ঘুরে এলাম প্রকাশকের বাড়ি। সেও দেখবার মতোই।
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা
আজ ১৪ ই নভেম্বর। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটা স্কুলেই পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিন উদযাপন হেতু পালন হচ্ছে শিশু দিবস। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে সব হই হই রই রই কান্ড। বাচ্চারা সবাই নন ড্রেসে গিয়েছে এবং স্কুলেও তাদের নানান ধরনের জিনিস উপহার দিয়ে নাচ গান ইত্যাদির মাধ্যমে সুন্দর একটি দিন কাটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষগুলো। আমার মেয়েও যথারীতি একটু আগেই ফিরেছে এক ব্যাগ ভরতি গিফট নিয়ে। মনে এতই আনন্দ হয়েছে সোসাইটির গেট থেকে চিৎকার করে গান গাইতে গাইতে আসছে আর সেই গান আমি চারতলার ঘরে বসে শুনতে পাচ্ছি।
শিক্ষক দিবসের কারণেই আজ ভাবলাম একটি বই সংক্রান্ত পোস্ট করি। বর্তমানে বাচ্চারা বই থেকে সরে যাচ্ছে কিন্তু যারা বইপ্রেমী তারা বই আঁকড়েই পড়ে থাকে। তো সেই বই তো আর এমনি এমনি বাজারে আসে না তার পেছনে অনেক পরিশ্রম থাকে। বইয়ের মতনই পত্রিকাও তাই। আমি যেহেতু একটি পত্রিকার সহসম্পাদক, অনেক কাজই করতে হয়। সামনেই বইমেলা আমাদের পত্রিকা প্রকাশের জন্য পাবলিশার্স বা প্রকাশন খুঁজে বার করা এবং তার সাথে মিটিং করা খরচ পাতি নিয়ে আলোচনা সবকিছুর ভেতর দিয়ে লম্বা পথ পেরিয়ে একটি পত্রিকা পাবলিশ করা হয়। যারা শুধু ফল খান তারা ভাবতেও পারবেন না গাছটির পরিচর্যা করতে ঠিক কতখানি পরিশ্রম লাগে। যাইহোক এসব বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে নানান অভিজ্ঞতা হয় তারই পাতা থেকে একটি ছোট্ট প্রতিবেদন আপনাদের জন্য।
আশা করি আপনারা সকলেই ভাল আছেন, আপনাদের শারীরিক সুস্থতা কামনা করি শুরু করছি, প্রথমেই জানাই -
জানেনই তো এই কয়েকদিন আগে কলকাতা গিয়েছিলাম। সকাল বেলায় সামান্য কাজ সেরে, বিকেলে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে ছিলাম কারণ পাবলিশার্স মিটিং এর টাইম দিয়েছিলেন সন্ধ্যেবেলায়। আমার বাড়ি যেহেতু মেদনীপুর তাই একবার কলকাতা গিয়ে অনেকগুলো কাজ একসাথে মিটিয়ে ফেলাই আমার উদ্দেশ্য থাকে। কিছুক্ষণ বসার পর যখন সিঁথিরমোড়ের বাসস্ট্যান্ডে এলাম, দেখি অপেক্ষা করছেন আমাদের পত্রিকার প্রধান সম্পাদক আপনাদের প্রিয়, কৌশিকদা। ততক্ষণে প্রকাশক দাদা চলে এসেছেন তার বাড়িতে, আমরাও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। পুরনো কলকাতার ঘরবাড়ি গলিপথ পার করে যখন বাড়ির সামনে এলাম গাছ গাছালিতে বাড়ির দরজা আর দেখা যাচ্ছে না। ভদ্রলোক কে ফোন করলাম, উনি বেরিয়ে এলেন আর আমাদের ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলেন। অনেক পুরনো বাড়ি, লাল রঙের মেঝে। গোলাপি রঙের দেওয়াল, কোণায় কোণায় সাজানো বই। দেখেই মনে হয় বহু যুগ ধরে এই বাড়ি রয়েছে আর এখানে অনেক গল্প তৈরির পর জন্ম নিয়েছেন এই প্রকাশক।
