ইসরায়েলের শক্তির উৎস যেখানে

in #bangladesh6 years ago

‘যে সাহসী সে যুদ্ধে গেছে,

যারা যুদ্ধে যায় তারা ফিরে আসে না।’
—আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

হুইলচেয়ারে বসা ফিলিস্তিনি যুবক আবু সালাহর একটি ছবি এখন ভাইরাল। গুলতি নিয়ে আবু সালাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলেন। সালাহরা কেউ কেউ ফেরে না। এরপরও অমিত সাহসীরা যুদ্ধে যায়। ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়তই যাচ্ছে। লড়ছে গাজা, রামাল্লা, পশ্চিম তীরের জনযোদ্ধারা। দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও মনোবলকে পুঁজি করেই হাজার হাজার জনযোদ্ধা বিশ্বের অন্যতম নৃশংস সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। সোমবারও জেরুজালেমে অবৈধ মার্কিন দূতাবাস স্থাপন এবং নাকবা বা মহাবিপর্যয়ের প্রতিবাদে ইসরায়েলি সীমান্তে গিয়েছিল গাজার অধিবাসীরা। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে ৬১ জন। কী বিস্ময়কর! অ্যান্টিসেমেটিক তকমা লাগার ভয়ে চুপচাপ এই গণহত্যা দেখছে সারা বিশ্ব।

জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়া অনেক কিছুই নির্দেশ করে। মার্কিন-ইসরায়েল বলয় পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিল, দুই´রাষ্ট্রের যে মুলা ঝোলানো হয়েছিল ফিলিস্তিনিদের সামনে তা আসলে শুভংকরের ফাঁকি। এই মুলা ঝুলিয়ে কার্যত ইসরায়েলের পরিধিই বিস্তৃত করা হচ্ছে। এবং ভবিষ্যতে এমন সময় আসবে, যখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আর কোনো ভূমিই অবশিষ্ট থাকবে না।

image sources

দুই´রাষ্ট্র তত্ত্বের মতোই আরেক তামাশা নিয়ে হাজির ক্রমেই এক হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া জাতিসংঘ। জাতিসংঘ এখন ফিলিস্তিনিদের আরও সহিষ্ণু হওয়ার নসিহত করছে। জাতিসংঘর উন্নয়ন তহবিল সম্প্রতি দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ফিলিস্তিনিরা কীভাবে আরও সহিষ্ণু হবে, সেই পথ খুঁজতে। ‘সহিষ্ণুতা’ শব্দটি আজকাল উন্নয়ন রাজনীতিতে এনজিওগুলো খুব ব্যবহার করে। সম্পদের অসম বণ্টন, পরিবেশ বিপর্যয়, দারিদ্র্য—সবকিছুতেই সহিষ্ণু হওয়ার পরামর্শ দেয় এনজিওরা। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কীভাবে সহিষ্ণু হবে, সেটি বোধগম্য না। সহিষ্ণু হওয়ার একটিই পথ আছে ফিলিস্তিনিদের—ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য কোথায় চলে যাওয়া। পরিসংখ্যান বলে, পাঁচ মিলিয়নের বেশি ফিলিস্তিনি বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করছে। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনিদের আরও সহিষ্ণু হওয়ার পরামর্শ দেওয়া নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই না; বরং ইসরায়েলকে খুন, হত্যা, দখল বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া উচিত।

ইসরায়েলে প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরবের নাম ঘুরেফিরে আসে। কিন্তু কেন? সৌদি-ইসরায়েলের সম্পর্কের সুলুক সন্ধানে ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে লড়াই করেছিলেন নজদের গভর্নর বা শাসক আল সৌদ ও তাঁর ওয়াহাবি দলবল। কিন্তু অটোম্যানদের হাতে আল সৌদ পরাজিত হন। এতে ব্রিটিশদের কাছে আল সৌদের গুরুত্ব হারায়। এই সুযোগে ব্রিটিশদের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেন হিজাজের গভর্নর হোসাইন বিন আলী। ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে হোসাইন বিল আলীর প্রতি গাজা থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত স্বাধীন আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার টোপ ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ঝামেলার সৃষ্টি হয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর। হোসাইন বিল আলীকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, আরবকে ব্রিটিশ ও ফরাসি অর্ধেক ভাগে ভাগ করা হবে এবং আরবে বিশেষত ফিলিস্তিনে অনারব ইউরোপীয় ইহুদিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেলফোর প্রস্তাবনা মেনে নিতে হবে। হোসাইন বিন আলী এই প্রস্তাবে রাজি হননি। ১৯২১ সালের কায়রো সম্মেলনে বিন আলীকে ঘুষ ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে রাজি করানো চেষ্টা করা হয়। ওই সম্মেলনে ব্রিটিশদের উপনিবেশবিষয়ক মন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল উপস্থিত ছিলেন।

