দুর্ধর্ষ গেরিলাদের দুঃসাহসিক অভিযান (তৃতীয় পর্ব)। ১০% সাইফক্স।
পূর্ববর্তী পর্বের-লিংক
বেলা বারোটা নাগাদ সবাই এসে উপস্থিত হলো। আমজাদের পরিকল্পনা ছিল তিনটার দিকে চেকপোস্ট দুটো আক্রমণ করার। যার ফলে হাতে এখনো বেশ খানিকটা সময় আছে। তাই সে সকলের সাথে বসে আবার প্ল্যানটা আলোচনা করে নিলো। শেষ মুহূর্তে এসে কোনো রকমের ভুল যেন না হয়। সেজন্য সবাইকে যার যার দায়িত্ব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো।
আর সবাইকে বললো সবার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রাখতে হবে। পাক আর্মিরা যেন কোনো কিছু সন্দেহ না করতে পারে। সাথে বাচ্চাগুলো কেও আবার মনে করিয়ে দিল তাদেরকে কি করতে হবে। এর ভিতর দলের একজন আমজাদকে পরামর্শ দিল যে বাচ্চাগুলোর ঘাড়ে ব্যাগ দেয়ার দরকার নেই। কারণ ব্যাগ দেখলে পাকিস্তানি আর্মি সন্দেহ করতে পারে। তখন ব্যাগ চেক করতে পারে।
তখন আমজাদ তাকে জিজ্ঞেস করলো তাহলে অস্ত্রগুলো কিভাবে নেয়া যায়? তখন সেই লোকটি বলল আমরা কৌশলে বাচ্চাদের গায়ের সাথে গামছা দিয়ে বেঁধে তার ভেতরে গ্রেনেড রেখে দেবো। উপরে বাচ্চারা শার্ট গায়ে দেয়া থাকবে। যার ফলে বাইরে থেকে কিছু বোঝা যাবেনা। এই আইডিয়াটা আমজাদের খুব পছন্দ হলো। তবে আমজাদ ঠিক করে রেখেছে প্রতিটা বাচ্চার কাছে চারটা গ্রেনেড থাকবে। সাথে একটা করে পিস্তল ও থাকবে। কারণ আমজাদ চিন্তা করে দেখেছে যদি গ্রেনেডের আঘাতে সবাই মারা না যায় তখন তারা পিস্তল ব্যবহার করবে।
এর ভেতরে আমজাদ দলের আরেকজন কে বলল লাশের ব্যবস্থা হয়েছে নাকি? সে জানালো দুইটার ভেতর লাশ এখানে পৌঁছে যাবে। এলাকার কয়েকটি যুবককে লাশ আনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমজাদ তাকে জিজ্ঞেস করলো সেই ছেলেগুলো কি জানে আমরা কি করতে যাচ্ছি? সে জানালো না তারা কিছুই জানে না। আমজাদ তখন বলল তাহলে ঠিক আছে।
দুইটার দিকে এলাকার কয়েকটি ছেলে একটি লাশ নিয়ে উপস্থিত হোলো। লাশ থেকে ব্যাপক দুর্গন্ধ আসছিলো। লাশের গন্ধে সবাই নাকে রুমাল চাপা দিলো। আমজাদ মনে মনে খুশি হল ও যেমনটা চেয়েছিল লাশটা ঠিক তেমনই হয়েছে। তারপর ওরা সবাই তৈরি হতে লাগলো। লাশ বহন করার খাটিয়া আগে থেকেই এনে রাখা ছিলো।
তিনটা বাজার ৩০ মিনিট আগে ওরা দুটি দলে ভাগ হয়ে রওনা দিলো। আর ব্যাকআপ হিসেবে যে চারজনের থাকার কথা ছিল তারা আগেই তাদের অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছে। দুটি দলই রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে গাছের ওপর উঠে চেকপোস্ট গুলিকে নিশানা বানিয়েছে। তাদেরকে আমজাদ বারবার করে বলে দিয়েছে। তারা যেন আগে থেকে গুলি না করে। যদি তাদের অপারেশন সফল না হয় তাহলেই যেন তারা গুলি করে।
আমজাদ তার দল নিয়ে আস্তে আস্তে করে প্রথম চেকপোস্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে খেয়াল করে দেখেছে দলের সবাই কিছুটা অস্থির হয়ে আছে। সে চোখে ইশারায় সবাইকে স্বাভাবিক থাকতে বললো। যদিও তার নিজের ভেতরেও এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছে। কিন্তু সেটা তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। তারা চারজন বাচ্চাদের সাথে গল্প করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। চেকপোস্টের কাছে পৌঁছানোর মাত্রই পাকিস্তানি আর্মিদের তীক্ষ্ণ চিৎকারে তারা সবাই থেমে গেলো।
তারপর তারা দেখল চেকপোস্টের ভেতর থেকে দুজন পাকিস্তানি আর্মি বের হয়ে এসেছে। তারা এসে আমজাদ এবং তার বাকি ৩ সঙ্গীকে চেক করলো। একজন পাক আর্মি বাচ্চাদেরকেও চেক করার কথা বলল। কিন্তু অপর পাক আর্মি ইশারায় তাকে মানা করলো। বলল এই ছোট বাচ্চাদের চেক করার কোন দরকার নেই।
