মাঝে মাঝে নিয়ম ভাঙতে ভালো লাগে।
যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে বোঝার মত একটু বয়স হয়েছে, তখন থেকেই খেয়াল করছি পরিবারের সদস্যদের সাথে আমিও প্রতিদিনই নিজের কাজগুলো নির্দিষ্ট সময় করি। একজন আর্মি অফিসারের সন্তান হবার সুবাদে প্রাথমিক জীবনে গৃহেই আমার কঠোর জীবনযাপন শুরু হয়। এটি যে কঠোর জীবন যাপন এটাও আমি কখনো বুঝতে পারিনি ।ধরে নিয়েছিলাম এটাই স্বাভাবিক। এরপরে ভর্তি হই আর্মি স্কুলে।সেখানে আরো কঠোর নিয়ম। এক মিনিট দেরি হওয়া যাবে না,জোরে কথা বলা যাবে না, প্রতিদিনের পড়া করে রাখতে হবে, বাড়ির কাজ একদম সই সই চাই। কিন্তু সেই কঠোর নিয়মের ভিতরেও অবারিত স্বাধীনতা ছিল। নিশ্চিন্ত মনে আমি ক্যান্টনমেন্টের অলি-গলিতে, প্রাঙ্গনে ঘুরে বেড়াতাম। মেয়ে হয়ে আমি কখনো নিরাপত্তার অভাব কি বুঝিনি।
সেটা ছিল ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলাম। দেখলাম আমার গতিবিধির উপর আরো কিছু পরিবর্তন ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলো। সন্ধ্যার আগেই খেলা শেষ করতে হবে, সন্ধ্যার পরে বাইরে যাওয়া যাবেনা, স্কুল থেকে সোজা বাড়ি, এদিকে ওদিকে যাওয়া যাবে না। এরপর দুপুরে খাওয়ার পর কাইলুলা না আসলেও ঘুমাতে হবে। বিকালে একটু খেলা, সন্ধ্যার আগে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে যেতে হবে। হারিকেনে তেল ভরতে হবে, কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হবে, তারপর পড়তে বসতে হবে।রাতে এক ঘন্টা টিভি দেখা, তারপর শুয়ে পড়ো।
এ ধরনের বাধা ধরা নিয়মে জীবন চলছিল। নিয়ম মেনে যে খুব খারাপ লাগে সেটাও তখনো বুঝিনি। এরপরে আরো বড় হলাম, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে তখন পেরিয়ে কলেজে তখন দেখতাম ভাইয়েরা বারান্দাতেও যেতে দিত না, ছাদে যেতে দিত না।সে কি কঠোর নিয়ম, যেন আমাকে কেউ দেখলে ধরে নিয়ে যাবে। এত হাস্যকর লাগতো তাদের এই শাসন। খুব বিরক্ত হতাম।
এরপর একটা সময় অবতীর্ণ হলাম জীবনের আসল পরীক্ষায়, সংসার নামক খেলা ঘরে। এটাই তোমার দায়িত্ব,এটা করতে হয় না, এ ধরনের কথা বলতে হয় না, এভাবে ভাবতে হয় না, আরো যে কত ধরনের কি করতে হয় না,তার যেন কোন শেষ নাই।
নিয়ম করে রান্না করতে হয়। ঐ নিয়মে আপ্যায়ন করতে হয়। নিয়ম করে ঔষধ খেতে হয়। নিয়ম করে ঔষধ খাওয়াতে ও হয়। খাওয়ার আগে একরকম ঔষধ, খাওয়ার পরে আরেক রকম ঔষধ।অসহ্য লাগে।ঘর গোছাতে হয়,তরকারি কুটতে হয়, মাস ঘুরলে বাচ্চাদের বেতন দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়, সেলুনে নিয়ে যেতে হয়। আর সব ক্ষেত্রে অনলাইনের প্যারা তো আছেই। প্রতিদিন দুধওয়ালার চেহারা দেখতে হয় ।একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না।
মাঝে মাঝে মনে হয় যেন আমার জন্যই বুঝি এতসব নিয়ম। কখনো বাচ্চাদের জন্য, কখনো সংসারের জন্য, কখনো স্বামীর জন্য, কখনো পরিবার-পরিজনের জন্য।শীতকাল এলে এই কাজগুলো করতে হবে,বর্ষাকালে এগুলো ঠিক করে ফেলতে হবে। মেহমান আসবে জানলে প্রস্তুতির কোন সীমা পরিসীমা নেই। মেহমান চলে গেলে তার দাগ ফুরাতেই যেন প্রাণ যায়। এত নিয়ম কেন?এত নিয়ম মানতে হবে কেন?
