ছোটবেলার স্মৃতি "বনভোজন"
Copyright Free Image Source: Pixabay
আজকে হাতে একদমই সময় নেই । তাই খুবই ছোট্ট একটি পোস্ট লিখতে বসেছি । ছোটবেলায় আমরা সবাই কমবেশি পিকনিক করেছি । তবে শৈশবে গ্রামের বাড়িতে করা "বনভোজনের" কাছে শহুরে ছেলেদের "পিকনিক" ডাহা ফেল মারবে । উন্মুক্ত পরিবেশে, প্রকৃতির মাঝে গ্রামের সহজ-সরল বাচ্চারা যে পিকনিকটা করে থাকে তার সাথে শহরের ছেলে-মেয়েদের করা পিকনিকের বিস্তর তফাৎ রয়েছে ।
আমার মনে আছে শীত এলেই গ্রামে বনভোজনের উৎসব শুরু হতো । স্কুলে স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যেত । ছুটি আর শীতের আমেজ লাগতো আমাদের গ্রামের ছোটদের মনে । সারাদিন খেলা আর খেলা । সকালে ঘুম থেকে উঠেই দাঁত না মেজেই এক রাউন্ড ক্রিকেট, ফুটবল বা ব্যাডমিন্টন হয়ে যেতো । এরপরে সকালের খাওয়ার পরে সেই যে খেলা শুরু হতো আর দুপুর দুটোর আগে শেষ হতো না ।
বাড়িতে রাগারাগি হতো বিস্তর । শীতের বেলা, খুবই দ্রুত ফুরিয়ে যায় । তাই দুটো মানে আসলে বিকেল । গ্রামের দিকে সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে যায়, একটু যেন তাড়াতাড়িই । পিকনিকের আগে আমাদের ছোটদের নানান রকমের পরিকল্পনা হতো ।
সন্ধ্যার একটু আগে পুকুরের বাঁধানো ঘাটে অথবা খড়ের গাদায় প্যান্ট, জুতো, মোজা, সোয়েটার পরে এক্কেবারে ফুল বাবুটি সেজে আড্ডা চলতো আর চলতো পিকনিকের প্ল্যান । ডিসেম্বর মাস থেকে জানুয়ারির শেষ অব্দি চলতো আমাদের বনভোজন উৎসব । কম করে হলেও ৪-৫ টা বনভোজন করতাম আমরা ।
তো ডেট ফাইনাল হওয়ার পরে মেনুর লিস্ট তৈরির সময় লেগে যেত ঝগড়া । সবাই তার নিজের প্রিয় খাবারটি মেনুতে পেতে চায় । আমি যতই দলনেতা হই না কেন প্রত্যেকবারের মতো আমার আলু, বেগুন মুলো দিয়ে নোনানো ইলিশের ঝোলটা মেন্যুতে ঠাঁই পেতো না ।
যাই হোক, বিস্তর চেঁচামেচি আর কমপক্ষে ২-৩ দিন ধরে আলোচনার পরে সর্ব-সম্মতিক্রমে মেন্যুর লিস্ট তৈরী হতো । এরপরে চাঁদার পরিমান নিয়ে আবার শুরু হতো কথা কাটাকাটি । গ্রামের সাধারণ পরিবারের ছেলে-মেয়েরা সাধারণত গরীবই হয়ে থাকে । কোনোক্রমেই তারা বাড়ি থেকে নগদ টাকা আদায় করতে পারবে না । তাই আমার কাজিনদের মত ছিল শুধু আমরা আমরাই বনভোজন করবো । আপনারা জানেন যে আমাদের যৌথ পরিবারে কাজিন ভাই বোনেদের মোট সংখ্যাটা ছিল ৩২ । যদিও বয়স অনুযায়ী এদের মধ্যে ৪-৫ টি গ্ৰুপ ছিল । তাই, আমাদের গ্ৰুপে থাকতো ৮-৯ জন কাজিন ।
তো, আমি প্রত্যেকবার এর তীব্র প্রতিবাদ করে গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মানে যারা আমার বন্ধু-বান্ধবী ছিল তাদেরকে বনভোজনে নিয়ে নিতাম । তাদের টাকাটা জোগাড় হতো বাবার মানি ব্যাগ থেকে । আমার বাবা আগাগোড়াই সব টের পেতো, কিন্তু কিছু বলতো না ।
