ক্ষণস্থায়ী জীবন // ১০% পেআউট লাজুক খ্যাঁক-কে
নমস্কার,
মানুষের জীবন এই আছে এই নেই। আজকে সকালে একজনকে দেখলাম, সেই মানুষটাকে আগামীকাল হয়তো নাও দেখতে পারি। অনিশ্চয়তা নিয়ে বেঁচে থাকা! তবুও মানুষের অদ্ভুত দম্ভ। ক্ষমতার দম্ভ, পদের দম্ভ, অর্থের দম্ভ, যশের দম্ভ। মৃত্যু কখন এগিয়ে আসবে সেটা জানা নেই অথচ অহং-এর অন্ত নেই।
শুরুটা ২০১৮ সালে, পাশের বাড়ির দাদার এক বাংলাদেশী আত্মীয় ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। নাজমুল মামা। মামা ভারতেই চিকিৎসা করানো স্থির করে, অথচ তাঁর ভারতের কিছুই জানা নেই। বাধ্য হয়েই ভারতে বসবাসকারী সব আত্মীয়দের কাছে সাহায্য চান, যদিও আর্থিক সহায়তা না, তার চিকিৎসায় সাথে সাথে থাকার সাহায্য। স্ত্রী-সন্তান ছোটো হওয়ায় তাঁদেরকে নিয়ে আসতে পারেননি, নইলে তারাই যেতো। অসহায় অবস্থা দেখেও সমস্ত আত্মীয়রা নানান অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।
আমিই এমত অবস্থায় এগিয়ে যাই, নাজু মামাকে নিয়ে ভেলোর নিয়ে যাই। ভেলোর সিএমসি মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার খাতিরে দু মাস একসাথে কাটিয়েছি। নিউরোলজি ডিপার্টমেন্ট, রেডিওলোজি ডিপার্টমেন্ট সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি। হাতের তালুর মতোই সব চেনা ছিলো। প্রথম থেকে আবার সব টেস্ট করে অপারেশনের তারিখ পেতে তিন সপ্তাহ কেটে যায়। অনেক অনুরোধে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে অপারেশনের দিন পাওয়া যায়, নির্ধারিত তারিখেই অপারেশন হয়। অপারেশন ঠিকঠাকই হয়। আমার এদিকে দুমাস ছুটি নিয়ে নভেম্বর-ডিসেম্বর ভেলোরে কাটিয়ে দিলেও জানুয়ারিতে পরীক্ষা এগিয়ে আসে, আমি দায়িত্ব থেকে কয়েকদিনের ছুটি চাই। এসময়েও দিন পনেরোর জন্য আর মামার কোনো ভারতীয় আত্মীয়ই এগিয়ে আসেনি।
নাজু মামা বাধ্য হওয়ার টিউমারের অপারেশন শেষ করে চলে যান ঢাকায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজে কেমোথেরাপির সাথে বাকি চিকিৎসা করাতে। আমি যদিও পরামর্শ দিই অপারেশন পরবর্তী চিকিৎসাটা এখানেই করার।
বাংলাদেশ ফিরে যাওয়ার আগের মামার সাথে আমার বেশ মনোমালিন্য হয়ে যায়, যেসব আত্মীয়রা দুর্দিনে সাহায্য করতে এক পা এগিয়ে আসেনি তাদের কথায় আমাকে একটা বিশেষ কারন নিয়ে সন্দেহ করে। সত্যি বলতে আমার খারাপ লেগেছিলো। তবে সেটা আমাকে সন্দেহ করায় না, মামার অসময়ে এগিয়ে না আসা লোকের কথা বিশ্বাস করায়।
আমার একটা অন্যতম বাজে স্বভাব হলো, নিজের ক্ষতি করে হলেও অন্যদের প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া। যেটা একদমই ঠিক না, নিজের ক্ষতি করে কাউকে সাহায্য করাটা সত্যিই বোকামি। হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম।
ভেলোর সিএমসি ছাড়ার আগে ওখানের ডাক্তারবাবুরা বছরে দুবার অন্তত সিটিস্ক্যান করানো অবশ্যক বলে তবেই ছাড়েন। নাজু মামার সাথে পরে এক দুবার কথা হলেও, আমিই নিজে থেকে যোগাযোগ কমিয়ে দিই।
২০১৮ সালের পর এবার চলে আসি ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে, একদিন দেখি হঠাৎ অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসছে, ফ্রড কল ভেবে প্রথমে কেটে দিলেও ফোন করতেই থাকে। আমি বেশ সন্দিহান হয়েই ফোনটা রিসিভ করি, ওই পার ভেসে এলো ক্ষীণ গলায়...