এমন একটা জীবন পেতে পারি না যেদিন আমার জন্য কোন নিয়ম নেই। যখন খুশি ঘুম ভাঙবে কিন্তু উঠার তাড়া থাকবে না। কাউকে কোন কিছুর জন্য ডাকতে হবে না।কাউকে কোন কিছু বলতে হবেনা।সবকিছু যেন আপনা আপনি হয়ে যাবে।আমার উপর কোন দায়িত্ব আসবে না। কোন কথা আমাকে মুষড়ে দেবে না। কোন দায়িত্ববোধ আমার চা খাবার সময় টা নষ্ট করবে না। একান্ত আপন সে সময়টা একান্তই আমার হবে।
কিন্তু এমন তো হয় না। এখন আমার মন ১৩-১৪ বছরের সেই কিশোর কিশোরীদের মত অবাধ্য হয়ে গেছে। সে কোন শাসন মানতে চায় না। কোন কথা শুনতে চায় না। নিজের মন খারাপ তো সহ্যই করতে পারে না।
কেন আমাকে সদা সর্বদা নিয়মের অন্তঃজালে পেঁচিয়ে থাকতে হবে। আমি চাই অবারিত স্বাধীনতা। আমি চাই মুক্ত বিহঙ্গের মতো এক জীবন যেখানে আমি যে কোন সময় যে কোন স্থানে উড়ে বেড়াতে পারবো। আমার থাকবে পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিক স্বাধীনতা। সত্যিই!!! এটা কি সম্ভব? কেউ আমাকে বাধা দেবে না। কেউ আমাকে কোন আইন-কানুন শেখাবে না।এমন জীবন কি আমি পেতে পারি না?
আমি এমন কাজ করতে চাই যা করতে আমি ভালোবাসি। আমি এমন দায়িত্ব পালন করতে চাই যে দায়িত্ব আমার কাছে প্রিয়। আমি এমন ভাবে জীবন কাটাতে চাই যেমন ভাবে জীবন কাটালে আমি নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করব। কিন্তু জীবন, সে তো আমার মত চলে না। সে তার মত করে আমাকে চালায়। এখন আমি চাই জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে। কিন্তু আমি জানি জীবনের আছে অসংখ্য সমরাস্ত্র,ঢাল-তলোয়ার বন্দুক-পিস্তল। আর আমার কাছে আছে জীবন নামক এক যন্ত্রণা। হাতে অল্প কিছু সময় নিয়ে আমি প্রয়াণের অপেক্ষা করছি। তাহলে কি করে হবে এই অসম লড়াই?
