ফেলে আসা জীবনের বন্ধুত্বের স্মৃতি

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago

নমস্কার,,

বন্ধু। ছোট একটা শব্দ। কিন্তু এর গভীরতা হয়তো সাগরের চাইতেও বিশাল। আমার কাছে বন্ধু মানে বিশ্বাস। আমার কাছে বন্ধু মানে অভিমানের সুর। আমার কাছে বন্ধু মানে আনন্দে খুনসুটি। আমার কাছে বন্ধু মানে শত বিপদেও কাঁধে হাত রাখা। আমার কাছে বন্ধু মানে " যা হবে তো হবে সামনে এগিয়ে চল"।

তবে এটা সত্য বন্ধু সবাই হতে পারে না। একসাথে চলাফেরা বা ঘোরাফেরা করলেও কেউ কারো বন্ধু হয়ে ওঠে না। বন্ধু সেই হতে পারে যে আমার থেকেও আমাকে বেশি জানবে এবং বুঝতে পারবে। আর সেই বন্ধুর নেই কোন বয়সের ভেদাভেদ এবং নেই কোন লিঙ্গ পার্থক্য।

sunset-1807524_1920.jpg

Source

ছোট এ জীবনে অনেক মানুষের সাথে মিশেছি। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সব কিছু মিলিয়ে অনেকের সাথে ওঠাবসা। স্কুল লাইফের বন্ধু গুলো প্রকৃতপক্ষে নিঃস্বার্থ বন্ধু হয়ে থাকে সব সময়। এদের সাথে কখনোই কারো তুলনা হয় না। পাঁচ বছর পর পর দেখা হলেও কোথায় যেন একটা শান্তি আর তৃপ্তি পাওয়া যায়। বিশ্বাসের জায়গা টা এক বিন্দু নড়চড় হয় না। আর কলেজের বন্ধুত্ব গুলো একটু পাকা পোক্ত হতে না হতেই বছর শেষে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আর ইউনিভার্সিটিতে কিছু কিছু বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যেগুলো আত্মার সাথে গেঁথে যায়। প্রয়োজনে নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রেখে দেবে।

আমি আজ ঠিক তেমনই একটা বন্ধুত্বের গল্প শেয়ার করছি। ভার্সিটি লাইফে যার শুরু। ভার্সিটি লাইফ এর শুরুতে আমি ছিলাম ভীষণ চঞ্চল এবং পরিচিত একটা মুখ সব বন্ধুদের কাছে এবং সব সিনিয়রদের কাছে। প্রথম প্রথম ক্লাসের সবাইকে আমি না চিনলেও নানান কারণে আমাকে ঠিকই চিনতো সবাই। অনেকের নাম না জানলেও শুধু মুখ চিনতাম। তো একদিন বাইরের এক হোটেলে সকালে খাবার খেতে নিয়ে আমার সামনের সিটে হঠাৎ করে দাঁত বের করা হাসি নিয়ে চেয়ারে বসে বলছে,, "দাদা, আজ পেয়েছি তোমাকে, তোমার সাথে তো কখনো পরিচয় হওয়া হয়নি, আজ আমি তোমাকে খাওয়াবো আর দুজনে পরিচয় হবো। আমার দাদা তুমি আজ থেকে।" ওর নাম সুদীপ্ত। পুরো নাম সুদীপ্ত সরকার। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলাতে।

IMG-20221012-WA0011.jpg
Location

সেই থেকে আমাদের আলাপচারিতা শুরু হয়। একসাথে ক্লাসে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু। কয়েক মাস পেরোতে না পেরোতেই আমরা ভীষণ ক্লোজ হয়ে গেলাম। আমাদের সম্পর্কটা দেখে বাকি বন্ধুরা সবাই হাসাহাসি করত এই বলে যে, দুজন দুজনের গার্লফ্রেন্ড। তাই বলে এমন না যে আমরা দুজন দুজনের ভালো দিকটা নিয়ে থাকতাম শুধু। আমাদের কথাবার্তা এবং চালচলন দেখলে মানুষ ভাববে আমরা চিরশত্রু। হোটেলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করতে নিলে আমাদের মাঝে তাড়াহুড়ো থাকতো কার খাওয়াটা আগে শেষ হবে, কারণ যার খাওয়া আগে শেষ হবে সে কায়দা করে টিস্যু দিয়ে হাতটা মুছে ক্যাশিয়ার কে অপরজনকে দেখিয়ে দিয়ে বিল ধরিয়ে চলে যেতাম😅।