মনে আছে আমরা দশ টাকা করে চাঁদা তুলতাম । আর প্রত্যেককে বলা হতো বাড়ি থেকে এক বাটি করে চাল, দুটি আলু আর মাথা পিছু একটি করে ডিম আনতে । এগুলো সবাই দিতে পারতো । তবে, একটা মজার ব্যাপার হতো । লিস্টের বাইরে প্রায় প্রত্যেকবারই ৭-৮ জন বাড়তি হতো । কারণ, অনেকেই বাড়ির ছোট ভাই বোনদেরকে নিয়ে হাজির হয়ে যেত ।
টাকা কালেশনের পরে বাড়ির বাবা-জেঠু বা কাকাদের কাছে সংগৃহিত চাঁদার টাকা দিয়ে ফরমায়েশ করতাম বনভোজনের জোগাড়যন্ত্র করতে । আমার মনে আছে একবার মোট চাঁদা দু'শো টাকা উঠেছিল । খুশিতে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা । আর এখন বুঝতে পারি একশ-দু'শো টাকায় বনভোজন করা সম্ভব ছিল না ১৫-২০ জনের । বাকি টাকাটা যে বাবা-কাকারাই দিয়ে দিতো সেটা এখন বুঝতে পারছি ।
তো, বনভোজনের স্থান নির্বাচন করা হতো সত্যি সত্যি বনে । অর্থাৎ, ভিটের বাগানের মধ্যে গাছ-গাছালির ঘন জঙ্গুলে জায়গায় । বনভোজনের একদিন আগে সেখানে নিজেরাই দা, কোদাল দিয়ে বেশ খানিকটা স্থান একেবারে সাফ সুতরো করে ফেলতাম । আর মেয়েরা সেখানে দুটো মাটির উনুন খুঁড়ে ফেলতো । তারপরে রান্নার স্থানটুকু বেশ করে খেঁজুর-পাতার চাটাই দিয়ে ঘিরে দিতাম । তারপরে ছিল সব চাইতে বোরিং কাজ । রান্নার লাকড়ি গোছানো । তবে, বিস্তর শুকনো ডাল-পালা দুপুরের আগেই জোগাড় করে এক জায়গায় রেখে দ্রুত স্নান করে আমরা বনভোজনের জন্য রেডি হয়ে যেতাম ।
আমাদের সময়ে গ্রামে মুরগি খাবার চল ছিলো না । তাই বনভোজনে খাওয়া হতো পাতিহাঁস । শীতের সময়ে হাঁসের মাংসে দারুন স্বাদ, মুরগি ফেল । এক একটা হাঁসের দাম ছিলো তখন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা । অথচ দেখতাম তিনটে পাতিহাঁস এর লোম ছাড়াচ্ছে মা-কাকিমা রা । বাড়িরই হাঁস । সন্ধ্যের আগেই মাছ (পাকা রুই), মাংস সব কেটেকুটে রেডি হয়ে যেত ।
এরপরে বাড়ির কাজের লোকেদের মাথায় সব সরঞ্জাম চাপিয়ে বনভোজনের স্থানে গমন । গিয়ে দেখতাম পেট্রোম্যাক্সের (হ্যাজাক লণ্ঠন) উজ্জ্বল সাদা আলোয় বনভোজনের জায়গা একেবারে দিনের আলোর মতো হয়ে গিয়েছে । মেয়েরা রান্না শুরু করে দিতো, যেহেতু ছোট ছিলাম আমরা তাই রান্নার দায়িত্ব সামলাতে বাড়ি থেকে জেঠতুতো দু-তিন জন দিদিকে বনভোজনের অনারেবল সদস্য করা হতো ।
রান্না, মশলা-বাটার শব্দ আর খাবারের সুগন্ধে ম'ম করতো স্থানটি । আমরা সবাই ছোটাছুটি করে লুকোচুরি খেলতাম । পেট্রোম্যাক্সের আলোয় গাছপালার মধ্যে অদ্ভুত একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি হতো । তাই লুকোচুরি দারুন জমে যেতো । রান্নার কাজ একটু এগিয়ে গেলেই আমি গুটি গুটি পায়ে রান্নার জায়গায় গিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতাম । তখন সেখান থেকে আমায় নড়ায় এমন সাধ্য কার ? টেস্ট করার টাইম যে ।
