আলোকচিত্র : শান্তিনিকেতনে কিছুদিন -০৬
বাংলা নববর্ষের পরেরদিন সকালে আমার ঘুম আর ভাঙতেই চায় না । প্রায় সারারাত জেগে পোস্ট করেছি আর ভোট দিয়েছি । অনেক ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতির পরে উঠলাম । আজকে আমরা হোটেলেই ভারী প্রাতরাশের পরে বেড়াতে বেরোবো এটা ঠিক করে নিয়েছিলাম । আমি ওঠার পরেও টিনটিন আর ওঠে না । তনুজা তো সমানে গর্জাতে লাগলো, বেড়াতে এসেও বাপ-ব্যাটার এত ঘুম । যাই হোক, সবাই ঘুম থেকে উঠে সকাল ৯ টার দিকে ফ্রেশ হয়ে হোটেলের ডাইনিং হলে হাজির হলাম ।
বেশ ভারী প্রাতরাশের অর্ডার দিলাম । সব বাঙালি খাবার অর্ডার করলাম । সাদা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, টমেটো দিয়ে ডাল, আলু-ফুলকপি-মটরশুঁটির নিরামিষ তরকারি, বড় বড় পাবদা মাছের সরিষা দিয়ে ঝাল, বিশাল সাইজের পাকা রুইয়ের কালিয়া, ডিমের ডালনা, তোপসে মাছ ফ্রাই, ভেটকি দিয়ে আলুর পাতলা ঝোল, চিকেন কারি আর শেষ পাতে টমেটোর চাটনি ।
এরপরে স্নান করে নিলাম দ্রুত । একটু রেস্ট নিয়ে গাইডকে কল করলাম । আজকে আমাদের সাঁওতালদের গ্রাম "শালবনি" আর সংলগ্ন শালবনে যাওয়ার কথা । আর বিকেলে যাবো আবার সোনাঝুরির হাটে । আজকে হাটবার । বিশাল হাট বসবে সোনাঝুরিতে ।
আমাদের হোটেল থেকে খুব একটা দূরে নয় শালবনি । মাত্র মিনিট কুড়ির রাস্তা গাড়িতে গেলে । সমস্যা একটিই, সেটি হলো সাঁওতালদের গ্রামের রাস্তা খুব সরু । গাইড জানালো গাড়ি যাবে, তবে এই বিশাল সাইজের SUV গাড়ি গ্রামের প্রধান সড়কে কষ্টে সৃষ্টে গেলেও গ্রামের অপরাপর রাস্তা গুলোতে ঢুকবে না । কি আর করা, অগত্যা তাই সই ।
তারপরের অভিজ্ঞতা অসাধারণ । শালবনি গ্রামের শতভাগ অধিবাসীই সাঁওতাল । রাস্তা ঘাট মেঠো রাস্তা, কিন্তু কোথাও এক বিন্দু ময়লা-আবর্জনা চোখে পড়লো না । রাস্তা ঘাটে গাছের পাতা অব্দি এরা জমতে দেয় না । সকাল-সন্ধ্যায় সবাই যে যার বাড়ির উঠোন ও তৎসংলগ্ন সামনের রাস্তা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার রাখে ।
আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো, সাঁওতালরা অসম্ভব পরিশ্রমী জাত। পুরুষ ও সমর্থ মেয়েরাও নিস্কর্মা বসে থাকে না । অলস লোককে সাঁওতালরা দারুন ঘৃণা করে । এরা আবার খুব অতিথিপরায়ণ হয়ে থাকে । বাড়িতে অতিথি হয়ে এলেএরা তাকে দেবতা জ্ঞানে তার খাতির যত্ন করে ।
প্রথমে উঠোনের একটি ছায়াময় পরিষ্কার স্থানে একটি চৌপায়ের ওপর অতিথিকে সসম্মানে বসতে দেয় । এরপরে বাড়ির মেয়েরা এসে জলভরা একটি ঝকঝকে পেতলের ঘট এনে অতিথির পায়ের কাছে রেখে অভিবাদন করে । এই ঘটির জল দিয়ে হাত, মুখ, পা প্রক্ষালন করে এসে বসার পরে একেবারে নতুন একটি গামছা আর ধুতি এনে সামনে রাখে । এগুলো সাঁওতালরা গাঁয়ের তাঁতেই বুনে থাকে ।
এরপরে চলে ভোজসভা । অতিথি এলে প্রায়ই এরা মোরগ রান্না করে অতিথিকে খাওয়ায় । নিজেরা নানা আজেবাজে পশুর মাংস খেয়ে থাকে । কুকুর, বেড়াল, খরগোশ, শূকর, শজারু, ইঁদুর, গোসাপ সব কিছুই এদের খাদ্য ।
গ্রামের রাস্তায় কিছুক্ষন বেরিয়ে আমরা শালবনে ঢুকে পড়লাম । এদিকটায় জঙ্গল বেশ ঘন । বুনো শুকরের উপদ্রব আছে । একটি দাঁতাল বুনো শুকরের একটি মানুষ মারতে মোটে দুই মিনিট লাগে । পা থেকে বুক পর্যন্ত দাঁত দিয়ে ফেঁড়ে ফেলে এরা । তাই আমরা সাঁওতালদের যে খানটায় নানা ধর্মীয় উৎসব মানে পরব হয়ে থাকে সেখানে গেলাম ।
ও মা, সেখানে মানুষ প্রচুর । এখানে শালগাছগুলি ফাঁকা ফাঁকা । গাইড জানালো "ইষ্টি কুটুম" নামক একটি বাংলা সিরিয়ালের শুটিং এখানেই চলেছিল দীর্ঘ ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে । একটা অস্থায়ী বিয়ে পড়ানো ঘর দেখলুম । এখানে সাঁওতালদের বিয়ের ছাদনাতলা । ঘন বনের মাঝে । ভাবা যায় ?