-"মামা, কেমন আছো?"।
কথা শুনেই আমি চিনতে পারলাম, গলাটা নাজু মামার। বছর তিনেক পরে কথা হচ্ছে, ভালো মন্দ নানান কথা হলো। এ কথায় ও কথায় জানতে পারলাম, মামার নাকি আবার টিউমার ধরা পড়েছে, সাথে বাঁ হাত ও পা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। আমি শুনেই আঁতকে উঠলাম! এতোদিন বিশেষ খোঁজখবর ছিলো না, এখন শুনছি বিছানায় শয্যাশায়ী।
ভারতে আবার চিকিৎসা করাতে আসবে তবে এবার এক ভাগ্নেকে নিয়েই আসছে। আমার শুধু কাজ ভেলোর যাওয়ার ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করে দেওয়া! আমি ভেলোর যাওয়ার দিনক্ষন শুনে নিই, আর নাজু মামাকে বলেই দিই, ভারতের ভিসা পেলেই যেন আমাকে জানিয়ে দেয় তাহলে আমি আগে থেকেই ট্রেনের টিকিট কেটে রাখবো।
তারপর দুর্গা পুজো কেটে গেলো, কালী পুজোও শেষ। আমার সাথে নাজমুল মামা আর যোগাযোগ করেনি। হঠাৎ আজ দুপুর ১২ টার দিকে একটা অচেনা ভারতীয় নাম্বার থেমে ফোন, রিসিভ করতেই নাজু মামার গলা,
-"মামা আমরা বেনোপোল দিয়ে ভারতে ঢুকেছি, লোকাল ট্রেন ধরে কলকাতা আসছি। আমাদের ট্রেনের টিকিটটা কেটে দাও মামা।"
ঘন্টা খানেকের অনেক চেষ্টায় দুটো ট্রেনের টিকিট জোগাড় করতে পারলাম, দাম শুনে অবাক। ট্রেনের টিকিটের দাম আর প্লেনের টিকিটের দাম প্রায় সমান, তাই আমি মামাকে পরামর্শ দিলাম, তাঁরা যেন প্লেনে যায়। কাজের ফাঁকে সময় বের করে মামাদের রাত ৯:২৫ এর প্লেনের টিকিট কেটে নিলাম।
সন্ধ্যের দিকে কাজে খানিকটা ব্রেক নিয়ে নাজু মামার টিকিট পৌঁছাতে এয়ারপোর্টে চলে গিয়েছিলাম, তখন সাড়ে ছটা বাজে। নাজু মামাকে প্রথমে দেখে চিনতেই পারিনি, ২০১৮ র আর ২০২১ সালের মধ্যে যেন আকাশ পাতাল তফাৎ।
তরতাজা একটা মানুষ নেতিয়ে গেছে, মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেলো। কিছু সময় বসে গল্প করে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকিয়ে যখন কাজে ফিরছিলাম, একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিলো, মানুষের কিসের এতো দম্ভ। দুদিনের জীবন সবাইকে সাথে নিয়ে বাঁচা যায়না?
