৫ম পর্বঃ গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা [ কুতকুত ]
21-01-23
০৮ মাঘ,১৪২৯ বঙ্গাব্দ
আসসালামুআলাইকুম সবাইকে
৪র্থ পর্বের পর
গ্রামের আরেকটি জনপ্রিয় খেলা ছিল কুতকুত। এই খেলাটা খেলে নাই এমন লোক খুব কম পাওয়া যাবে। বিশেষ করে গ্রামের মেয়েরা এই খেলাটায় এক্সপার্ট ছিল একটু বেশিই! এই খেলাটার জনপ্রিয়তা ছিল আমরা যখন প্রাইমারী লেভেলে পড়াশোনা করতাম। স্কুলে গেলে দেখতে পেতাম দুইজন করে কুতকুত খেলছে। খেলাটির নাম মনে হয় কুতকুত খেলার সাউন্ড থেকে এসেছে! মানে হচ্ছে এই খেলাটি খেলার সময় মুখে কুতকুত বা কিতকিত বলে ঘর পার হতে হয় সেখান থেকেই এই খেলাটির নাম কুতকুত হয়েছে। তখনকার দিনে কুতকুত খেলাটা জনপ্রিয় ছিল! বিশেষ করে গ্রামের মেয়েরা এই খেলাটা বেশি খেলতো। তবে ছেলেরা যে এ খেলাটা খেলেনি এমনটা নয়। ছেলেরাও কিন্তু এই খেলায় এক্সপার্ট ছিল।
ক্লাস ফোর বা ফাইভে সম্ভবত পড়ি! তখন বাড়ির চাচাতো বোন, আপুরা মিলে দেখতাম কুতকুত খেলতো! দুপুর বেলা অথবা বিকাল বেলা কুতকুত খেলা হতো বেশি। আমাদের বাড়ির সামনে বড় উঠোন। সেখানেই তৈরি করা হতো কুতকুত খেলার ঘর। দুই পাশে লম্বা দাগ কেটে তৈরি করা হতো পর পর পাচঁটি ঘর। নামগুলো যথাক্রমে এক্কা,দোক্কা, তিক্কা, চাক্কা ও পাক্কা! পাক্কা ঘরটা অন্য ঘরগুলোর থেকে অনেকটা বড় থাকতো। প্রথমে দুই পক্ষের মাঝে খেলা হতো। যে আগে খেলার সুযোগ পেত সে এক্কা থেকে খেলা শুরু করতো। তবে এই খেলায় ভাঙা কলসির টুকরো বা সিক তৈরি করে খেলা হতো। পায়ের আঙুলের সাহায্যে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নেয়া হতো। আমাদের দিকে কুতকুত খেলার চাড়াকে সিক বলেই চিনতো তখন। একদিন একটা সিক বানিয়ে এক মাস ব্যাপী চলতো সেই সিক দিয়ে কুতকুত খেলার আয়োজন! যদি সিক হারিয়ে যেত তাহলে নতুন করে ভাঙা কলসির টুকরো দিয়ে চাড়া বানানো হতো।
সিক বানানো হয়ে গেলে শুরু হয়ে যেত কুতকুত খেলা। এক্কা থেকে খেলা শুরু করতে হবে। আমি তখনও খেলাটায় এতোটা অভ্যস্ত না। তবে আম্পায়ারিং করতাম ভালোভাবেই! কেউ যদি খেলায় মিথ্যা কথা বলতো, আমার দিকে সেটাকে বলতো কান্ডামি করতো তখন আমি দাড়িঁয়ে দাড়িঁয়ে খেলা দেখে তা শুধরে দিতাম। এই খেলার আবার কিছু রোলস ছিল। টার্গেট পাক্কা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে সিককে! সিক পাক্কা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সময় যদি কোনো ঘরের দাগে পড়ে অথবা দুই পাশের রেখার বাইরে চলে যায় তাহলে তার খেলা বাদ।
তখন সুযোগ পেত পরের জন। যে পাক্কা পর্যন্ত সিক কোথাও কোনো বাধাঁ ছাড়াই নিয়ে যেতে পারতো তাহলে সে পাক্কা গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়ার সুযোগ পেত। সব থেকে কঠিন কাজ ছিল পাক্কা পর্যন্ত সিক নিয়ে যাওয়া! যারা খেলায় এক্সপার্ট থাকতো তারা একবারেই নিয়ে চলে যেত পাক্কাতে। আবার পাক্কা থেকে সজোরে সিক মেরে নিয়ে আসতো বাহিরে। তবে আসার সময় সিক অবশ্যই সবগুলো ঘর হয়ে তারপর আসতে হবে। না হয় তার খেলাও হবে না।