সাঁওতালদের গাঁয়ের রাস্তায় আমরা । রাস্তা এত পরিষ্কার যেটা ধারণাই করা যায় না ।
তারিখ : ১৬ এপ্রিল ২০২২
সময় : সকাল ১০ টা ৫০ মিনিট
স্থান : শান্তিনিকেতন, বোলপুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।
সাঁওতালদের গাঁয়ের একটি মুদি দোকান ।
তারিখ : ১৬ এপ্রিল ২০২২
সময় : সকাল ১১ টা ০০ মিনিট
স্থান : শান্তিনিকেতন, বোলপুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।
এটি সাঁওতালদের গাঁয়ের একটি মন্দির । মারাং বুরু এই মন্দিরের দেবতা । মারাং বুরু আর হিন্দুদের প্রধান দেবতা শিব একই । সাঁওতালরা হিন্দু নয়, কিন্তু বিবাহরীতি হিন্দুদের মতোই । বিবাহিতা মেয়েরা শাঁখা-সিঁদুর পরে । দূর্গা, কালী, শিব, লক্ষী পূজাও করে এরা ।
তারিখ : ১৬ এপ্রিল ২০২২
সময় : সকাল ১১ টা ২০ মিনিট
স্থান : শান্তিনিকেতন, বোলপুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।
সাঁওতালদের পরবের স্থান । শালবনের মাঝেই এটির অবস্থান ।
তারিখ : ১৬ এপ্রিল ২০২২
সময় : সকাল ১১ টা ৪০ মিনিট
স্থান : শান্তিনিকেতন, বোলপুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।
সাঁওতালদের বিবাহ-বাসর অর্থাৎ ছাদনাতলা । এখন যেটা দেখতে পারছেন এটা শুধুই কাঠামো । বিয়ের সময় ফুল-লতা-পাতায় সেজে ওঠে বিবাহ বাসর ।
তারিখ : ১৬ এপ্রিল ২০২২
সময় : সকাল ১১ টা ৫০ মিনিট
স্থান : শান্তিনিকেতন, বোলপুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।
শালবনে আমরা ।
তারিখ : ১৬ এপ্রিল ২০২২
সময় : দুপুর ১২ টা ০০ মিনিট
স্থান : শান্তিনিকেতন, বোলপুর, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।
ক্যামেরা পরিচিতি : OnePlus
ক্যামেরা মডেল : EB2101
ফোকাল লেংথ : ৫ মিমিঃ
দাদা মনে হচ্ছে সবগুলো খাবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো, সত্যি এগুলো ছাড়া খাবারে একদমই তৃপ্তি আসে না, যদিও বৈশাখের দিনে একটু বেশী খাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
তবে অতিথির আপ্যায়নের রেওয়াজটা বেশ ভালো লেগেছে সাঁওতালদের। নিজেরা যাইহোক খাক না কেন, অতিথিদের ঠিক মোরগ রান্না করে খাওয়ায়, সত্যি দারুণ! ফটোগ্রাফিগুলো ভালো লেগেছে।
@tipu curate 7
Upvoted 👌 (Mana: 0/8) Get profit votes with @tipU :)
Hi @rme,
my name is @ilnegro and I voted your post using steem-fanbase.com.
