আমার সিকিম ভ্রমণ । চতুর্থ পর্ব । ( ১০% বেনিফিশারি প্রিয় @shy-fox ভাইকে )

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago

তৃতীয় পর্বের লিঙ্ক source

ভ্রমি বিশ্বয়ে আমি ভ্রমি বিশ্বয়ে !
আর কি বলা যায় একে ! একে তো আগের দিন প্রচন্ড খাওয়া দাওয়া করেছি রাতে সাথে সারা দিনের ধকল, বিছানায় শুয়েই সোজা নাক ডাকতে শুরু করেছিলাম। ড্রাইভার সাড়ে চারটে নাগাদ দেখি এসে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করেছে, ওওওওওওও সাবজিইইইই, উঠযাউউউ বেশ একটা সুর করে দরজায় ধাক্কা ধাক্কি করছে। বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকল সকালের হালকা আলো আর এক ঝলক টাটকা ঠান্ডা বাতাস। আহা এই শীতের হাওয়া লাগলে কার মনে আনন্দ জাগবে না বলুন। বাকি দুজন অঘোরে ঘুমোচ্ছিল, ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা মুখে যেতেই তারাও পিটপিটিয়ে চোখ খুলল।

image.png

সবাই মিলে ফ্রেশ হয়ে যখন কিচেনে এলাম তখন ৫টা বেজে গেছে, গত রাতে টায়ার্ডনেস এবং অন্ধকারের জন্য সেরকম কিছুই দেখিনি কিচেনটা। আজ দেখলাম বিরাট লম্বা একটা হলঘরের একদিকে বসার যায়গা এক কোনাতে অফিস এবং একটা প্যাসেজের ভেতর কিচেন। সকাল সকাল গরম দার্জিলিং চা আর সাথে কুকিজ, তারপরসোজা ওভেন থেকে নামানো ম্যাগি আবার এক রাউন্ড চা বা কফি। আহা। স্বর্গও বুঝি মাঝে মাঝে মর্তে নেমে আসে। এইসব খেয়ে যখন সবাই মিলে ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে বেরোলাম তখন পৌঁনে ৬টা।

সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ একটা, দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে হিমালয়। মেঘ কুয়াশার খেলা তো অনবরত লেগেই আছে। ঠান্ডা পাথুরে বরফ ঠান্ডা একটা হিমেল হাওয়া বইছে। তখনও সূর্য দেবের দেখা নেই তবে উঠি উঠি করছেন তিনি। মিনিট পাঁচেক হাটার পর পৌঁছালাম সেই অভীষ্টে। আহা কি দেখিলাম জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না !!

সামনে আদিগন্ত কয়েক হাজার ফুটের গিরিখাত, আর খাতের তিনদিকে তিনটি সুউচ্চ পাহাড় সোজা উঠে গেছে আকাশ্চুম্বী হয়ে। মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে ধেয়ে এলো ঘন কুয়াশার দল, থতমত খেতে খেতেই সেটা উঠে দিকশুন্যপানে। আবার ঠান্ডা হাওয়া অথবা ভারি মেঘের দলের হুটোপুটি মাথা মুখ গা জড়িয়ে জড়িয়ে।
যখন কলেজে পড়তাম তখন আমার একজন প্রফেসর ছিলেন, তিনি প্রফেসর হলেও ছবি তোলার ব্যাপারে জগত জোড়া নাম করেছেন, আমাদের একটা কথা বলেছিলেন, সেটা আজো মাথায় গেঁথে আছে, তখন বুঝিনি কিন্তু সেদিন ঐ সুউচ্চ হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে স্যারকে প্রণাম করেছিলাম, আশীর্বাদ চেয়েছিলাম। স্যার বলেছিলেন দুনিয়ার এমন কোন ক্যামেরা নেই যা হিমালয়ের সৌন্দর্যকে কয়েকটা ছবি বা ভিডিওর মধ্যে বন্দী করতে পারবে, আক্ষরিক অর্থেই তাই, যে দিকে ক্যামেরা ঘোরাচ্ছি মনে হচ্ছে তার পাশের যায়গাটা আরো বেশি ভালো, র‍্যানডম ছবি তুলছি আর আনন্দে পাগলের মত এদিক ওদিক করছি, সুমন দেখলাম একবার ক্যামেরা বন্ধ করে চুপ করে বরফ কুচি ছড়ানো ঘাস জমির ওপর শুয়ে পড়লো। আমার বান্ধবী বৈশাখী তিনিও আনন্দে দু হাত ছড়িয়ে এদিক ওদিক দোউড়াচ্ছেন।

image.png

পাইন ফার আর নাম না জানা পাথরের ফাঁকে ফাঁকে হাজার লক্ষ্য ফুলের সম্ভার। আহা মুহূর্ত গুলো যেন চোখের পলকে পলকে শেষ হয়ে যাচ্ছে যেন। এমন সময় সূর্যদেব দেখা দিলেন। দুই পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে কোথায় ঘাপটি মেরে আছেন কেউ যানে না। পলকে দেখা দিয়েই আমার মিলিয়ে গেল ।

