প্রতিযোগিতা - ০৬: অবলুপ্তির পথে বালুরঘাটের নাট্য ঐতিহ্য // ১০% পেআউট লাজুক খ্যাঁক-কে

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago



নমস্কার,

সময়ের সাথে সাথে অবলুপ্তির পথে নানান লোক সংস্কৃতি। ইন্টারনেট, মোবাইলের চাপে হারিয়ে চলেছে বহু ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। আজকে আমার জেলারই হারিয়ে যেতে বসা সংস্কৃতির সম্পর্কে কিছু কথা আলোচনা করবো।


ইতিহাস বিজড়িত জেলা দক্ষিন দিনাজপুর। বরেন্দ্রভূমের এই মাটি সেন-পাল যুগ থেকেই সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। ভিন্ন ভাষাভাষি এবং নানা সম্প্রদায়ের সংমিশ্রণে জেলার সংস্কৃতি অনেকটাই মিশ্র প্রকৃতির। জেলার সদর বালুরঘাট, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনেই বালুরঘাট মহকুমা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, এরপর থেকেই বালুরঘাটে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত লোকের আনাগোনা বাড়তে থাকে, পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এনাদের হাত ধরেই নাট্য শিল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়।


বালুরঘাটের নাট্যমঞ্চ | w3w


১৯০৪ সালে বালুরঘাট মহকুমা আত্নপ্রকাশের পর থেকে কার্যসূত্রে পাবনা, ঢাকা, রাজশাহী, যশোর জেলা থেকে বহু মানুষ বালুরঘাটে এসে বসত করেন। তৎকালীন বালুরঘাটে স্টেজ বেঁধে নাটক অভিনয় হলেও, কীর্তন ও যাত্রাগানই ছিলো মূল অনুষ্ঠান। ১৯০৯ সালে কিছু নাট্যঅনুরাগী মানুষদের প্রচেষ্টায় প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পায় আমার জেলার নাটক, গঠিত হয় বালুরঘাট থিয়েট্রিক্যাল এসোসিয়েশন। সে বছরেই জেলা প্রশাসন এবং সংস্কৃতি মনস্ক মানুষের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে নাট্যমন্দির, যা আজকেও মাথা উঁচু করে নাটক পরিবেশন করে জেলার মান বাড়িয়ে চলেছে।


নাট্যমন্দির | w3w

৪০ এর দশকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল, সে সময়ে বালুরঘাটের নাট্যসমাজ জড়িয়ে পরে নানান রাজনৈতিক কার্যে। এই বিষয়টি অনেক নাট্যকর্মী মেনে নিতে না পেরে এই রাজনৈতিক নাট্যাভিনয় থেকে সরে গড়ে তুললেন নানা নাট্যগোষ্ঠী। এনাদের হাত ধরেই পাঁচের দশকে বালুরঘাটে প্রকাশ পায় ত্রিতীর্থ, নাট্যতীর্থ, তরুণতীর্থ প্রভৃতি। যা রূপ দেয় নব্যনাট্য আন্দোলনের।

ত্রিতীর্থ | w3w
নাট্যতীর্থ |w3w

তৎকালীন স্বাধীনতাত্তোর ভারতের উদ্বাস্তুদের দুর্ভোগ ফুটে ওঠে, তুলসী লাহিড়ীর ছেঁড়াতার, ডঃ মন্মথ রায়ের জীবনটাই নাটক কিংবা ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোর নাটকের মাধ্যমে। ৫০ শের দশক থেকে ৭০ এর দশক পর্যন্ত ছিলো বালুরঘাট নাট্যের স্বর্ণযুগ। বালুরঘাটের মুকুটে জুড়তে থাকে নানান পালক। ১৯৬৯ সালে পাটনায় অনুষ্ঠিত সারাভারত নাটক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ দল, শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার জিতে নেয় ছেঁড়াতার নাটকটি।