Come and visit Italy Community
এই কথার সাথে সম্পূর্ণ একমত দাদা। আমিও কিছুদিন আগে রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক পাহাড়ি অধিবাসী রয়েছে তারা বিভিন্ন প্রজাতি হিসেবে পরিচিত। তারা প্রচুর পরিশ্রম করে এবং আমি দেখেছি তারা সব সময় কোন না কোন কাজে ব্যস্থ থাকে এবং তারা খুবই পরিশ্রমি।। সন্ধার আগেই তারা নিজের বাসায় ঢুকে পরে, দিনের আলোতে সব কাজ করে রাখে তারা।
দাদা আপনার এই ছবিগুলো সত্যিই অসাধারণ হয়েছে বিশেষ করে এরকম জায়গায় ঘুরতে আমার ব্যক্তিগতভাবে অনেক ভালো লাগে। রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম সেখানে চারিদিকেই শুধুমাত্র বন, নদী, পাহাড় ছিল, সে দৃশ্য গুলো দেখলেই মন জুরিয়ে যায়। তবে তাদের ঘন জঙ্গলে ঘুরতে গেলে একটু সাবধানতা সবসময় অবলম্বন করতে হয়, কারণ বন্য পশুরা আশেপাশেই থাকে।
Thank You for sharing Your insights...
দাদা ভারি প্রাতরাশ করবেন সেটা বুঝলাম কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে এটা তো অনেক বেশি ভারী এতসব খাবার খেয়ে ফেলেছেন সকাল সকাল হা হা হা। যাই হোক দাদা বরাবরের মত আপনার আজকের পোস্টেও দর্শনীয় এবং শিক্ষনীয় কিছু পেয়ে খুব ভালো লাগলো। আপনার ফটোগ্রাফি খুলো দেখি মনে হল আমি নিজেই সাঁওতালদের গ্রাম থেকে ঘুরে আসলাম আপনার পোস্টে এসে সাহসা সাঁওতালদের ছাঁদনাতলা পরবের স্থান সব দেখা হয়ে গেল। সাঁওতালদের মারাং বুরু দেবতা ও হিন্দুদের প্রধান দেবতা শিব যে একই এটা আমার জানা ছিল না। অজানা তথ্যগুলো শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
সকালবেলার খাবার গুলোর নাম শুনেই মুখে পানি চলে আসলো ভাই । আহা সব বাঙালি খাবার । এইটা একদম সত্য কথা সাঁওতাল জনগোষ্ঠির মানুষজন বেশ অতিথিপরায়ণ ও পরিশ্রমী । আমি নিজে স্বচক্ষেই তাদের জীবনধারা দেখেছি । কারণ আমার যে জায়গায় গ্রামের চেম্বার, সেখান থেকে খুব কাছেই একটা সাঁওতাল পল্লী আছে । ধন্যবাদ আপনার অনুভূতি আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য ।
দাদা আপনার ব্রেকফাস্ট এর লিস্ট শুনেই জিভে জল এসে গেল। সাঁওতালদের গ্রাম টি দেখে বেশ ভালো লাগলো। এত সুন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ তারা জেনে অবাক হলাম। সেই সঙ্গে এত অতিথি বৎসল মানুষ এখন তো পাওয়াই যায়না। দারুন কিছু অভিজ্ঞতা হল আপনার পোস্টের মাধ্যমে।
আপনিতো সাঁওতালদের সম্বন্ধে অনেক খুঁটিনাটি জানেন দেখছি দাদা। এই আদিবাসীদের সম্বন্ধে আপনার পোস্ট থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এই আদিবাসীদের ব্যাপারে শুধু এটুকু জানতাম যে এরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী। আপনার ছবিগুলোর মাধ্যমে অনেক কিছু দেখতে পেলাম। ধন্যবাদ দাদা।
আপনি একদম ঠিক কথা বলেছেন দাদা সাঁওতালরা আসলে অনেক পরিশ্রমী হয়।কারণ আমি অনেক সাঁওতালদের চোখের সামনে দেখেছি।বৌদির ড্রেসটা অনেক সুন্দর আপনার পাশে বৌদিকে দারুন লাগছে।অনেক অনেক দোয়া ও ভালোবাসা অবিরাম♥♥
বেশ ভালো আপ্যায়ন পেয়েছেন মনে হচ্ছে। সাঁওতালদের ছাদনাতলা বেশ সুন্দর তো। সব মিলিয়ে অসাধারণ দাদা। বেশ ভালো সময় পার করেছেন। ধন্যবাদ