সব থেকে মজার ব্যাপার ছিল এই খেলায় ঘর কেনা! অর্থাৎ আপনি যখন পর পর এক্কা থেকে পাক্কা পর্যন্ত সবগুলো ঘরে যেতে পারবেন। ফাইনালি আপনি ঘর কেনার সুযোগ পাবেন। পাক্কা ঘরের ঠিক সামনে গোল করে ছোট একটা ঘর তৈরি করা হতো। তবে অঞ্চলভেদে ঘর কেনার পদ্ধতিটা অন্যরকমও হতে পারে। গোল ঘরে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে পিছনে সিক ঢিল ছুড়ে দিতো। যদি সিক বাহিরে চলে যায় অথবা পাক্কায় পরতো তখন তার ঘর কেনা হতো না। তবে সে ঘর কেনার সুযোগ পেত যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘর কেনা হচ্ছে! আবার যখন সামনে দিল তাকিয়ে সিক মারতো তখন যদি এক্কা, দুক্কা, তিক্কা অথবা চাক্কা ঘরে সিক পরতো তখন ধরে নেয়া হতো সে ঘর সে কিনে ফেলেছে। বিপক্ষ দল এখন সে ঘরে সিক ফেলতে পারবে না। যে ঘর কিনে ফেলতো তার জন্য খেলাটা তখন সহজ হয়ে যেত। কারণ যে ঘরটা সে কিনেছে এখন সে সে ঘরে দম ফেলতে পারবে। অর্থাৎ কিছুটা সময়ের জন্য সে ঘরে রেস্ট নিতে পারবে।
তবে কুতকুত একেক জায়গায় একেকভাবে খেলা হতো। সেটা গ্রামের মেয়েরাই বেশি জানতো। আমি যে খেলিনাই এই খেলাটা। এমনটা নয়। ছোটবেলায় আমিও খেলেছি। আপুদের সাথে খেলেছি। আমার এখনও মনে আছে! ঠিক এরকম আরেকটা খেলা ছিল সেটা সাপের মতো ঘর বানিয়ে এক্কাদোক্কা খেলা। সেটা একটু টাফ! তবে কুতকুত খেলার মতোই। আকাঁবাকাঁ লাইন করে ঘর বানিয়ে এই খেলাটা খেলা হতো। আমি এই খেলাটা তেমন পারতাম না। অনেক দমের প্রয়োজন হতো এই খেলায়! অল্পতেই দম রাখতে পারতাম না। তবে আপুরা দেখতাম দম রাখতে পারতো কিন্তু সঠিক ঘরে আবার সিক ফালাইতে কষ্ট হতো। অনেক সময় ঘরের বাহিরে চলে যেত সিক।
কুতকুত খেলাটা এখনও মফস্বলের দিকে জনপ্রিয়তা আছে। গ্রামের অনেক কিশোরীরা এই খেলাটা খেলে হয়তো। তবে আগের মতো এতো আগ্রহ নিয়ে খেলা হয় না। আস্তে আস্তে এই খেলাটাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। মাটিতে আকাঁআকিঁ করতেও এখন দেখা যায় না। এমন হয়েছে, এক ঘর দিয়ে এক সপ্তাহ পর্যন্ত কুতকুত খেলা চলতো। আসলে গ্রামের অনেকেই এখন এই খেলাগুলো সম্পর্কে অবগত নয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই খেলা সম্পর্কে জানানো উচিত আমি মনে করি। তাহলে গ্রামীণ এই ঐতিহ্যের খেলাগুলো হয়তো ঠিকে থাকবে যুগের পর যুগ ধরে।
যাক, আজকের মতো এখানেই বিদায় নিচ্ছি। আবারো হাজির হবো গ্রামীণ ঐতিহ্যের নতুন কোনো খেলা শেয়ার করার জন্য। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। আল্লাহ হাফেজ 🌼🦋
চলবে.....