৭০ দশকের পরেই নানান রাজনৈতিক চাপে কমতে থাকে নাটকের মান। অতিরিক্ত রাজনৈতিক দখলদারিত্বের ফলেই বহু নাট্যব্যক্তিত্বই দূরে সরতে থাকেন। ধীরে ধীরে বাংলা সংস্কৃতি কলকাতা কেন্দ্রিক হওয়ার ফলেই জেলা হতে থাকে উপেক্ষিত হয়েছে, এর কারণেই পরবর্তী প্রজন্ম নাটকের উপরে আগ্রহ হারায়।


নাট্যকার ডঃ মন্মথ রায় কে নিয়ে আলোচনা হলেও তাঁর নাট্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ বালুরঘাট সেভাবে কোনদিনই প্রচার আলোতে আসেনি। এ বিষয়ে লেখক এবং রচয়িতারা জেলার সৃষ্টি কোনদিনই ভালো দৃষ্টিতে দেখেননি, তাই আজানাই থেকে গেছে আমার জেলার এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। ধীরে ধীরে প্রচারের বাইরে থাকার জন্য অর্থনৈতিকভাবে ঝিমিয়ে পরে আমার জেলার এই ঐতিহ্য, সাথে অলাভজনক হওয়ায় বর্তমান প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যায় নাটকের মাধুর্য্য।

অনেকেই বালুরঘাট ছেড়ে কলকাতায় এসে নাটক দলে যোগ দেয়। বালুরঘাটে কাজের অভাব তো রয়েছেই, যেটুকু কাজ আছে তার সাথে নেই বিশেষ অর্থনৈতিক সহায়তা। মানুষের নাটক দেখার অনিচ্ছা কারণেই হয়তো খুব শীঘ্রই হারিয়ে যাবে বালুরঘাটের এই ঐতিহ্য। এখন শুধুই দিন গোনা...


নাটকের কিছু লিঙ্ক:

১০% পেআউট @shy-fox কে

Sort:  
 3 years ago 

বালুর ঘাটের নাট্য ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পেরে ভালো লাগলো।নাটকের মধ্যে অনেক প্রাণবন্ত কবিসত্তা খুঁজে পাওয়া যায়।ধন্যবাদ দাদা,সুন্দর বিষয় তুলে ধরার জন্য।

 3 years ago 

কলকাতা বাদ দিয়েও যে জায়গাগুলোয় নাটক হয় সেগুলো কপালে শুধুই উপেক্ষা।

 3 years ago 

ভাইয়া আপনি অনেক সুন্দর একটা পোস্ট উপহার দিয়েছেন। অতীত অতিসত্বর হারিয়ে ফেলেছি। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানবে সংস্কৃতি ঐতিহ্য বলতে কিছু ছিল। আমাদের গ্রাম গঞ্জে সংস্কৃতি বলতে এখন কিছু নেই বললেই চলে। সবটাই হারিয়ে গেছে ডিজিটাল যোগ এসে। আপনি অনেক সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। অজানা অনেক কিছু জানলাম। আপনার জন্য শুভকামনা রইলো ভাইয়া

 3 years ago 

ডিজিটাল রেভলিউশন যতটা ভালো লোক সংস্কৃতির জন্য ততোটাই খারাপ। হয়তো ভবিষ্যতে অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বালুরঘাট নিয়ে আপনি খুব সুন্দর ভাবে তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছেন।খুবই সুন্দর উপস্থাপনা ছিলা।জায়গাটি সম্পর্কে অনেক তথ্য আমাদের মাঝে শেয়ার করেছেন।অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর পোস্টটি শেয়ার করার জন্য।শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য।