250 SP | 500 SP | 1000 SP | 2000 SP | 5000 SP |
ঠিক বলেছেন ভাইয়া আমাদের জীবনের এক সেকেন্ডের ও ভরসা নেই ।তারপরও আমরা বছর বছর বেঁচে থাকার পরিকল্পনা করে যাই ।আপনি খুবই ভালো একটি কাজ করেছেন। বিপদের মানুষকে সাহায্য করার মত ভালো কাজ আর কি হতে পারে। আপনি পুরনো সবকিছু ভুলে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এটি আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। শুভকামনা রইল আপনার জন্য এবং দোয়া রইল আপনার মামার জন্য।
অহংকার আর অমরত্বের ভ্রান্ত ধারণা আমাদের অন্ধ করে দেয়।
একদম ঠিক বলেছেন দাদা।কথায় আছে-মানুষ মরে যাবে কিন্তু হিংসা ছাড়বে না।তাছাড়া যাদের বিপদে এগিয়ে যাওয়া হয় শেষ পর্যন্ত তারাই দোষারোপ করে।এটি অনেকের ক্ষেত্রে হয় আমি ও দেখেছি।নিজে অসুস্থ অবস্থায় নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা রাখতে ছুটে গিয়ে ও সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরে।অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
কৃতজ্ঞতা দরকার নেই, তবে মানুষের মতো আচরনটা তো আমাদের প্রাপ্তি। তাইনা?
👍
ভাইয়া আপনার প্রশংসা না করে পারি না।আপনি খুব ভাল মনের মানুষের পরিচয় দিয়েছদন। এমন মানুষ এখন পাওয়া যায় নাকি।সত্যি শেষ বিষয়টা খারাপ লাগল।নাজু মামা অন্যর কথাউ ভুল বুঝলো।বুঝেছি আপনার কতোটা কষ্ট লেগেছে।
আমি বোকা মানুষ ভাই! তাই এগিয়ে যাই, তবে নিজের ক্ষতি করার সাহায্য কমিয়ে দিয়েছি। তুমি করতে যেও না।
জী ভাই।
জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা কবে।
আপনার প্রতি ভালবাসাটা আরও বেড়ে গেল।দাদা প্রতিবেশী এক দেশের মানুষের জন্য এতটা হয়তো আমি নিজেও করতাম না। যতোটা আপনি করেছেন। যেখানে নিজের আত্মীয়রা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।আশাকরি আপনার নাজু মামা সুস্থ হয়ে যাবেন।এসবের উপর মানুষের কোন হাত নেই। সৃষ্টিকর্তা যা করে ভালোর জন্যই করে।আপনি ভালো থাকবেন দাদা।ধন্যবাদ।
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা থাকবে, উনি সুস্থ হোন। ধন্যবাদ ভাই 🤗
💖💖
আসলে আমরা বেঁচে আছি এটা অস্বাভাবিক, মরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। একদিন তো যেতেই হবে এটা চিরসত্য।
ডাক পড়লেই যেতে হবে।
অনেক সুন্দর লিখেছেন ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে।
জন্ম-মৃত্যু বাদ দিয়ে বাকি সবই পরিবর্তনশীল। অহংকারের কারনে মানুষ সেটা ভুলে যায়।
একদম ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ ভাই।
দাদা,আমরা মানুষ প্রথমে ভুল সিদ্ধান্ত নেই।দূরের মানুষ গুলোকে আপন করতে বিশ্বাস করতে অনেক টা সময় নিয়ে থাকি।নিজের আত্মীয় রক্তের সম্পর্কে আগে বেশি গুরুত্ব দেয়। দাদা, আপনার এই লেখাটি পড়ে আমার খুবই ভালো লেগেছে। কারণ আপনি একজন সহজ সরল মানবের তরে নিবেদিত প্রাণ আপনার।
দাদা, আপনার মামা সেই ভুলটি বুঝে দীর্ঘ তিন বছর পরে আপনার সাথে আবার যোগাযোগ করেছে, তিনি তখন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সিদ্ধান্ত ভুল বলছিল সেটা তিনি বুঝেছি।
ধন্যবাদ দাদা, এত সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের মাঝে শেয়ার করেছেন।
জীবনের মূল্যবান সময় কেউই অন্যের জন্য দিতে চায় না। যতই সে আত্মীয় হোক। আমি শুধু মানুষ হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। ধন্যবাদ দিদি 🤗
অপারেশন এর আগে আর কলকাতার বিমান বন্দরের ছবি দেখে মানুষ চিনার উপায় নেই। আসলেই একটা তরতাজা মানুষ অসুখে পরে কতটা অসহায় হয়ে যায় এই ছবিগুলো দেখলেই বুঝা যায়। তবে দোয়া করি যেনো সুস্থ হয়ে যায়। এই ছাড়া আর কি বলার আছে!