আবার ক্লাসে স্যার অথবা ম্যাডাম এসে যখন এটেন্ডেন্স কল করতো আমার আর সুদীপ্তর দুজনারি একটাই চেষ্টা থাকতো কিভাবে একে অন্যের কনসেনট্রেশন নষ্ট করে অ্যাটেনডেন্স মিস করানো যায়। দুষ্টুমির এই খেলাতে কোনদিন আমি জিততাম না হয় কোনদিন সুদীপ্ত। মোটকথা কেউ কারো পেছনে লাগতে বিন্দুমাত্র ছাড়তাম না। একটু ফাঁক ফোকর পেলেই একজন আরেকজনের পেছনে মজার দুষ্টুমি গুলো চালিয়ে দিতাম। আর কারো সামনে দুজন দুজনকে পচাতে ছিলাম হেব্বি এক্সপার্ট। মুখের কথা যেন বুলেটের মতো ছুটতো।

IMG-20221012-WA0015.jpg
Location

তবে যত যাই হোক কোন কাজ কখনো দুজন দুজনকে ছাড়া করতাম না। আমি হাজার গালিগালাজ দিলেও সুদীপ্ত সন্ধ্যা হলেই আমার রুমের সামনে এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিত। বাইরে গিয়ে চা খেতেই হবে। একমাত্র সন্ধ্যার ওই সময়টাতে আমরা দুজনে নিজেদের মতো করে কথাবার্তা বলতাম। নিরিবিলিতে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে যেতাম। আমাদের ফিউচার প্ল্যান ক্যারিয়ার ভালো-মন্দ সব ধরনের কথা আধারের এক কোণে বসে দুজন দুজনের সাথে শেয়ার করতাম।

হোস্টেল লাইফগুলোতে মোটামুটি সবাই রাত জাগে, এটাই স্বাভাবিক। শীতকাল আসলে আমাদের একটা রুটিন ছিল মাঝ রাতের দিকে। প্রায় রোজ রাত দেড় টা কিংবা দুইটার দিকে আমি আর সুদীপ্ত বেরিয়ে যেতাম ক্যাম্পাস থেকে। প্রচন্ড ঠান্ডায় আর কুয়াশায় দুইজন চাদর মুড়ি দিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরের ছোট টং গুলোতে বসে চা খেতাম, পরোটা খেতাম , মাঝে মাঝে খিচুড়ি খেতাম। শীতকালে মাঝ রাতের এই অনুভূতি কখনো কারো সাথে শেয়ার করে বোঝানো যাবে না।

IMG-20221012-WA0020.jpg
Location

একবার সুদীপ্ত বলে ওর ফোনে ব্যালান্স নেই , বাড়িতে ফোন করবে তাই আমার ফোনটা নিয়ে বাইরে যায় কথা বলতে। তারপর ইচ্ছে করে আমার মেসেঞ্জারের ভেতর ঢুকে দুই সিনিয়র আপুকে এমন ভাবে ম্যাসেজ করে যে অনেকটা প্রপোজ করায় বলা যায়। পরে যা কান্ড বেধেছিল কি আর বলবো! ঐ বেটা তো ইচ্ছা মত মজা নেওয়া শুরু করে দিল। আমি যে কত কি করে ঐদিন সব ম্যানেজ করেছি আমি জানি 😅। আমাকে বলির পাঠা বানিয়ে সবাই সেদিন দারুন মজা নিয়েছিল। আমিও সুযোগ খুঁজছিলাম। একদিন সুদীপ্ত দেখি বাথরুম গিয়েছে ল্যাপটপ খোলা রেখে। ব্যাস, এবার আমাকে ধরে কে! আমি ওর রুমে ঢুকে ল্যাপটপে ফেসবুক ওপেন করে ওর গার্ল ফ্রেন্ড সহ পাঁচ বান্ধবী কে মনের মাধুরী মিশিয়ে মেসেজ করে আমার রুমে এসে এমন ভাবে শুয়ে থাকি যে আমি ঘুমে অচেতন হয়ে আছি লাস্ট এক দেড় ঘন্টা ধরে 🤪। এক ঘন্টা পর দেখি সুদীপ্ত দৌড়ে আমার রুমে এসে ডাকছে,,, "কিরে আমার এত বড় আকাম ডা কে করলো ? তুই?"
আমি তো উল্টা ঝাড়ি,, ধুর আমি ঘুমাইতেছি 😉। ভালো একটা প্যাঁচ লেগে গিয়েছিল। তারপর আমরা সব বন্ধুরা যা মজা নিয়েছিলাম ওটা মনে পরলে এখনও হাসতে হাসতে শেষ 😅।