পরবর্তী সময়ে হেইলের শাসক ইবনে রাশিদও ব্রিটিশদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর মধ্যে হোসাইন বিন আলীর ছেলে আবদুল্লাহকে আমির করে ট্রান্স জর্ডান প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসব ঘটনার মধ্যেই ইবনে সৌদের দিকে ঝুঁকে পড়ে ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ অর্থ ও অস্ত্রে ইবনে সৌদ ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন ওয়াহাবি মতাবলম্বীদের নিয়ে। হেইলকে ইবনে সৌদের অধীনস্থ করা হয়। ১৯২৪ সালে ইবনে সৌদ ঘোষণা করেন হিজাজের বিন আলীর সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হবে না। এবং আল সৌদি হিজাজ আক্রমণ করেন। হোসাইন বিন আলী আকাবায় পালিয়ে যান। তায়েফে প্রবেশ করে ইবনে সৌদের বাহিনী ও ওয়াহিবিরা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। মসজিদে প্রবেশ করে মুসলিম তাত্ত্বিকদের হত্যা করা হয়। ১৯২৬ সালে ব্রিটিশরা ইবনে সৌদকে হিজাজের রাজা হিসেবে ঘোষণা করে। চূড়ান্তভাবে ১৯৩২ সালের সৌদি আরব প্রতিষ্ঠা করে ইবনে সৌদকে বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, বিন আলী ও ইবনে রশিদ ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বেলফোর প্রস্তাব মেনে না নেওয়ার বিপরীতে ইবনে সৌদ ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশদের সম্মতি দিয়েছিলেন। সেই থেকে সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের বন্ধুত্বের শুরু। এখনো যা গোপনে বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সৌদ রাজবংশ বা সৌদি আরব এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, যা সরাসরি ইসরায়েলের বিপক্ষে যায়।

ইতিহাস বলছে, প্রথমে সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আরবের মূল অংশকে বশ করা হয়। পর্যায়ক্রমে মিসর, জর্ডান ও আরবের অন্য দেশগুলোকেও ইসরায়েলকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয় ১৯৯১ সাল নাগাদ। তাই বিষয়টি নেহাতই এমন নয় যে ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধ করে ইসরায়েলের কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করে ফেলবে। এর সঙ্গে আরবের ভূরাজনীতির অনেক কিছুই সম্পৃক্ত। আরবের বিভক্তি, রাজতন্ত্র এবং তেল–জমিদারিই ইসারায়েলের ক্ষমতার উৎস। ফিলিস্তিন মুক্ত করা মানে তাই আরবে জনগণের প্রতিনিধির শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়া।

কিন্তু তাই বলে তো আর লড়াই-সংগ্রাম থেমে থাকে না। ফিলিস্তিনিরা লড়েই চলছে। ফিলিস্তিনিদের এ লড়াই দিন দিন মানবতাবাদী যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এই লড়াই কেবল মুসলমান বা ফিলিস্তিনিদের ভাবলে ভুল। আরব ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি বিশ্বের তাবৎ মানবতাবাদীর পাশে পাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। কেবল আরবের শাসকশ্রেণি ছাড়া। আরবের শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা না হলে ফিলিস্তিনের সমস্যার সমাধান হবে না। মিসর, সৌদি আরব, জর্ডান, তুরস্ক, শেখ শাসিত আরবরা ফিলিস্তিনকে রক্ষা করবে না। আরবে যদি একবার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়, তবে ইসরায়েল কতক্ষণ দাপট চালিয়ে যেতে পারে, সেটিই দেখার বিষয়। তাই মিসরে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিয়ে সামরিক শাসক বসানো হয়। সৌদি আরবের গণতন্ত্র নিয়ে কেউই উচ্চবাচ্য করে না। অগণতান্ত্রিক আরব ও ইসরায়েল শুরু থেকেই পরস্পরের মিত্র। জায়নবাদীরা ও আল সৌদ পরিবার একে অপরকে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল। সৌদি আরব ও ইসরায়েল শুধু ইরানের পরমাণু সক্ষমতার বিরুদ্ধেই এককাট্টা হয়নি; এর আগেও ১৯৬০ সালে উত্তর ইয়েমেনে বিপ্লবীদের হটাতেও এই দুই দেশ একযোগে কাজ করেছিল। এখন আবারও তা–ই করছে ইয়েমেন যুদ্ধে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জায়নবাদী ও আল সৌদদের চক্রান্তের কারণে আজও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে ফিলিস্তিনিরা মরছে। কিন্তু জন্ম নিচ্ছে দ্বিগুণসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা। সময়সাপেক্ষ হলেও ন্যায় ও ইনসাফের লড়াইয়ে মজলুমের জয় নিশ্চিত। ইতিহাসে এর উদাহরণ ফিলিস্তিনেই আছে। বালক ডেভিড পাথর ছুড়ে গোলিয়াথকে বধ করে বলেছিল ‘মুক্তি’। যুবক সালাহরাও বর্তমানের গোলিয়াথ ইসরায়েলকে পরাভূত করে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করবে। সেই স্বপ্ন নিয়েই ফিলিস্তিনিরা প্রতিটি ভোরে জেগে ওঠে। ফিলিস্তিনের কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছিলেন, ‘প্রতিটি প্রত্যুষই হলো নবজাত বিদ্রোহীর জন্মদিন’। ফিলিস্তিনে প্রতিদিনই নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হচ্ছে। ফিলিস্তিনের প্রতিটি সকালই শুরু হয় নতুন যুদ্ধের ডাক দিয়ে।

ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি।

Would you like to add some points?

Then comment And also Follow Me

Sort:  

@therealwolf 's created platform smartsteem scammed my post this morning (mothersday) that was supposed to be for an Abused Childrens Charity. Dude literally stole from abused children that don't have mothers ... on mothersday.

https://steemit.com/steemit/@prometheusrisen/beware-of-smartsteem-scam

And the reason why is because @therealwolf is disgusting slimy pedophile that enjoys abusing kids. Here's proof of him upvoting child porn on the steemit blockchain. bigbadwolf indeed.

And the reason why is because @therealwolf is disgusting slimy pedophile that enjoys abusing kids. Here's proof of him upvoting child porn on the steemit blockchain. bigbadwolf indeed.

Coin Marketplace

STEEM 0.29
TRX 0.11
JST 0.033
BTC 63458.69
ETH 3084.37
USDT 1.00
SBD 3.99