আপনার মতো মানুষ খুঁজে পেলে আসলে আর কি লাগে!কি সুন্দর শেষেও সাহায্য করছেন এসবের পর ও।
মানুষ তো এমনই, স্বার্থপর। অন্যদের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে। আমার সরলতার সুযোগ অনেকেই নিয়েছে। বন্ধু, আত্মীয়, সবাই। তবুও আমি সাহায্য করা ছাড়িনি। শত্রুকেও দুঃসময়ে সাহায্য করেছি, সেখানে তো নাজু মামা ভুল বুঝেছিল। তখন যদিও খারাপ লেগেছিলো, তবে আমি এসব মনে রাখিনি।
ঈশ্বরের কাছে আমারও একই প্রার্থনা, উনি সুস্থ হয়ে স্ত্রী-সন্তানের দেশে কাছে ফিরে যাক। পরিবারটা শান্তিতে বেড়ে উঠুক।
আমাদের এই দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, এইসব জানার পরেও আমরা ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি, মর্যাদা , অহংকার এগুলোর পেছনে ছুটে বেড়ায় ।কিন্তু একটা সময় আসবে যখন এই সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে আমাদের এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে।
এই সমাজে এমন অনেক বিবেকহীন লোক রয়েছে যারা নিজের আত্মীয়দের বিপদের সময় পাশে থাকে না এবং নানান অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। অন্যদিকে আপনার মত কিছু মানুষ রয়েছে যারা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের বিপদে আপদে সাহায্য করে কিন্তু উপকারীর উপকার গুলো খুব কম মানুষই মনে রাখে, সত্যিই এটা দুঃখজনক। শুভকামনা রইল আপনার জন্য ভাইয়া।
ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি, মর্যাদা এগুলো তো কোনোটাই খারাপ না, যদি এগুলো কারো ক্ষতি না করে অর্জন করা হয়। কিন্তু এসবের অহংকার থাকা খুবই খারাপ। অহংকার মানুষকে ঠিক ভুলের পার্থক্য ভুলিয়ে দেয়।
সুসময়ে মানুষ সাহায্যের কথা ভুলে যাবে অপবাদ দেবে, এটাই স্বাভাবিক। এসবের মধ্যে নিজের মানবিক দিকটা ধরে রাখতে হবে। ধন্যবাদ ভাই 🤗
কার জীবন যে সৃষ্টিকর্তা কোথায় শেষ করছে তা আমরা কেও ই জানিনা। আপনার এই মনোভান দেখে ভালো লাগলো ভাই। আপনি একজন ভালো মনের মানুষ। অন্য মানুষ হইলে রাগ করে কথাউ বলতো না পরে। আপনি তাও সাহায্য করলেন। আপনি ওদের মতো মানুষের দোয়াতেই ভালো থাকবেন ভাই।
মানুষ হয়েই জন্মেছি মানুষ হয়েই মরতে চাই। ধন্যবাদ ভাই 🤗
প্রতিটি নিঃশ্বাসই আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আমার মৃত্যুর এক পা কাছে । কখন যে এই নিঃশ্বাস ছেড়ে চলে যাবে কারো জানা নেই। সেজন্য আমাদের সব সময়ই অন্যের সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত যাতে তারা যখনই আমাদের কথা মনে করবে মুখে একটা হাসি ফুটে উঠবে। বিরক্তির ভাব নয়। আমি নিশ্চিত যে আপনার মামা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন পর্যন্ত আপনার কথা যখনই তার স্মরণ হবে তার মুখে অজান্তে একটা হাসি ভেসে উঠবে।