ডিমের ঝোল, মাছের ঝোল, কষা মাংস টেস্ট চলতো হুশ-হাশ, চাকুম-চুকুম শব্দে । রাত সাড়ে আটটা নাগাদ রান্না হয়ে যেতো । এবার খাওয়ার পালা । কারোরই আর তর সয় না । বাড়ির কাজের লোক সন্ধ্যে বেলাতেই থাকে দিয়ে কলা-পাতা কেটে রেখেছে ।
দ্রুত বালতির জলে ধুয়ে পাত পেতে আমরা বসে পড়তাম । সবাই, শুধু দিদি আর কাজের লোক বাদে । তারা বাড়িতেই খাবে ।
নিকষ কালো শীতের রাতে জঙ্গলে বসে হ্যাজাকের আলোয় কলা পাতায় ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, লাল শাক দিয়ে চিংড়ি ভাজা, ডিমের ডালনা, বেগুন ভাজা, পাকা রুইয়ের কালিয়া, হাঁসের মাংস আর শেষ পাতে টমেটোর চাটনি ।
আহা অপূর্ব !
বাহ্ দাদা আজকের পোস্টটি খুবই দারুন লিখেছেন। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আজকে আপনার পোস্টটি দেখে। ছোটবেলায় বন্ধু-বান্ধব মিলে এভাবে পিকনিক করা হতো। সবাই বাড়ি থেকে চাল তেল ঝাল লবণ সবকিছু নিয়ে দূর এলাকায় যেতাম কোথাও। খুব মজা আনন্দ হতো সবাই মিলে কলা গাছের পাতায় খেতাম। খুবই চমৎকার একটি পোস্ট আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন দাদা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল আপনার জন্য প্রিয় দাদা।
This post has been upvoted by @italygame witness curation trail
If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness
Come and visit Italy Community
দাদা,ছোট বেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন।আমারাও যার যার বাসা থেকে আলু, চাল, ডাল, পেঁয়াজ,নিয়ে আসতাম।আর বিভিন্ন ক্ষেতে যেয়ে শাক তুলে আনতাম।তারপর ডিম আর তেল কিনে এনে মাটির চুলায় রান্না করা হত।তারপর পাটি পেতে সবাই মিলে খেতাম। মজার ছিলো দিনগুলো।ধন্যবাদ
লোভনীয় সব খাবারের নাম শুনেই জিভে জল চলে এসেছে দাদা। আমিও যেহেতু গ্রামে বড় হয়েছি এবং আমারও যৌথ পরিবার ছিল তাই আমরা চাচাতো ভাইবোনরা মিলে মাঝে মাঝেই বনভোজন করতাম। সাথে আশেপাশের কিছু ছেলে-মেয়েও আমাদের সাথে থাকতো। তবে আমাদের বনভোজনের ধরন ছিল একটু আলাদা। সবার বাসা থেকে চাল সংগ্রহ করা হতো এবং একটি করে ডিম সংগ্রহ করা হতো। এরপর যার যার বাসা থেকে তেল, লবণ, মরিচ ও অন্যান্য যেসব কিছু লাগতো সবকিছুই একটু একটু করে আনা হতো। এভাবে চলতো মজার খাওয়া দাওয়া। আজকে আপনার বনভোজনের গল্প পড়ে অনেক ভালো লাগলো দাদা। শুভকামনা রইলো আপনার জন্য। সেই সাথে আপনার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা রইলো। ❤️❤️❤️