শুনশান ফাঁকা বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। বাবা মা গত হয়েছেন কিছুকাল আগে। হাসিমুখে যখন জিজ্ঞেস করলাম এই ঘর তোর কে গুছিয়ে রাখে এইভাবে? উনি বেশ সাবলীলভাবে উত্তর দিলেন "ঘেঁটের এবার তো কেউ নেই তাই অনেকটা পরিশ্রম করতে হয় না, তবে সমস্ত কিছু আমি করি এমনকি পর্দাও নিজেই পরিবর্তন করি। " কে বলে যে ছেলেরা গোছানো হয় না? কে বলে ছেলেরা বাড়ির কাজ পারে না? এমন সুন্দর গোছানো পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। বাড়িটা যেন এই সুন্দর বইয়ের গন্ধ পাওয়ার জন্যই এতদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ছাপাখানার কথা থেকে খরচপাতি ইত্যাদি সমস্ত কিছু আলোচনার ফাঁকে উনি চায়ের অফার করলেন, আমি জল খেলাম। নানান আলাপ আলোচনার মধ্যেই হঠাৎ কৌশিকদা বলে উঠলো আমার বাম দিকে হাত দেখিয়ে "ওটা কি পুরনো দিনের মিটার বক্স দাদা?" আমি ঘুরে দেখলাম, সত্যিই তো বহু বছর আগে একেবারে ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে দেখেছিলাম। তারপর সে যে কোথায় উধাও হয়ে গেল জানিনা। মাঝে তো ভুলেই গেছিলাম এরকম মিটার বাক্স হতো কোন এক সময়। দাদার বাড়িতে এই জিনিস দেখে ভাবছিলাম পুরনো কলকাতা নামেই পুরনো কলকাতা নয় এখানে অনেক পুরনো পুরনো জিনিস এখনো টিকে আছে।
গল্প করতে করতে বললেন, শুরুর দিকে যে টাইটেলগুলো করেছিলেন তার প্রচ্ছদ দিয়েই এই কোলাজটা তৈরি। কি অপূর্ব তাই না? এমন আর্টিস্টিক ঘর দেখতেও যেমন ভালো লাগে থাকতেও তেমনি ভালো লাগে। চারপাশে বইয়ের গন্ধ শব্দের ফিসফিস, আর প্রবল একাকিত্বের মাঝে অনন্তের ধ্যান। কোন প্রকাশকের বাড়ি যে এত সুন্দর রুচি সম্পন্ন হয় তা ভাবিনি। কারণ তাদের তো থাকতে হয় গাদা গুচ্ছের বই আর প্রিন্ট আউটের মাঝে। দাদার সেরকম এলোমেলো কোন ব্যাপার নেই। যাইহোক এই কোলাজটা দেখে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম আমার যখন অনেকগুলো বই হয়ে যাবে সবার প্রচ্ছদ নিয়ে আমি একটা মিষ্টি কোলাজ বানাবো। আদৌ কটা বই হবে তা কিন্তু জানিনা। কিন্তু স্বপ্ন দেখতে মানা কি বলুন একাজে তো আর ট্যাক্স লাগে না। হা হা হা
সকাল থেকে বেরিয়েছিলাম এবং বাইরে খুব একটা বাথরুমে যাওয়ার অভ্যাস নেই দাদার বাড়ির ছিমছাম পরিবেশ থেকে একটু হাত মুখ ধুতে চাই, উনি তার মায়ের ব্যবহার করা বাথরুম খুলে দিলেন। মা যে নেই তা যেন বোঝাই যায় না, বাথরুমের কোন কোণে কোথাও ভুল করেও একটুও ধুলো ময়লা যত্নে কিংবা অযত্নে পড়ে নেই। বাথরুমে যাওয়ার পথেই