 3 years ago 

আমার জেলার এটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ধন্যবাদ 🤗♥️

 3 years ago 

বালুরঘাট নাট‍্য ঐতিহ্যের কথা আপনার মুখ থেকে শুনেছিলাম প্রতিযোগিতা যেদিন শুরু করা হয় সেদিন হ‍্যাংআউটে। আশায় ছিলাম এই বিষয়ে আপনার থেকে একটা পোস্ট পাব। কিন্তু একটু দেরিতে পেলাম। বালুরঘাট নাট‍্য মন্দিরের বিষয়গুলি জেনে ভালো লাগল।

 3 years ago 

গত কয়েকদিন সময় একটু কম পেয়েছি তাছাড়া রিসার্চ করতে একটু সময় লেগে গেলো।

 3 years ago 

বুঝলাম দাদা।

 3 years ago 

আপনার পোস্টটি আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। আপনি পুরোনো ঐতিহ্যকে খুব সুন্দর উপস্থাপন করেছেন ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারলাম পোস্টের মাধ্যমে।
শুভ কামনা আপনার জন্য 💌

 3 years ago 

বিশেষ পুরোনো না হলেও আমাদের জেলার ঐতিহ্য বটেই। আজ পুরোপুরি বিলুপ্ত না হলেও এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা

 3 years ago 

অপেক্ষা করছিলাম আপনার তরফ থেকে এমন কিছুর। আমার এই যাত্রাগান ব্যাপারটা একদম আলাদা লাগে। আসলে এই ইন্টারনেট দিচ্ছে অনেক কিছু তবে নিয়ে নিচ্ছে আবেগের অনেক কিছু।
সবটাই হারিয়ে যাবে আধুনিকতার ছোয়ায়।জানবো শুধু এমন কিছু পোস্টের মাধ্যমে। ভালো লাগলো খুব❤️

 3 years ago 

যাত্রাগানটা ভিন্ন। এটা স্টেজ করে নাটক। আগে প্রতিবছর বেহুলা লখিন্দরের যাত্রাগান দেখতাম। আগে মর্ম বুঝতাম না তবে এখন মনে হয় আগে আরো কেন দেখিনি।

 3 years ago 

বালুরহাট নাট্যমঞ্চ নিয়ে অনেক সুন্দর তথ্য দিয়েছেন ভাইয়া। আমাদের উচিত হারিয়ে যাওয়ায়া ঐতিহ্য ফিরে আনা। ধন্যবাদ আপনাকে

 3 years ago 

এই সময়ে নাটকের পুরোনো সময় ফিরিয়ে আনা মুশকিল তবে চেষ্টা করা যেতেই পারে। কিছু বন্ধু বান্ধব চেষ্টা করছেও।

 3 years ago 

অনেক কিছু জানতে পারলাম। তোমার জেলার ঐতিহাসিক জায়গা বালুর ঘাট সম্পর্কে। যেখানে সংস্কৃতির ভান্ডার। সাহিত্যে শিল্প কলা জগতের ছোঁয়া জায়গা টির বিশেষত্ব বাড়ানোর সাথে সাথে লেখনীর নিপুন ছোঁয়া জায়গাটিকে আরোও ইতিহাস তৈরি হওয়ার সাথে সাথে পরিচিতির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আজ সেই ঐতিহ্য নাট্য কলা দেখা যায় না তেমন বালুরঘাট এ। তা যেন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সত্যিই বেশ ভালো লাগলো। ঐতিহাসিক জায়গা সংস্কৃতি ও ইতিহাস জানতে পেরে ।ধন্যবাদ তোমাকে দাদা।

 3 years ago 

প্রযুক্তির উতকর্ষতার কারনে আমরা অনেক সুন্দর এই ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলছি আমার মনে হয়। কারন এখন সিনেমা নাটক সব বাদ। সবকিছু ইউটিউব। আগে আগে কোথায় গিয়ে যে আমরা থামব।

 3 years ago 

স্টেজ নাটক সত্যিই হারিয়ে যেতে বসেছে, যেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

Coin Marketplace

STEEM 0.29
TRX 0.12
JST 0.033
BTC 63318.34
ETH 3108.17
USDT 1.00
SBD 3.97