গোয়েন্দা রহস্য গল্প : "অর্কিড যখন মৃত্যুর হাতছানি দেয়" - পর্ব ১১

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago


copyright free image source pixabay

দশম পর্বের পর


একাদশ


লালবাজার হেডকোয়ার্টার্স । ইন্সপেক্টর অনীশ মিত্রের অফিস রুম ।

রাত্রি, প্রায় ১২ টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই । বিকাশের হ্যান্ড কাফ খুলে দিতে বললেন ইন্সপেক্টর । বেয়ারাকে ডেকে চা, কফি, জল আনার নির্দেশ দিলেন । তারপরে গুছিয়ে বসে তাকালেন বিকাশের দিকে ।

বিকাশের ভীষণই নির্লিপ্ত ভাব । হাত দুটি কোলের কাছে জড়ো করা । চোখের দৃষ্টিতে একটা শূন্যতার আভাস । বড়বাবুর দিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর । বড়বাবুর চোখে মুখে এখনও প্রবল বিস্ময় । কি ভাবে খুনী ধরা পড়লো জানার অত্যুগ্র ইচ্ছে চেপে রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টা করে চলেছেন বড়বাবু ।

চা-কফি'র পর্ব মিটলে গলাটা ঈষৎ কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বড়বাবুই প্রথম মুখ খুললেন,

-"স্যার, কিভাবে খুনিকে ধরলেন যদি এখন বলতেন ?"

-"নিশ্চয়ই, বলছি সবই । আসলে এই কেসে আপাতদৃষ্টিতে আততায়ী প্রায় কোনো সূত্রই রাখেনি, তাই পুলিশ ডিপার্টমেন্ট বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল । একটা খুনের সব চাইতে দু'টি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ - এক. খুনে ব্যবহৃত ওয়েপন, দুই. খুনের পিছনের মোটিভ । এই কেসে বহু অনুসন্ধানের পর খুনে ব্যবহৃত ওয়েপন মানে বিষ খুঁজে পেলেও তার পরিচয় জানা যায়নি । অর্থাৎ, সম্পূর্ণ অজানা বিষ প্রয়োগে খুন । ফলে কার্যত কোনো সূত্রই পাওয়া গেলো না । এর পরে থাকে মোটিভ । অনেক অনুসন্ধানের পরেও কোনো মোটিভ পাওয়া যায়নি । ফলে, সম্ভাব্য খুনীর পরিচয় পাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব ছিল । কিন্তু, খুনি যত চতুরতার সাথেই খুন করুক না কেন, খুনি কিন্তু নিজের অজান্তেই একাধিক সূত্র রেখে গেছিলো । আমি সেগুলি থেকেই খুনিকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হই ।"

-"চলুন, একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করি । প্রথম যেদিন আমি প্রোফেসর সেনের ফ্ল্যাটে তদন্তে যাই সেদিনই কিন্তু আমি মোটামুটি শিওর হয়ে যাই যে এই খুনের পেছনে রয়েছে তীব্র বিষ । দেখুন, প্রথম কথা - ঘটনার দিন ও তার আগের ৭ দিন পর্যন্ত হরিসাধন ছাড়া বাইরের কেউই ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢোকেনি । মি: সেনও এই ৭ দিন বাইরে যাননি একবারও । আপনাদের কাছেই রয়েছে তার প্রমান; সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ । তাহলে বাইরের কারো দ্বারা এই খুন না হওয়াই পসিবল । সেই জন্যই আপনারা হরসাধনকে সাসপেক্ট করেছিলেন । কিন্তু, এই খুনের পিছনে হরিসাধনের কোনও মোটিভ মেলেনি । কোনো দামি জিনিসও খোয়া যায়নি । ৪০ বছরের পুরোনো চাকর টাকা পয়সার জন্য নিছক খুন করবে, আবার না পালিয়ে অন দা স্পট থাকবে ! কোনো মতেই এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় । আর একটা কথা; পুবের ব্যালকনিতে আমরা যে সব অর্কিড দেখেছিলাম তাদের সম্মিলিত দাম কোটি টাকারও বেশি । আপনার মনে আছে কি না জানি না, আমি প্রায় সব গুলো অর্কিডের ছবি তুলেছিলাম । পরে একজন অর্কিড বিশেষজ্ঞকে দেখাতে উনি কন্ফার্ম করেন সবগুলোর দাম কোটির উপরে । হরিসাধন জানতো এতো দামি অর্কিডের কথা । কিন্তু কখনোই চুরির চেষ্টা করেনি । তাই, হরিসাধন আমার সাসপেক্ট লিস্ট থেকে বাদ পড়েছিল প্রথমেই ।"

