( পর্ব এক )★প্রোফেসর সোম ও তার  রহস্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা★ সিরিজ ।। [ 10% for shy-fox bro ]

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

অনেক দিন পর শুরু করছি আবার একটা ঐতিহাসিক এবং ভুতুড়ে সিরিজ। সবাই কেমন লাগছে, কেমন হচ্ছে অবশ্যই জানাবেন। আপনাদের আশীর্বাদ আর তুল্য মুল্য সমালোচনায় আমার এই তস্য খাজা লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।


image.png
image source

তখন সবেমাত্র ভুল ভুলাইয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে শেষ বিকেলের ম্লান রক্তিম আভা। গোধুলির আলো-আঁধারির ধুসর ছায়া মন্ডপের কাল বেলায়, সেই চিরপ্রাচীন সাক্ষীর ন্যায়, নিরুত্তাপ উদাসীনতাকে ভিত্তি করে, ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, এই মস্ত ভুলভুলাইয়া'। প্রায় ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ, তৎকালীন আওধ প্রদেশ অর্থাৎ লক্ষ্ণৌ এর বিলাসী নবাব আসফ উদ্দৌল্যা প্রতিষ্ঠা করান এই বিশাল বড় ইমামবাড়া ও তদ্ সহ এই আশ্চর্য ভুল ভুলাইয়ার। প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতা ও ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট মুল স্থাপত্য ও সেই সংলগ্ন সুবিশাল ভ্রান্তিদুর্গ বস ভুলভুলাইয়াটি অবলীলায় আকৃষ্ট করে আঠারো থেকে আশির সব পর্যটককেই। প্রায় হাজার খানেক সংকীর্ণ সুদীর্ঘ অন্ধকার গলিপথ। প্রায় পাঁচশো খানা অনুরুপ দর্শন দরজা, যা অতিসহজেই ভ্রমনকারীর মানসপটে ভ্রান্তির জাল বুনে ফেলতে পারে।

নভেম্বরের শান্ত শীতল বিষন্নতায় ঢাকা একটি সন্ধ্যে। পাতলা কুয়াশার চাদরে আবৃত হয়ে রয়েছে চারপাশ টা। টুরিস্টরা যারা এসে ছিলেন, তাঁরাও এতক্ষণে ফিরতি টাঙ্গায় সওয়ার হয়ে রওনা দিয়েছেন হোটেলের পথে। আরও একটি কর্মমুখর দিন অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্যে। তবুও, এখনো সেখান থেকে ফিরে যেতে পারেন নি প্রফেসর সোম। প্রফেসর সোমের পুরো নাম শ্রী কালিকাপ্রসাদ সোম। কিন্তু প্রফেসর সোম নামেই তিনি এখন পর্যন্ত সর্বিজিন বিদিত। ভদ্রলোক চিরকালই এভাবেই এক ঐতিহাসিক জায়গা থেকে আরেক ঐতিহাসিক জায়গায় ভ্রমণ করে বেড়ান।

কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক প্রোফেসর সোম মানুষটি তার ছাত্র ও সহকর্মী মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার বহু কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম হল, ইতিহাস বিষয়টির ওপর ভদ্রলোকের অসাধারণ দক্ষতা ও নিষ্ঠা। যা তার হৃদয়স্পর্শী বাগ্মিতা ও সদব্যাবহারের গুনে তার চরিত্রকে করে তুলেছে, সর্বজনবিদিত। শুধু পড়াতে হয় বলে পড়ান না, আসলে ইতিহাস পড়ানো টা বা ইতিহাসের বিভিন্ন স্তর নিয়ে চর্চা আলাপ-আলোচনা করাটা তাঁর একটা আশ্চর্য অবসেশন।

এই ইতিহাসচর্চার নেশা তাকে, টেনে নিয়ে গিয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। পৃথিবীর যেখানে যেখানে অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছে অতীত, তাদের মূক মুখে শব্দ ফোটানোর দ্বায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় নিয়েছেন। তাই তাকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, আজ এখানে, কাল ওখানে, পড়শু অন্য কোন খানে। হাজারদুয়ারি, পান্ডুয়া, প্রাচীন আদিনাথ মন্দির, গোলকুন্ডা অথবা বিজাপুর দূর্গ, অজন্তা-ইলোরা। সবখানেই অবাধ গতিবিধি তার।