সুদীপ্ত আর আমি যত শয়তানি করি না কেন, এক্সামের আগে সব ঠিক। যত ধরনের নোটস কালেকশন করতে হয় দুজন মিলে করতাম। তবে দুজন পড়তাম লুকিয়ে লুকিয়ে। কেউ কাউকে বলতাম না কতদূর পড়া শেষ করেছি। উল্টো পড়া শেষ করে একে অন্যের পড়ার সময় কিভাবে বিরক্ত করা যাবে সেই ধান্দায় থাকতাম 😉।

যতই পেছনে লাগি কোন সিরিয়াস ইস্যু তে ঠিক এক হয়ে যেতাম। অন্য কেউ এসে কিছু বললে সেখানে সবার আগে উঠে দাড়াতো সুদীপ্ত। আমিও ঠিক তেমন ছিলাম।

IMG-20221012-WA0018.jpg
Location

সত্যি বলতে সব কিছু ঠিকঠাক মত চলছিল। কিন্তু ভার্সিটি লাইফের শেষের দিকে এসে হঠাৎ একটা অজানা কারণে আমাদের মাঝে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। সেটার কারণ আজও আমার অজানা। আমি এটা নিয়ে ওর সাথে কথাও বলি। কিন্তু আগের মত আর কোন কিছু গড়ে উঠলো না। শেষ বছরে কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেলাম দুজন। দুজন দুজনকে ঠিক মিস করতাম। কিন্তু কোন এক অজানা ইগো তে বন্ধুত্বটা আমি হারিয়ে ফেললাম। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আমি খুব করে মিস করি সুদীপ্ত কে। এমন না যে আমি কথা বলি না ওর সাথে। প্রয়োজনে আমাদের কথা হয়। খুবই সীমিত আকারে। বছরে একবার বা দুইবার হয়তো। কিন্তু কোথাও একটা সংকীর্ণতা কাজ করে দুজনের মাঝেই।

দুজনের আরো কতশত কথা যে লেখা যেত সেটা বলে শেষ করতে পারব না। আমার ভার্সিটি লাইফে বন্ধুত্বের স্বাদ টা আমি ওর কাছ থেকেই পেয়েছি। হয়তো সম্পর্কের গাঢ়তা আগের মত নেই তবু বন্ধুত্বের ফেলে আসা স্মৃতি কে মনে করতে গেলে আমার সুদীপ্তর কথাই প্রথম মনে পরে। কোথাও একটা বন্ধন যেন রয়েই গেছে। আর এটা আজীবনের। আজ যখন লিখছিলাম এক এক করে সব স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। চোখের কোণায় দেখি হালকা নোনা জলও এসে গেছে। হ্যাঁ এটা আনন্দের। আমি এখনও বিশ্বাস করি আজও আমার যে কোন বিপদের কথা শুনলে সাথে সাথে এগিয়ে আসবে সুদীপ্ত। আমিও হয়তো চুপ করে বসে থাকতে পারবো না।

সব সম্পর্ক হয়তো সারাজীবন একরকম থাকে না। ভালো খারাপ সময় আছে সব কিছু তেই। আমি জানি হয়তো কোন এক দিন দুজন দুজনের ইগো বা অভিমান গুলো দূরে সরিয়ে দিয়ে আবার আগের বন্ধনে জড়িয়ে যাব। আর তখন হয়তো বন্ধন টা আরো বেশি পূর্ণতা পাবে।

Sort:  
 3 years ago 
দাদা আপনার পোস্টটি পড়ে এতটুকু বুঝতে পেরেছি, বন্ধুত্ব বলতে যা বোঝায় তা আপনার এবং আপনার বন্ধু সুদীপ্তর মাঝে পুরোপুরি ছিল। যদিও যেকোনো ইগোর কারণে আপনাদের মাঝে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আপনার মতো আপনার বন্ধু সুদীপ্তও হয়তোবা আপনার অপেক্ষায় আছে।কখন আমার বন্ধু আমাকে নিয়ে আবার প্রচন্ড ঠান্ডায় আর কুয়াশায় চাদর মুড়ি দিয়ে কোন চায়ের দোকানে নিয়ে যাবে।কিন্তু দাদা আমার মনে হয় আপনাদের যেকোনো একজনকে মনের ভেতরের সংকীর্ণতা দূর করে অজানা বিষয়টি নিয়ে কথা বলা দরকার। হতে পারে তেমন কিছু না। কিন্তু মাঝখান থেকে দুই বন্ধুই কষ্ট পাচ্ছেন।মনেপ্রানে এই কামনা করি আপনাদের বন্ধুত্বের বন্ধনকে সৃষ্টিকর্তা যেকোনো ভাবেই জোড়া লাগিয়ে দিক।আপনার জন্য আমার এই কামনা।
 3 years ago 