10% beneficary for @shyfox ❤️
ধন্যবাদ সবাইকে
VOTE @bangla.witness as witness
OR
আমি কে?
আমার নাম হায়দার ইমতিয়াজ উদ্দিন রাকিব। সবাই আমাকে ইমতিয়াজ নামেই চিনে। পেশায় আমি একজন ছাত্র। নিজেকে সবসময় সাধারণ মনে করি। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেয় এবং তা মেনে চলার চেষ্টা করি। বাংলা ভাষায় নিজের অভিমত প্রকাশ করতে ভালো লাগে। তাছাড়া ফটোগ্রাফি,ব্লগিং,কুকিং,রিভিউ,ডাই ইত্যাদি করতে ভালো লাগে। অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ভালো লাগে। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। ভবিষ্যতে প্রিয় মাতৃভূমির জন্য কিছু করতে চাই।
Thank you, friend!
![image.png](https://steemitimages.com/640x0/https://cdn.steemitimages.com/DQmd7of2TpLGqvckkrReWahnkxMWH6eMg5upXesfsujDCnW/image.png)
![image.png](https://steemitimages.com/640x0/https://cdn.steemitimages.com/DQmWDnFh7Kcgj2gdPc5RgG9Cezc4Bapq8sQQJvrkxR8rx5z/image.png)
I'm @steem.history, who is steem witness.
Thank you for witnessvoting for me.
please click it!
(Go to https://steemit.com/~witnesses and type fbslo at the bottom of the page)
The weight is reduced because of the lack of Voting Power. If you vote for me as a witness, you can get my little vote.
twitter share link
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
ছোটবেলায় কুতকুত অনেক খেলেছি। আজকে আপনার পোষ্টের পঞ্চম পর্বে কুতুকুত খেলার যে নিয়মগুলো তুলে ধরেছেন। সেটি পড়ে খুব ভালো লাগলো এবং মনে হচ্ছে ছোটবেলায় ফিরে গিয়েছি। ধন্যবাদ আমাদের মাঝে তুলে ধরার জন্য।
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাইয়া! আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম
আমি ও খেলেছি কুতকুত।আমাদের এখানে কলসির টুকরা কিংবা মাটির টুকরা দিয়ে যেটা বানানো হতো,এটাকে চারা বলা হত।মাঝে মাঝে টাইলস টুকরা পেলে তো কথাই নেই। আমাদের এখানে কান্ডামি বলা হত,খেলায় ঝামেলা করলে😜।গ্রাম্য খেলা কিংবা ছোটবেলার খেলাগুলোর মাঝে আসলেই অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে।এটা ছেলেরা যদিও কম খেলতো তবে আমরা মানুষ না পেলে সমবয়সী ছেলেদেরকে খেলায় নিতাম।ভালো লাগলো।ধন্যবাদ
হাহাহা!! মেয়েরা অনেক কান্ডামি করতো খেলায় 😁। মাঝে মাঝে তো খেলাই অফ হয়ে যেত।
আপনি তো এই পোষ্টের মাধ্যমে ছোটবেলার সেই খেলার মুহূর্ত গুলোর কথা মনে করিয়ে দিলেন। সত্যি ছোটবেলায় এই খেলাটি আমরা একটু বেশি খেলতাম। সবাই একজোট হয়ে খেলতে কিন্তু বেশি ভালোই লাগে। যারা গ্রাম অঞ্চলে থাকে তারা সবাই এই খেলাটি খেলেছে। সত্যি সেই স্মৃতিগুলো কখনো ভুলার নয়। হাতের কাছে যা পেতাম তা দিয়ে এই খেলাটি খেলতাম। ভালো লাগলো পড়ে আমার কাছে।
কুতকুত খেলা শুধু মেয়েরা খালেছে তাই নয় ছেলেরাও এই খেলা খেলতো ছোটবেলায়। আপনার পোস্ট দেখে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল। যখন আমরা ছোট ছিলাম ঘরের সামনে খুব সুন্দর করে এই খেলাগুলো খেলতাম। অনেক সময় খেলার মধ্যে না নিলে ঝগড়াই হতো। খেলাটির কথা এখনো আমার অনেক মনে পড়ে। এই খেলা নিয়ে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে অনেকর।