দাদা আপনার ছোটবেলার বনভোজনের পোস্টটি পড়ে আমারও ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমরাও বান্ধবীরা সবাই মিলে ছোটখাটো বনভোজন করতাম। সত্যি তখনকার বনভোজন খুবই মজার হত। তবে দাদা আপনাদের বনভোজনে অনেক কিছু খাওয়া দাওয়া হত। আমরা কিন্তু বনভোজনে এতকিছু খেতাম না দাদা। আমরা সবাই সবার বাসা থেকে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল নিয়ে এসে মাটির চুলায় খিচুড়ি রান্না করে খেতাম। সেই খিচুড়ি খেতে যে কি মজা লাগতো। সে দিনগুলো সত্যিই অনেক আনন্দের ছিল। সত্যি দাদা আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ অনেকদিন পর সেই ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।
ছোটবেলার দিনগুলো কতইনা মজা ছিল তাই না দাদা। আসলে আমাদের ছোটবেলায় এরকম ঘটনা ঘটত আমরা বাসা থেকে ১০-২০ টাকা করে চাঁদা তুলে বাসা থেকে চাল, ডাল, ডিম এগুলো নিয়ে আসতাম। পরবর্তীতে আমাদের এলাকার বন্ধু-বান্ধব মিলে একটা আলোচনা করে পিকনিকের আয়োজন করতাম।
তবে পিকনিকের মেনু নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রায়ই অনেক ঝগড়াঝাটি হোত পরবর্তীতে মাঝেমাঝে সিদ্ধান্ত হয় খিচুড়ি রান্না করবে। বেশিরভাগ সময় পিকনিকে আমরা খিচুড়ি খেয়ে ছিলাম।। দাদা ছোটবেলার স্মৃতি গুলো মনে পরে গেল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।
দাদা নমস্কার নেবেন! আসলে আপনার পোস্টর মধ্যে দিয়ে আমার ছোটে বেলায় বাড়ীর সকলে মিলে বনভোজন করতাম।সবাই থেকে চাল দিতে আর সেই চাল বিক্রি করে তরকারি কিনতাম আর কিছু চাল রেখে দিতাম।সে গুলে দিয়ে ভাত রান্না করতাম।এভাবে অনেক বনভোজন করে খায়তাম।আপনি অনেক সুন্দর করে বনভোজন করার মুহুর্ত কাটিয়েছেন ,আপনার পোস্টটি পড়ে বুঝতে পারলাম।অনেক ধন্যবাদ।
আহ! কি মজার ছিলো সেই দিনগুলো, সত্যি অন্যরকম এক মুগ্ধতায় ভরে যেত হৃদয়টা। তবে এটা মোটেও ঠিক হয় নাই পছন্দের ইলিশের সাথে মুলোও বাদ পড়ে গেলো বলে, হি হি হি ।
আমরা ছোট বেলায় বলতাম জুলাপাতি, তবে সেখানে বড়দের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকতো সব সময়, কারন বড়রা আসলে মজাটা কমে যেতো। শৈশবের স্মুতিগুলো মনে করিয়ে দিলেন দাদা।
আপনার পোষ্টি পড়ে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমারও গ্রামে এমন করে বনভোজন করতাম। আমরা অবশ্য ছোট করে করতাম শুধু সমবয়সিরা। কতই না সুন্দর ছিল সে সময় গুলো। মিস করে অনেক । ধন্যবাদ দাদা।
আহ্।। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। প্রচুর পিকনিক করেছি ছোটবেলায়। আপনার গল্প পড়ে আমারও ছোটবেলার পিকনিকের সেই গল্প গুলো শেয়ার করার ইচ্ছে জাগলো। আলু, ডিম, চাউল এগুলো জোগাড় করার মুহূর্তটা ছিল দারুণ। আহ্ শৈশব। কত মধুর ফ্যান্টাসিতে ভরপুর ছিল। 🥰