আজ মহালয়া। বাঙালি জীবনে মহালয়ার গুরুত্ব এবং তাৎপর্য।
আজ মহালয়া। দুর্গোৎসবের শুভ সূচনার দিন
আজ মহালয়া। দেবী পক্ষের সূচনা হয় এই দিনে। দেবীপক্ষ অর্থাৎ মা দুর্গার আগমনে সারা পৃথিবীতে জয়ডঙ্কা বাজাবার দিন। পিতৃপক্ষের অবসানের মধ্যে দিয়ে সূচনা হয় এই দেবীপক্ষের। আজ মহালয়ার দিন মানুষ তার পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জল দেয়। পুরাণ মতে আজকের এই দিনে মৃত পিতৃপুরুষগণ চলে আসেন মনুষ্যলোকের খুব কাছাকাছি। তাই এই এক পক্ষকাল যাবত জল দান করলে তা সহজেই পৌঁছে যায় পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে। আর সেই কারণে এই এক পক্ষকাল তর্পণের মাধ্যমে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জলদান করা হয়। আর তাঁদের মৃত আত্মাও সেই জল পেয়ে তৃপ্তি লাভ করে। যদিও আজকের দিনটি শুভ না অশুভ এ নিয়ে বাঙালির মধ্যে তর্কের শেষ নেই। পিতৃপক্ষের অবসান কাল হিসেবে অনেকে মনে করেন আজকের দিনটি শুভ নয়, আবার পক্ষান্তরে এটিও সত্য যে শাস্ত্রমতে যে কোনো শুভ মুহূর্ত শুরুর আগে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে জল দান করতে হয়। আর তাই দেবীপক্ষের মতো শুভ মুহূর্ত সূচনার আগেও পিতৃপুরুষকে জলদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবীপক্ষ। তাই মহালয়া তিথি কখনোই অশুভ তিথি নয়। পুরাণ মতে আজকের দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব লাভ করেন দেবতাদের হাত থেকে। আমরা জানি মহিষাসুরের অত্যাচারে জর্জরিত দেবতারা শরণাপন্ন হন ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর এর কাছে। তাদের মিলিত শক্তিপুঞ্জ থেকে উৎপন্ন দেবী মহামায়া মহিষাসুরকে বধ করতে উদ্যত হন। এরপর এক দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে বধ হয় মহিষাসুর। আসলে মহিষাসুর এক অশুভ শক্তির আধার। শাস্ত্র এবং পুরাণের মাধ্যমে আমরা শুভ এবং অশুভকে সূচিত করে মানুষের জীবনে মঙ্গলময় ফলের প্রত্যাশা করি। আজ মহালয়ার দিনটা তাই বাঙালি জীবনে এক বিশেষ মাহাত্ম্য রাখে।
এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে আজ বাঙালির সব থেকে বড় উৎসব দূর্গা পূজার সূচনা। বলা হয় এই পুজো পৃথিবীর সব থেকে বড় উৎসব। আর তাই ইউনেস্কো থেকেও বাংলার দুর্গাপুজোকে হেরিটেজ তকমা দেয়া হয়েছে কয়েক বছর আগে। সেই মহাউৎসব দূর্গাপূজার সূচনা আজকের দিন থেকেই। এইদিন থেকেই দেবী পক্ষের সূচনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালির দিন গোনা। প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, করে গুনতে গুনতে এসে হাজির হয় মহাষষ্ঠীর সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তটি। জয় বাবা ফেলুনাথ এর সেই বিখ্যাত ডায়লগ টা মনে আছে? ফেলুদা শিল্পী কে জিজ্ঞাসা করছেন,
পরশু তো ষষ্ঠী, আপনার কাজ তার মধ্যে শেষ হবে?
মহাষষ্ঠীর প্রাক্কালে বাঙালির কাছে এই ডায়লগ এক বিশাল গুরুত্ব রাখে। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি এই দুর্গাপূজার পাঁচটা দিনের জন্য। নতুন জামা নতুন প্যান্ট পড়ে ছোট ছোট শিশুরা বাবা মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে ঠাকুর দেখতে। তাই মহালয়ার দিন আপামর বাঙালির কাছে এক মহা উৎসবের সূচনালগ্ন।
আর মহালয়া বলতেই যা প্রথম মাথায় আসে তা হলো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কালজয়ী চণ্ডীপাঠ। আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত এই প্রভাতী অনুষ্ঠান বাঙালি জীবনে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। ১৯৩২ সাল থেকে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয় আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে। প্রতিবছর শিল্পীরা মহালয়ার পূণ্য ভোরে মিলিত হতেন সেখানে এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবার জন্য। কিন্তু ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠানটির সম্পূর্ণ রেকর্ডিং করা হয়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মহালয়ার ভোরে কলকাতায় ধ্বনিত হয় -
আশ্বিনের শারদ প্রাতে, বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ীর আগমন বার্তা
আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি...
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের এই জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর ঘুম ভাঙায় বাঙালির। আর শুরু হয় দুর্গোৎসব। আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা। তারপর ঢাকে পড়বে কাঠি। বাঙালি মেতে উঠবে পৃথিবীর সব থেকে বড় উৎসব দুর্গাপুজোয়। সারা পৃথিবীতে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে দুর্গোৎসব হয় না। আমেরিকা ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে দুনিয়ার সমস্ত কোণে পালিত হয় দুর্গাপুজো। আর আজ এই মহালয়ার পূণ্য দিনে, পিতৃপুরুষকে শেষ তর্পণের মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষ শুরুর মহালগ্নে দেবী দুর্গার কাছে আমরা চেয়ে নিই সারা পৃথিবীকে ভালো রাখবার আশীর্বাদ। মঙ্গলময় দুর্গা সকলের জন্য সুখ শান্তি নিয়ে আসুন সেটাই কাম্য আজকের এই তিথিতে।
আজ মহালয়া। তাই এই মহালয়া বিষয়ক পোস্ট আপনাদের ভালো লাগলে নিশ্চয়ই মন্তব্যের মাধ্যমে আমাকে জানাবেন।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/KausikChak1234/status/1841362994015441047?t=yBuVD_j8k45VGUJesVEcNQ&s=19