গত তিন দশক ধরে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়াচ্ছেন প্রোফেসর সোম। বয়স ষাটের দোরগোড়ায় ছুয়েঁছে, বেশ কিছু দিন হল। এই বৃদ্ধ শরীরেও চঞ্চল কর্মদক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। বিয়ে থা করেন নি। যেটুকু সময় পান, প্রত্ন-অতীতের অনুসন্ধানে মগ্ন থাকেন। তার স্মৃতিসত্ত্বায় সর্বদা খেলা করে ফেলে আসা অতীত। যেসব মানুষেরা চিরদিনের জন্য এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছেন, যেসব প্রাচীন স্থাপত্যের পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া একেক টি প্রাচীন অধ্যায়, সেইসব স্মৃতি ভেসে ওঠে অধ্যাপক কালিকাপ্রসাদ সোমের কলমে।

বিভিন্ন ন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল হিস্ট্রি জার্নালে, প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের বিভিন্ন অজানা অধ্যায় সম্বন্ধে ভারী-ভারী প্রবন্ধ লেখেন অধ্যাপক। একজন সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে যথেষ্ট সন্মান আছে তার। তার লেখার চুলচেতা বিশ্লেষণ চলে, সমালোচকেরা কলম ছুটিয়ে দেন। কফি হাউসে তার মতামত নিয়ে তর্কে মাতে ইতিহাস প্রেমীরা।

কিন্তু অধ্যাপক নির্বিকার। তার এসবে যায় আসে না। তিনি জানেন, যতদিন তিনি এইভাবে সচল রাখতে পারবেন তার চিন্তা চেতনা কে। ততদিন একটির পর একটি প্রবন্ধের জন্ম হবে তার সোনার কলমে। তাইতো আগের থেকে, এখন আরও বেশি অনিসন্ধিৎসু হয়ে উঠেছেন তিনি। শিক্ষার শেষ নেই। এই সদা স্নেহময়ী ধরিত্রী মাতৃকা, তার স্নেহের আচলের ধুলীমলীন ছায়ায় লুকিয়ে রেখেছেন যত রহস্য ইতিহাস, বাগদেবীর আরাধনায় তা এক এক করে উন্মোচন করতে চান সোম। যতদিন শরীরে শক্তি থাকবে, এবং মন থাকবে পিপাসু, ততদিন এই প্রত্ন অতীতের বুকে একের পর এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে যাবেন তিনি।

লোকটা যেন অন্ধকারের কুয়াশা ফুঁড়ে এসে দাঁড়ালো তার সামনে। শরীরে দারিদ্রতার চিহ্ন স্পষ্ট। লোকটির পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি, গায়ে আধছেঁড়া জ্যাকেট যার ভেতরের কালো গেঞ্জিটাও দেখা যাচ্ছে। তবে লোকটির চোখ গুলো সত্যিই অদ্ভুত! কোটরাগত সেই অক্ষিগোলকের দর্পনে যেন সবজেটে অর্ধস্বচ্ছ শ্যাওলার আস্তরণ ছড়িয়েছে। অসহ্য উদাসীনতা আবরণে আবরিত অসম্ভব নিস্তেজ সেই চোখদুটি। খুব অস্বস্তিকর শীতল দৃষ্টিতে মুখের দিকে চেয়ে থাকে লোকটা।

লোকটি কে? গাইড নাকি ? এখন তো গাইডের চেহারা এমন হয় না? উত্তরপ্রদেশ গভর্নমেন্ট সম্প্রতি এক কঠিন নিয়ম প্রবর্তন করেছেন। প্রতিটি গাইড কে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে হবে। গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে আইডেন্টিটি কার্ড। যেন কোন মানুষ অযথা ঠকে যেতে না পারে।
কিন্তু, এই লোকটি কে?

লোকটি খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রফেসর সোমের সামনে এসে দাঁড়ালো, খক্ খক্ করে একটু কেশে নিয়ে, ফ্যাসফ্যাসে ভাঙা ভাঙা গলায় অথচ ধারালো ধাঁচে তার কাঁপতে থাকা শীর্ণ হাতটি তুলে সেলাম জানিয়ে বলল - " সেলাম সাহেব!! বন্দে কা নাম আমিনুল্লা আছে।
আপনাকে দেখে তো বঙ্গালী বাবু মালুম হচ্ছে।" প্রফেসর সোম, মুখে পাইপটা নিয়ে কিছুক্ষণ নিশব্দে ধোঁওয়া ছাড়তে ছাঁড়তে আমিনুল্লাকে নিরীক্ষণ করে বলল- " কে ভাই তুমি? তুমি কি গাইড? নাকি সাধারণ স্থানীয় ব্যাক্তি ? " লোকটি হেসে ওঠে। তার হাসিতে মলিনতার ছাপ রয়েছে। ক্লেশের ছাপ স্পষ্ট।