আপনি যে সময় আর ধৈর্য নিয়ে পুরো লেখাটা পড়েছেন তার জন্য আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ ভাই। আপনার মত আমিও চাই খুব তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাক। হয়তো সেদিন খুব তাড়াতাড়িই আসতে চলেছে। অনেক ভালো থাকবেন ভাই।

 3 years ago 

ঠিক বলেছেন ভাইয়া স্কুল লাইফের বন্ধু গুলো প্রকৃতপক্ষে নিঃস্বার্থ বন্ধু হয়ে থাকে সব সময়।ক্যাশিয়ার কে অপরজনকে দেখিয়ে দিয়ে বিল ধরিয়ে চলে আসা এটা বন্ধুত্বের মধ্যে হওয়া স্বাভাবিক। বন্ধুত্বের কমপিটিশনে দুজনকে লুকিয়েয় পড়তে হয়।কেউ কাউকে বলতাম না কতদূর পড়া শেষ করেছি তাহলে তো পড়ার খবর জেনে গেল। আপনাকে কেউ কিছু বললে সুদিপ্ত সেখানে উঠে দাঁড়ানো স্বাভাবিক এটাই বন্ধুত্ব।আপনার বন্ধুত্বের গল্প পড়ে অনেক ভালো লাগল। আসলে বন্ধুত্বের মধ্যে এমন হয়ে থাকে।ঠিক বলেছেন বন্ধুত্বের স্মৃতি কখনো ভুলা যায় না।সত্যি ভাইয়া দোয়াকরি আপনি ও আপনার বন্ধু সুদীপ্ত আবার আগের মতো হয়ে যাবেন এটাই আশাকরি।

 3 years ago 

আপনাদের দোয়া টা যেন খুব তাড়াতাড়ি ফলে যায় এটাই চাওয়া। অনেক ভালো লাগলো আপু আপনার মন্তব্য পেয়ে। শুভেচ্ছা রইলো।

 3 years ago 

সুদীপ্ত দাদার সাথে আপনার বন্ধুত্বের ছোট ছোট খুনসুটির মোমেন্টগুলে যতই পড়ছিলাম, ততই ভালো লাগছিল দাদা। সবার লাইফে এমন এক দুজন বন্ধু থাকেই, যারা লাইফের গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হয়ে থেকে যায়। হয়তো কোনো একটা কারণে আগের মতো কথা হয় না, কিন্তু বন্ধুত্বের স্মৃতিগুলো আজীবন স্মৃতির অ্যালবামে রয়ে যাবে।

 3 years ago 

আসলে একটা বন্ধু জীবনে থাকলে কেমন সব পরিস্থিতি হতে পারে আর কিভাবে মজা করা হয় জীবনে বন্ধুদের নিয়ে তার সবটাই আমি সুদীপ্ত কে নিয়ে পেয়েছি। তাই ভেতরের টান টা একটু বেশীই কাজ করে এখনও।

 3 years ago 

জি দাদা গল্পটা পড়ে তাই মনে হলো। 🌼

 3 years ago 

প্রত্যেকটা ঘটনা পড়লাম। হাস্যকর ছিলো গার্লফ্রেন্ড আর বান্ধবীদের মধুর মেসেজ করা।🤣আর স্কুলে থাকতে আমরাও এটা করতাম আমাদের যাদের শুরুর দিকে নাম থাকত তারা রোলকল হয়ে যাওয়ার পর পরের গুলো কে কথায় এত মত্তো রাখতাম যে প্রেজেন্ট দেওয়া ভুলে যেতো। 🤣

 3 years ago 

এই ছোট ছোট ছোট স্মৃতি গুলোই আমাদের সারা জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ স্মৃতি হয়ে থাকবে। এই মুহূর্ত গুলোর জন্যই হয়তো আমরা এখনো বেঁচে আছি।

Coin Marketplace

STEEM 0.10
TRX 0.32
JST 0.033
BTC 111196.87
ETH 4040.70
USDT 1.00
SBD 0.61