কিছু পরেই আবার তার দেখা মিললো, রাঙ্গা কুসুমের মত রং, প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত বড়ই সুন্দর। বড়ই খামখেয়ালি । এতক্ষন আমরা কেউই খেয়াল করিনি ড্রাইভার ছেলেটি আমাদের সাথেই ছিল। সে হঠাত আযাইয়ে আযাইয়ে করে চিতকার করতেই খেয়াল হলো একটা ভারী কালো মেঘ ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। কি হল বুঝে ওঠার আগেই বরফ ঠান্ডা হাওয়া শেষ হয়ে জোলো হাওয়া এসে লাগলো চোখে মুখে। ড্রাইভার ছেলেটি মেঘটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল এটা বর্ষার মেঘ, এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে , আর পাহাড়ের বৃষ্টি ভয়ংকর, অভ্যেস না থাকলে মুহূর্তের মধ্যে জ্বরে পড়বো আমরা, বলাই বাহুল্য আমাদের কারোরই আসার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়েই পাহাড়ি রাস্তা ধরলাম। কটেজের কাছাকাছি আসতেই দেখি পাইনের মাথা গুলো দুলতে শুরু হয়েছে, মুহূর্তে আকাশ কালো হয়ে ভয়ংকর ঠান্ডা একটা জোলো বাতাস ঘিরে ধরলো আমাদের সবাইকে। কটেজের মালিক যিনি ছিলেন তিনিও বললেন ভাগ্যিস ফিরেছি নাহলে পাহাড়ি রাস্তায় ল্যান্ড স্লাইড যে কোন সময় হতে পারে সাথে শারীরিক অসুস্থতাও হবার ফুল চান্স, কাজেই আমরা বিফল মনোরথ হয়ে কটেজের কিচেনে বসলাম, জানালা দিয়ে দেখলাম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, মিনিট পাঁচ আগেই যে মাঠের মধ্যে হাজার খানেক পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেগুলো একটাও নেই, বরং বৃষ্টির ফোঁটা আর সাথে ছোট ছোট বরফের টুকরো শশব্দে কটেজের মাথায় দুমদাম আওয়াজ করছে। ভয়ঙ্কর পাহাড়ি বৃষ্টি, বৃষ্টি যখন থামলো তখন ঘরিতে সকাল ৯টা, হিসেব করে দেখলাম প্রায় ঘন্টা দুয়েক বৃষ্টি হয়েছে, যদিও কোথাও জল জমার ব্যাপার নেই, পাহাড়ি ঢাল বেয়ে জল চলে গেছে অনেক নীচে তিস্তা তোস্তা মহানদী হয়ে গাঙ্গেয় উপত্যকায়।

বৃষ্টি থামার পর ব্রেকফাস্ট করে বেরোলাম সকাল ১০ টা নাগাদ, আমাদের প্ল্যান ছিল সেদিনই ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়বো অন্য একটা যায়গার উদ্দেশ্যে কিন্তু রাস্তা পিছল হবার জন্য ড্রাইভার বলল ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করতে হবে। কাজেই ব্রেকফাস্ট করে আমরা আবার বেরোলাম হাঁটা হাটির উদ্দেশ্যে, মাত্র ৩০ মিনিট আগের অঝোর বৃষ্টি কিন্তু কোথাও লেশ্মাত্র নেই, গাছের পাতা গুলো সবুজ , অদ্ভুত একটা মন কেমন গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে, পাখিগুলো আবার ফিরে এসেছে, পাহাড়ি ঢাল বেয়ে দু এক জনকে দেখলাম বিরাট বড় ঝোলা নিয়ে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছেন ধীর পায়ে, এদিক ওদিক ঘুরে দেদার ছবি তুলে আমরা ফিরলাম ১২টা নাগাদ। ততক্ষনে এত হাটার জন্য পেট খিদেই চুঁই চুঁই করছে, গরম গরম ডাল ভাত আর চিকেন খাবার পর একটু সময় নিলাম খাবার টুকু হজম হবার জন্য, ততক্ষনে ড্রাইভার রেডি পরের গন্তব্যের জন্য। বৈশাখী জিজ্ঞেস করলো এবার কোথায় যাব, ড্রাইভার মুচকি হাসিতে জানালো সেটাও সারপ্রাইজ। তবে যেতে ঘন্টা ৬ সময় লাগবে, বেলা ১টার মধ্যে না বেরোতে পারলে পৌঁছাতে পারবো না। আর পাহাড়ি রাস্তায় সন্ধ্যের পর গাড়ী চালানো রিস্কি। অতএব আমরাও ঝোলা কাঁধে ফেলে কটেজের দক্ষিনা মিটিয়ে দিয়ে চেপে বসলাম গাড়িতে। ড্রাইভারও শুরু করলো তার গন্তব্য। পথের বর্ণনা আর নাইবা দিলাম। যেদিকে চোখ রাখি সেদিকেই নতুন কিছু, অপার বিশ্বয়ে শুধু তাকিয়ে দেখতে দেখতে পোউছালাম পরের গন্তব্যে, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে পার, সাড়ে ছটা।

image.png

( চলবে )

Sort:  
 3 years ago 

আপনার সিকিম ভ্রমণ খুব সুন্দর ভাবে আমাদের মাঝে স্থাপন করেছেন । পাহাড় ঘেরা এই সিকিমের ছবিগুলো অসাধারণ লেগেছে আমার। পাহাড় আর মেঘের খেলা খুব অসাধারণ। তবে দাদা এই ধরনের পোস্টে ফটোগ্রাফিতে w3w লোকেশন ব্যবহার করলে পোস্ট আরো ভালো হয়। আপনার পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। ধন্যবাদ এত সুন্দর ভ্রমণ কাহিনী আমাদের মাঝে তুলে ধরার জন্য।

Coin Marketplace

STEEM 0.16
TRX 0.15
JST 0.027
BTC 59944.92
ETH 2307.28
USDT 1.00
SBD 2.48