এতকিছুর পরও মন বলে,আসুন একটু নিয়ম ভেঙ্গেই দেখি। মাঝে মাঝে আমার নিয়ম ভাঙতে খুবই ভালো লাগে।
নিয়ম ছিলো তবে এতটা শাসনের মাঝে বড়ো হই নাই। কলেজে ভর্তির পর থেকে যথেষ্ট স্বাধীনতা পেয়েছি। যদিও সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকা কেউ তেমন একটা পছন্দ করতো না কিন্তু এজন্য বাড়াবাড়ি কিছু হজম করতে হয় নাই। ছোট থেকে ছেলেমেয়ে একসাথে পড়েছি এটা তাই ছেলে বন্ধুও ছিলো।তারাও বাসায় আসতো আমরাও যেতাম।একসাথে রিক্সায় কিংবা বাসেও আসা যাওয়া করতাম । আপনার লেখা পড়ে এদিক থেকে নিজেকে লাকি মনে হচ্ছে।
তবে বিয়ের পরে অবস্থাটা অনেকটাই চেন্জ হয়ে গিয়েছিল। শশুড় শাশুড়ির কথার বাইরে কিছুই করা চলতো না। আদর করতো না এমনও না।কিন্তু জোড়ে হাসা, জোরে কথা সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেকটাই।কাজ না জানার কারনে পদে পদে অপদস্ত হতে হতো ।মাঝে মাঝে পালাতে ইচ্ছে করত।এই সময়টায় এসে আপনার সাথে নিজের মিল খুঁজে পেলাম।
যাই হোক এর মাঝেও কিছুটা হলেও নিজের জন্য নিজের মতো করে বাচার চেষ্টা করুন।এত নিয়ম মেনে কি হবে সবসময়।
ভালো থাকবেন সবসময়।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর ভাবে গুছিয়ে মতামত প্রদান করার জন্য।
আপনার জিবন কাহিনী টা পড়ে অনেক ভালো লাগলো।আপনি আপনার কাজ খুব গুছিয়ে করতেন পরিবার এর মানুষের তা দেখে। আপনাকে অসংখ্য আমাদের সাথে আপনার জিবনের কিছু কিছু স্মৃতিময় মুহূর্ত আমাদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন আর পরিবার ও নিজের খেয়াল রাখবেন।
এমন একটা জীবন পেতে পারি না যেদিন আমার জন্য কোন নিয়ম নেই। যখন খুশি ঘুম ভাঙবে কিন্তু উঠার তাড়া থাকবে না। কাউকে কোন কিছুর জন্য ডাকতে হবে না।কাউকে কোন কিছু বলতে হবেনা।সবকিছু যেন আপনা আপনি হয়ে যাবে।আমার উপর কোন দায়িত্ব আসবে না। কোন কথা আমাকে মুষড়ে দেবে না। কোন দায়িত্ববোধ আমার চা খাবার সময় টা নষ্ট করবে না। একান্ত আপন সে সময়টা একান্তই আমার হবে।
সত্যিই আপু ইদানিং আমারও নিয়মের বাইরে বের হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। গতানুগতিক ধারাবাহিকতা সাংসারিক কাজকর্ম থেকে একটু বিরতি। কিছুটা সময় একা নিজের মতো করে কাটানো কোনো কাজের প্রেসার নেই। কোনো কাজের বাধ্য বাধকতা নেই।
যা-ই করিনা কেন দিন শেষে আবার সংসার নামের এই নীড়ে ফিরতে হবে। কারন আমরা বাধা পড়ে গেছি সংসার ধর্মে।
অনেক শুভকামনা রইল আপু।
একদমই ঠিক বলেছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
সুন্দর একটি লেখা উপস্থাপন করার জন্য ধন্যবাদ আপু। আপনি হয়তো নিয়মের ব্যাড়া জালে আটকিয়ে খুবই বিরক্ত। কিন্তু নিয়ম ছিলো বলেই আপনার আশপাশ এত সুন্দর হয়ছে। যদি নিয়মকে উপেক্ষা করে চলতেন তবে এর বিপরীতও ঘটতে পারতো৷ যদিও আপনি বিরক্ত তবুও আমি মনে করি প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই কিছু ধরা বাধা নিয়ম থাকা উচিত৷
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর ভাবে আমার মনের অবস্থা বোঝার জন্য। ভালো থাকবেন
মেয়েদের জন্য সত্যিই অনেক নিয়ম থাকে এটা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের শাসন আর বিয়ের পরে শশুর শাশুড়ির বারণ, স্বামীর বারণ এটা করো না, ওটা করো না। একটা সময় পড়ে গিয়ে সন্তানেরাও মায়েদের বলে যে এভাবে চলোনা। তাদের বন্ধু-বান্ধবের সামনে গেলে নাকি তাদের মানসম্মান চলে যাবে।
