে দু-খানি মাত্র ঘর।তার মধ্যে একটিতে সংশোধনাগারের ন্যায় কিছুটা নীচু এবং ছোট দরজা বানানো । সে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমিনুল্লা, প্রফেসর কে বললেন,
" স্যার! আপনাকে একটু মাথাটা নীচু করে এই ঘরে আসতে হবে, এই খানেই আমি আমার অতি কষ্টে সংগ্রহ করা যত্নের সম্পত্তি গুলো সাজিয়ে রেখেছি সযত্নে। পার্টির সাথে কথাবার্তা চলছে, সব মিলিয়ে ওরা ষাট লাখ দেবে বলেছে। হামি দরদাম করছি.. আর আশি লাখ টাকা পেলে হামি আমার এই যত্নে জমানো সব এগজিবিট গুলো আমি পার্টিকে বিক্রি করে দেবো।

" সেকি?...!!" প্রফেসর অবাক হন, এমন কিই বা পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পন্ন জিনিস রয়েছে ওর কাছে??? যার জন্য কিনা কেউ ষাট লক্ষ টাকা অফার করবে? তার ছিম ছাম সাজানো ঘর দেখে মনে হচ্ছে, এখানে অসম্ভব কিছু থাকলেও থাকতে পারে। "এই দেখুন স্যার! "
বলে, একটা বড় ড্রয়ার টেনে বের করে প্রফেসরের সামনে মেলে ধরে, প্রাচীন দুর্মুল্য ঐতিহাসিক বস্তু খন্ডের বেশ কয়েকটি নিদর্শন।

প্রফেসর সোমের চোখ কপালে ওঠে, ড্রয়ার জুড়ে, অতন্ত পরিপাটি করে গোছানো, বিভিন্ন ধরনের বস্তু। আমিনুল্লা ধীরে ধীরে দেখাতে শুরু করে প্রত্যেক টা জিনিস, " এই দেখুন স্যার, ফারুক শায়রে ব্যাক্তিগত ব্যাবহারের ছুরি! " - বলে একটা মাঝারি মাপের, সোনার আরবি অক্ষরের আদলে নক্সা করা একটি ছুরির দিকে ইঙ্গিত করে আমিনুল্লা। প্রফেসর সোম অবাক হয়ে যান। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষের দিকে সাথে ফারুক শায়রের নাম জড়িয়ে আছে, অনেকে বলে থাকেন, এই ফারুক শায়রের অকর্মণ্যতাই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেছিল। সেই ফারুক শায়রের ব্যাবহৃত ছুরিকা? সত্যি নাকি বানানো? অবাক হতে হয় প্রফেসর কে।

এরপর একে একে - ঔরঙ্গজেবের নিজের হাতে লেখা কোরানের পুঁথির প্রতিলিপি, আকবরের ব্যাবহৃত চামড়ার জুতো, ছোট কষ্টি পাথরে দেব মুর্ত্যি, সাধারণ পাথরের মসৃণ নিপুণ কারুকার্য সমন্বিত প্রাচীন নবগ্রহ প্লেট ইত্যাদি আরও বেশ কয়েকটি দুর্মুল্য বস্তু , প্রাচীন সংস্কৃত, প্রাকৃত ভাষার চারটি পুঁথি... হা ঈশ্বর...!!! এবার সত্যি সত্যি চমকে উঠতে হয় প্রফেসর সোম কে। এসব যদি বাস্তব হয়, যে কোন যাদুঘর কিনতে চাইবে এসব, ওই ছোট্ট পুঁথিটির দাম যে কত লক্ষ টাকা হবে তার ঠিক নেই। তার মত ইতিহাস পিপাসু ঐতিহাসিক দের কাছে এসব কিছুর গুরুত্ব হবে অপরিসীম। একের পর এক দ্রষ্টব্য দেখাতে থাকে আমিনুল্লা। তখনও স্তব্ধ বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেছেন সোম। তার চোখের সামনে একে একে খুলে যাচ্ছে , অমুল্য ঐতিহাসিক রত্নভান্ডার গুলি। তার চোখে মুখে ক্রমশ ফুটে উঠছে অনন্ত বিস্ময় আর আশ্চর্য অহমিকার চিহ্ন।

( ক্রমশ )

Coin Marketplace

STEEM 0.18
TRX 0.13
JST 0.029
BTC 57258.35
ETH 3065.68
USDT 1.00
SBD 2.33