কিন্তু এখানে একটি সমস্যা তৈরি হলো। আমজাদ চিন্তা করেছিল তাদের সবাইকে চেক করে একসাথে ছেড়ে দেবে। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মিরা একজনকে চেক করছিল আর তাকে যেতে বলছিলো। এভাবে ওরা সবাই আলাদা হয়ে পরলো। আমজাদ তখন চিন্তা করতে লাগল কিভাবে পরিকল্পনা সফল করা যায়? আমজাদ যখন সাথের বাচ্চাটাকে নিয়ে চেকপোস্ট পার হলো তখন তার মাথায় হঠাৎ করে একটি বুদ্ধি আসলো। সে বাচ্চাটাকে কানে কানে বলল তুমি রাস্তার পাশে পেশাব করতে দাঁড়িয়ে যাও। তাতে আমজাদ সেখানে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ততক্ষনে বাদবাকি লোকজনও এখানে চলে আসবে। আমজাদের কথার সাথে সাথে বাচ্চাটি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেলো।
ইতিমধ্যে চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় আমজাদ কৌশলে বাচ্চাটির কাছ থেকে গ্রেনেড এবং পিস্তল নিয়ে নিয়েছে। দলের অন্য সদস্যরা যখন চেকপোস্ট পার হচ্ছিল তখন কৌশলে যার যার অস্ত্র তার কাছে নিয়ে নিলো। যখন শেষ লোকটিকে চেক করে ছেড়ে দিয়েছিলো তখন আমজাদ তাকে চোখ ইশারায় বোঝালো আক্রমণ করতে। কারণ ওরা সবাই যখন চেকপোস্ট পার হয়ে যাবে তখন আর্মিদের নজর ওদের উপরে থাকবে।
লোকটি চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় বাচ্চাটির কাছ থেকে গ্রেনেড নিয়ে চেকপোস্টের ভিতর ছুড়ে দেয়। সাথে সাথে আমজাদরা বাকি তিনজন ও চেকপোস্টে গ্রেনেড চার্জ করে। মুহূর্তেই চেকপোস্ট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কিন্তু বিস্ফোরণের ধাক্কায় চেকপোস্টের কাছে আমজাদের দলের যে লোকটি ছিল সে গুরুতর আহত হয়। এছাড়া আরও একটি সমস্যা হয়ে গিয়েছে। সেটা তারা প্রথমে খেয়াল করেনি।
চেকপোস্টের একজন আর্মি তখনও চেকপোষ্টে ঢোকেনি পেশাব করার জন্য। সে চেকপোস্ট থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাই এই বিস্ফোরণ থেকে সে বেঁচে যায়। বেঁচে যাওয়া পাক আর্মিটি দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। তখনই আমজাদের ব্যাকআপ টিম নিখুঁতভাবে পাক আর্মিটিকে গুলি করে ফেলে দেয়।
অপারেশন শেষ হওয়ার সাথেই আমজাদ রা সবাই দৌড়ে চেকপোস্টের কাছে আসে। চেকপোস্টের কাছে দৌড়ে আসে এসে দেখে তার দলের একজন সদস্য এবং একটি বাচ্চা রাস্তার উপর গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে আছে। আমজাদরা তাড়াতাড়ি তাদেরকে নিয়ে কোন নিরাপদ জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে তাদের ব্যাকআপ টিমকে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় ট্রাক দুটির কাছে সিগন্যাল পৌঁছে দিতে যে রাস্তায় ক্লিয়ার আছে।
এর ভেতরে ঠিক একই সময়ে দ্বিতীয় দলটিও চেকপোস্ট আক্রমণ করে। তাদের তেমন কোন সমস্যা পোহাতে হয়নি। কারণ তারা লাশের খাটিয়ার সাথে একসাথেই ছিলো। লাশ থেকে প্রচন্ড দুর্গন্ধ বের হওয়ার কারণে পাকিস্তানি আর্মি লাশের কাছে আসেনি। তারা চেকপোস্ট অতিক্রম করার পর একসাথে চেকপোষ্টে আক্রমণ করে। তাদের প্রথম আক্রমণেই চেকপোষ্ট পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানে আর ব্যাকআপ টিমের প্রয়োজন হয়নি। আক্রমণ শেষ করার পরে তারা পূর্বপরিকল্পনা মত নিরাপদ জায়গায় গা ঢাকা দেয়।(চলবে)
Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power
250 SP | 500 SP | 1000 SP | 2000 SP | 5000 SP |
আপনার লেখা গেরিলাদের দুঃসাহসিক অভিযান পড়ার সময় মনে হচ্ছিল আমার নিজের চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটছে। এসব ঘটনা পড়ে নিজের মধ্যে অন্যরকম একটা শক্তি অনুভূত হয়।কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা অনেকেই জানিনা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের ভূমিকা কি ছিল।গেরিলাদের দুঃসাহসিক অভিযান সম্পর্কে আমাদের মাঝে পর্বে পর্বে তুলে ধরার জন্য আমরা অনেক কিছু জানতে পারছি। আর তার জন্য আপনাকে জানাচ্ছি অসংখ্য ধন্যবাদ। ❤️
আমি খেয়াল করে দেখেছি আমাদের এই কমিউনিটিতে সবাই বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ তেমন কিছু লেখে না। এ জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আপনাদের ভালো লাগলে আমার এই লেখা সার্থক।