-"মি: সেনের মৃতদেহের পজিশন, মুখে গ্যাঁজলা, চক্ষু বিস্ফারিত আর খুব দ্রুত বডির মাসল স্টিফ হয়ে যাওয়া, এ সকল কিছুই পটাশিয়াম সায়ানাইডের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করছিলো । পরে অবশ্য বিষের কেমিক্যাল এনালাইসিস করে জানা যায় বিষটা পটাশিয়াম সায়ানাইড নয়, বরং তার থেকেও অতি তীব্র বিষ । যাই হোক, আমি হরিসাধনকে জেরা করে বুঝতে পারি মি: সেনের মৃত্যু হয়েছে প্রায় চোখের নিমেষে । এবং সেই অর্কিডের ক্যাটালগটা দেখতে দেখতেই ।এটা বুঝতে পেরেই আমি আপনাকে ওই অর্কিডের ক্যাটালগটা সিজ করতে বলে দেই । এর পরে আমি মি: সেনের ডেডবডি যে সোফাটায় পাওয়া গেছিলো সেটি খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে কয়েকটি নখের টুকরো পাই । টি টেবিলের নিচেও আরো কয়েকটা টুকরো পাই । এরপরে যখন তাঁর স্টাডি রুমে গেলাম তখন দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাই । এক - ব্রাজিল থাকাকালীন তাঁর তিনটে ডাইরি; দুই - আবারো কিছু নখের টুকরো স্টাডি টেবিলের উপর ।"

-"DNA ম্যাচিং করে পরে কনফার্ম হই ওগুলো মি: সেনের-ই নখের টুকরো ।যাই হোক আমি তখন মোটামুটি বুঝতে পেরে গেছি খুন কি করে হলো ? আপনার মনে আছে কি না জানি না, আমি ফ্ল্যাট থেকে বেরোবার আগে হরিসাধনকে জনান্তিকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম ! আসলে আমি জানতে চেয়েছিলাম মি: সেনের দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটার বদভ্যাস আছে কি না । হরিসাধন জানালো তার মনিবের এই বদভ্যাসটি ভালো রকমই ছিল । একটু উত্তেজিত হলেই দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটতেন ।"

-"ঘটনার দিনের কথা মনে করুন । সকাল ৮টায় ফোনে মি: সেন জানতে পারলেন নতুন কিছু দামি অর্কিডের একটা ক্যাটালগ পাঠাচ্ছে Carla Porto । উনি অত্যন্ত খুশি মনে স্টাডি রুমে ঢোকেন । কিছু নখ পাই স্টাডি টেবিলে । হরিসাধন রেগুলার ঘর পরিষ্কার রাখতো তাই ওই কাটা নখগুলো ঘটনার দিনের-ই । তারপরে দশটা নাগাদ ক্যাটালগের ডেলিভারি । ক্যাটালগ টা টি টেবিলের পরে রেখে মি: সেনকে জানিয়ে দিলো হরিসাধন । তার মিনিট কুড়ি পরে তাঁর মৃতদেহ মিললো সোফায় সাথে কিছু কাটা নখের টুকরো ।"

-"দিনের আলোর মত পরিষ্কার; খুন হয়েছে বিষের মাধ্যমে । আমি যা আশংকা করেছিলাম সেদিন, ল্যাব থেকে আমাকে তাই কন্ফার্ম করলো । ক্যাটালগের ফরেনসিক রিপোর্ট । ১১ নম্বর পেজে একটি অত্যন্ত দামি ও রেয়ার অর্কিডের ছবির উপরে মাখানো ছিল এই তীব্র বিষ । ফটো গ্লোজি পেজ, আঠালো । বিষ তাই উবে যায়নি, আবার কাগজে শোষিতও হয়নি । বেশ কয়েকবার ওই অর্কিডের ছবির পেটালে আঙ্গুল বোলান মি: সেন । তারপরে ভীষণ খুশিতে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন ।"

-"এ ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে আমি সম্ভাব্য খুনির কিছুটা আভাস পাই । খুনি ভিক্টিমের পূর্ব পরিচিত । আর শুধু পরিচিতই নয়; তার অর্কিড বিলাস, উত্তেজনায় দাঁত দিয়ে নখ কাটার বদভ্যাস। এগুলো সবই সে ভালো ভাবে জানতো । আর যেদিন এসিপি স্যারের সাথে বিষের তীব্রতা, পরিচয়, প্রকৃতি নিয়ে কথা বলছিলাম তখন একটা বিষয় সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে যাই যে, বিষটা এসেছে সুদূর ব্রাজিল থেকে ।"