সে হাসতে হাসতে বলল, " হামি গাইড লয় সাহেব... টুরিস্টও লয়... এক ওয়াক্ত তক এস্থানীয় ছিলাম, কিন্তু এখোন তাও নাই.. আমি সির্ফ এই ভুলভুলাইয়ার এক ভটকা হুয়া আত্মা আছি" বলেই হো হো করে গুটখা খাওয়া নোংরা লাল্টে দাঁত বের করে হাসতে থাকে। কালিকাবাবু বুঝলেন, আমিনুল্লা পাকা লোক। নিটোল একটা গল্পের পটভূমি এখন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে চলেছে। অভিজ্ঞ মানুষ তিনি, ভূপর্যটকও বলা যেতে পারে। তিনি জানেন, এভাবেই আপাত অকিঞ্চিৎকর কোন বস্তু বা বিষয় হয়ে ওঠে অত্যন্ত দুর্মূল্য।

এভাবেই বছর দেড়েক আগে এই অক্টোবরের সময়ে, বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম এর ইতিহাস নিয়ে প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্যে, তথ্য সংগ্রহ করতে প্রফেসর সোম গিয়েছিলেন সিকিমের অন্যতম বিখ্যাত এবং প্রাচীন পেমাইয়াংসে বৌদ্ধ মঠে। তিব্বতি বজ্রযানী নিংমা সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান এই মঠ। এই মঠে ঘুরতে ঘুরতেই তার আলাপ হয়েছিল, বৃদ্ধ ভিক্ষু লামা রিয়াং সেংতেন এর সাথে। বয়সের ভারে, একেবারেই নুব্জ সেই অশীতিপর বৃদ্ধর চোখে আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করেছিলেন।

তারপর, ঐ মানুষ টির সাথে কাটিয়েছিলেন সাত সাতটি দিন। মঠের চৌহদ্দির মাঝে স্থাপিত বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মের প্রাণপুরুষ গুরু পদ্মসম্ভব বা গুরু রিং পো চে- এর বিশাল প্রতিমার পাদদেশে বসে টেপবন্দী করেছিলেন তার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, এবং সেই অভিজ্ঞতার নিরিখে ঘটে যাওয়া বজ্রযানী ইতিহাসে খুঁটিনাটি। ওই একজনের সাক্ষাৎকার নিয়েই, প্রফেসর তার যাবতীয় আকাঙখিত তথ্য সমুহ পেয়ে গিয়েছিলেন। প্রত্যেক টা কথা প্রোফেসর সোম, প্রামাণ্য বই ঘেঁটে মিলিয়েছিলেন তিনি। প্রত্যেকটা তথ্য, সন, দিন একেবারে সঠিক বলেছিলেন সেই অশীতিপর বৃদ্ধ।

বলাই বাহুল্য, সেই বৃদ্ধ জ্ঞানী পুরুষের কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যাবহারের প্রয়োজন ছিলনা। তাই পরবর্তীতে নিয়মিত পত্রের মাধ্যমেই যোগাযোগ রাখতেন প্রফেসর। এই মাস তিনেক আগে, সেই বৌদ্ধ মঠের তরফেই ফোনে, ওই বৃদ্ধ ভিক্ষুর প্রয়াণ সংবাদ পান তিনি। তারপর থেকেই প্রোফেসর সোম, কোন ঐতিহাসিক স্থানে গেলে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে খোঁজ করেন এমন কারও, যে মানুষটি হবে অসংখ্য ঐতিহাসিক সম্ভার, ঠিক সেই প্রণম বৃদ্ধ জ্ঞানী পুরুষ রিয়াং সেংতেন এর মত।

এই লোকটাকে দেখে যদিও তেমন বিশেষ কিছু মনে হয় না, তবে চোখ গুলো অদ্ভুত। বীভৎস ঠান্ডা অস্বস্তিকর ঘোলাটে দৃষ্টি লোকটার, তার সাথে চতুর ধারালো কথাবার্তা, লোকটার কিছু বিশেষত্বের পরিচয় দেয়। এর থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া নাও যেতে পারে। তাও বাজিয়ে দেখতে দোষ কোথায়। হতেও তো পারে, ভুলভুলাইয়ার বুকে ভেসে বেড়ানো এই লোকটির থেকে তিনি জানতে পারলেন, রোমাঞ্চকর কোনো তথ্য!!

( ক্রমশ )

Coin Marketplace

STEEM 0.18
TRX 0.13
JST 0.028
BTC 57666.58
ETH 3076.03
USDT 1.00
SBD 2.28