আমার জীবনটাও ঠিক এরকমই। বিয়ের আগে বাবা-মা বলতো যে বাড়ি থেকে বাইরে তেমন যেওনা আর এখন বিয়ের পরে স্বামী এবং শ্বশুর শাশুড়ি বলে বাড়ি থেকে কোথাও যাওয়া যাবে না মানুষ খারাপ বলবে। এটাই কি মেয়েদের জীবন আমি সত্যি জানিনা।
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর একটা লেখা আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য। ভালো থাকবেন।
আপনার অনুভূতিগুলো সুন্দরভাবে শেয়ার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আসলে আমাদের জীবনটাই একটা নিয়মের ভেতর পড়ে যায়! আমরা সব সময় এই নিয়মগুলো ফলো করে! আমাদের জীবন পরিচালিত করি! প্রতিনিয়ত ঘুম থেকে ওঠা রান্না করা,,, ছোটবেলা থেকেই এই নিয়মগুলো অনুসরণ করতে করতে বড় হয়ি।
সংসার জীবনেও এই নিয়মগুলো পালন করতে হয়! সন্তানের খাবার রেডি করা ওষুধ খাওয়ানো রান্না করা সবকিছুই একটা নিয়মের ভিত্তিতে চলে,,,, কিন্তু আপনি শেষে যে কথাগুলো লিখেছেন! এমন যদি কোন দিন হতো,,, নিয়ম ছাড়াই সবকিছু আপনা আপনি হয়ে যেত! এটা শুধুই আমাদের কল্পনা।
আসলে এই জীবনটাই হচ্ছে নিয়মের ভিত্তিতে,, কখনো এমন হবে না! এমন শুধু কল্পনায় আমরা করতে পারি,,,, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে,,,,, এত সুন্দর একটা টপিক আমাদের সাথে আলোচনা করার জন্য! আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল! ভালো থাকবেন।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ রুবিনা আপু এতো সুন্দর একটি কমেন্ট করার জন্য।
আমরা প্রত্যেক মানুষ যেমন এক রকম না, তেমনি প্রত্যেক মানুষের চলাফেরা স্বাধীনতা একরকম হয় না। আমরা যে যে পরিবেশে থাকি ঠিক আমরা সেই পরিবেশের নিয়ম মেনে চলি।
আপনার পোস্টটি পড়ে মনে হচ্ছিল আপনাকে অনেকটা পরাধীন মধ্যে রেখেছিল। আপনার ফ্যামিলির সবাই আপনাকে একটু বেশি নজরে রেখেছিল কিন্তু সবাই আপনার ভালোটাই চেয়েছে। বড় ভাই যারা আছে শুধু আপনার ভালোটাই চেয়েছে।
আমরা যখন ছোট থাকি তখন এক রকম থাকি! যখন একটু বড় হয় তখন অন্যরকম হয়! যখন আরেকটু বড় হয় সংসার জীবনে চলে যাই তখন অন্যরকম জীবনে চলে আসে।
আমাদের পৃথিবীটা এভাবেই চলে আসছে, আপনি সবসময় একরকম থাকবেন না এটাই স্বাভাবিক। এতকিছুর মধ্যেও একটু সুখ অবশ্যই আছে।
আপনার জন্য ভালোবাসা রইল, ভালো থাকবেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আমার পোস্টটি এত মনোযোগ সহকারে পড়লেন এবং বিস্তারিত আলোচনা করলেন এজন্য।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের মাঝে এতো সুন্দর একটি পোস্ট তুলে ধরার জন্য, আসলে আপনি মনের কথাটাই বলেছেন আমার্ মনে হয় মেয়েদের জন্য বেশি নিয়ম আমি মনে করি এই এত নিয়মের মাঝেও আমরা নিজেদেরকে কিভাবে ঠিক রাখতে পারি সেটা একমাত্র আমরা নিজেরাই জানি মেয়েদের জন্য কি এত নিয়ম ছেলেদের জন্য কি এত নিয়ম হতে পারেনা, মেয়েদের জন্ম থেকে শুরু হয় সে নিয়ম ,খেলাধুলা নিয়ে ,পড়াশোনা ক্ষেত্রে , কলেজের ক্ষেত্রে সংসারের ক্ষেত্রে, বাচ্চাদের জন্য, স্বামীরজন্য,পরিবার এর জন্য,আর কত নিয়ম যে আছে বলে শেষ করা যাবেনা, আমরা কি চলতে পারি না নিয়ম ভেঙে নিজের জন্য বাঁচতে,হাসতে। মনের মতো যদি জীবন তা চালানো যেত তাহলে আমরা কতই না খুশি থাকতাম।
খুব ভালো লাগলো আপু, আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো ,ভালই থাকবেন।