-"ডেডবডি'র পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যে বিষের উল্লেখ ছিল সেই একই বিষ পাওয়া গেলো ক্যাটালগের ১১তম পেজে ওই বিশেষ অর্কিডের ছবির উপরে । তাই খুন কি ভাবে হলো আমি বুঝতে পেরে গেলাম । এই বার শুরু হলো আমার খুনীর অনুসন্ধান পর্ব ।"


[ক্রমশ]

Sort:  

Good!

Hi @rme,
my name is @ilnegro and I voted your post using steem-fanbase.com.

Please consider to approve our witness 👇

Come and visit Italy Community

 3 years ago 

বড়বাবুর মত আমরাও আসল ঘটনাটা জানার আগ্রহী ছিলাম। অনেক জট খুলেছে। আগামী পর্বে অনুসন্ধান এর ব্যাপার আর খুনির মটিভ জানা যাবে আশা করছি। খুব মজা পাচ্ছি গল্পটা।

 3 years ago 

দাদা আমি তো পড়তে পড়তে চোখ একদম বড় করে পড়ছিলাম শেষটা।
আপনি গল্পটাতে যতটুকু দরকার ততটুকুই দিয়েছেন, এর এক চুল ও বেশি দেন নি, কম ও দেন নি।
গল্পটা এতোটাই মজার ছিলো যে আমি শেষ না হওয়া পর্যন্ত একবার ও ফোনের স্ক্রিনের উপর থেকে চোখ সরাইনি।
পরের পর্বে হয়তো দিবেন খুনি শনাক্তের কাহিনী।তাইনা দাদা?

 3 years ago 

একদম ঠিক ।

 3 years ago 

আপনার রিপ্লাই দেখে দাদা ধন্য হয়ে গেলাম।

 3 years ago 

খুনি কত সতর্কতার সাথে খুন করেছে,তাও ধরা পড়ে গেল। পুলিশের ওগুলো কোন ব্যাপার না।খুনিকে ধরা পড়তেই হবে।কথায় বলে না।পৃথিবীতে দুটি জিনিস চাপা থাকে না।এক হলো প্রেম ও আর একটি হলো খুন।যাইহোক অনেক সুন্দরভাবে গল্পটি উপস্থাপন করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

 3 years ago 

কি সূত্র, জাস্ট অসাধারণ। তারমানে প্রফেসর ক্যাটালগে বিষ লাগানো ছিল। প্রফেসর টাচ্ করে করে আনন্দে উত্তেজিত হয়ে, দাঁত দিয়ে নখ কাটতে গিয়েই। মৃত্যু। তাহলে একটা কথা মাথায় বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে, খুনী কি তার পূর্ব পরিচিত নাকি? জানার অপেক্ষায় থাকলাম ভাই।

 3 years ago 

খুনি প্রফেসর সেনের পূর্ব পরিচিত। খুনি প্রফেসর সেনের অভ্যাসগুলো সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানতো। হয়তোবা সুদূর ব্রাজিল থেকেই এই শত্রুতার সূত্রপাত ঘটে। তবে খুনি যত চালাক হোক না কেন সে অবশ্যই তার অপরাধ লুকাতে পারবেনা। বিকাশ অবশ্যই তার অপরাধের শাস্তি পাবে। পরবর্তী পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম দাদা।

This post has been upvoted by @italygame witness curation trail


If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness




CLICK HERE 👇

Come and visit Italy Community



 3 years ago 

ওরে বাবা!
এতো দেখছি সেই ফেলুদার মতো সন্তপর্নে এগুচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে আজকের পর্বটি, ভালো একটা অনুভূতিও কাজ করছে। কারন অনেক কিছুই আজ পরিস্কার হয়েগেছে কিন্তু এখনো কিছু বিষয় বাকি আছে, তাই পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

 3 years ago 

দাদা গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলে।আসলে গোয়েন্দা মানে একটু কেটিকালি বুদ্ধি। গোয়েন্দারা তাদের কেটিকালি বুদ্ধি দ্বারা কাজ করে।আপনাকে ধন্যবাদ এমন সুন্দর গল্প শেয়ার করার জন্য।

Coin Marketplace

STEEM 0.19
TRX 0.17
JST 0.033
BTC 64258.81
ETH 2772.25
USDT 1.00
SBD 2.65