ডাইনিং টেবিল পেরিয়ে গেলাম। দেখুন ডাইনিং টেবিলটাতেও কি সুন্দর কয়েকটা বই এলোমেলো করে রাখা। ওগুলো কিন্তু যত্ন করেই রাখা এমন নয় দাদা ভুল করে ওখানে রেখেছেন।
এত সাজানো ঘর দেখে আমি মিষ্টি করে বললাম দাদা কয়েকটা ফটো তুলতে পারি? উনি আর না বললেন না, টুকটুক করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। সাথে আমাদের যে উদ্দেশ্যে যাওয়া সেই কাজও গোছাতে লাগলাম। বেশ কিছু বই হাতে নিয়ে দেখলাম ওনার কাজের কোয়ালিটি কেমন, এক কথায় অসাধারণ কাজ করেন উনি। বইয়ের সাথে বেশ ভালো সময় কাটান এ কথা বলার সাথেই বলেছিলেন প্রকাশনী যেন একটা পানিশমেন্ট। ওনার এক ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আছেন যিনি মাঝেমধ্যেই ওনাকে দিয়ে বই করান, তার গল্প করলেন। বললেন তিনি নাকি ছাব্বিশটা কবিতা দিয়ে বলেন একশ'বারো পাতার বই করে দিতে। ভাবুন তো! সেই কোথায় কোথায় থেকে ছবি টবি খুঁজে এনে উনি বাণীও দিয়েছেন সেই বয়স্ক ভদ্রলোকের জন্য। শুধু তাই নয় এ বছর অনুষ্ঠান করে তার প্রাপ্য সম্মানিও তুলে দিয়েছেন। বাংলা ভাষার প্রতি নিতান্ত ভালবাসা না থাকলে এমন কাজ করা যায় না। কারণ এই সমস্ত ছোট ছোট প্রকাশকরা যে বিরাট লাভের ব্যবসা করেন তা কিন্তু নয়। কেবলমাত্র ভালবেসেই করে যান।
আমাদের এই ব্যস্ত জীবনে কাজের মধ্যে এরকম একটা মিষ্টি সন্ধে পেয়েছিলাম খানিকটা রিফ্রেশমেন্টও ছিল। আসলে বেড়ানো মানে যে কোথাও কোন জায়গায় গিয়ে বসতে হবে তা নয়, মাঝেমধ্যে নিজের পরিচিত গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এরকম অভিনব সন্ধ্যে কাটালেও মন অনেক প্রসন্ন থাকে।
শেষমেষ আর চা খেলাম না। বাইরের অনেকগুলো পাম গাছের গা ঘেঁষে বেরিয়ে এলাম শুনশান রাস্তায়। একটু পথ এগিয়েই দমদম মেট্রো স্টেশন, আমি উঠে চলে গেলাম যেখানে রাত কাটাবো সেখানে, আর কৌশিকদা তার দুই চাকায় লাথি মেরে ফিরে গেল বাড়ি।
আপনারা সবাই আমাদের শুভকামনা জানান, যাতে আমাদের পত্রিকা সুন্দর ভাবে প্রকাশ করতে পারি এবং পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। মানে ঐদিনের ঐ সন্ধের সুন্দর সময় যেন বিফলে না যায়।
আজ আপনাদের সাথে পুরনো কলকাতার অলি গলিতে এক পুরনো বাড়ির মধ্যে থাকা প্রকাশকের দেখা এবং তার বাড়ি ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। আশা করি ভালই লাগবে পড়ে। আবার আসব অন্য কিছু নিয়ে। আজ এ পর্যন্তই।
টা টা
পোস্টের ধরণ | প্রকাশকের বাড়ি ভ্রমণ ব্লগ |
---|---|
ছবিওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/neelamsama92551/status/1856989834553765975?t=wfUwyGWKwr9FNaOz94WXzA&s=19