আমিয়াখুম জলপ্রপাত

in #travel6 years ago

42937145_1843769852406842_1812550274212954112_n.jpg

পাথর আর সবুজে ঘেরা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবল বেগে নেমে আসছে জলধারা। দুধসাদা রঙের ফেনা ছড়িয়ে তা বয়ে চলেছে পাথরের গা বেয়ে। নিমেষেই ভিজিয়ে দিচ্ছে পাশের পাথুরে চাতাল। সঙ্গে অবিরাম চলছে জলধারার পতন আর প্রবাহের শব্দতরঙ্গ। লোকালয় ছেড়ে গহিন পাহাড়ের মাঝে এমন দৃশ্য—একবার দেখলে মনের গভীরে গেঁথে থাকবে আজীবন। প্রকৃতি এমন অপার সৌন্দর্যের ডালা সাজিয়ে বসে আছে আমাদের এই সবুজ শ্যামল বাংলায়—বান্দরবানে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাশে ‘আমিয়াখুম জলপ্রপাত’কে দেখা হচ্ছে বাংলার ভূস্বর্গ হিসেবে। কারো কারো মতে এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জলপ্রপাত। এর অবস্থান বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম নাক্ষিয়ং নামক স্থানে।

ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ভ্রমণবিষয়ক গ্রুপ ‘ট্রাভেলার নেস্ট’ আয়োজিত ক্যাম্পিংয়ের সুবাদে সম্প্রতি আমিয়াখুম জলপ্রপাত দেখার সুযোগ ঘটে। বেশ বড় একটা দলের সদস্য হয়ে আমরা গন্তব্যে যাত্রা করি গত ৭ জুলাই। আর নানা চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে এই বাংলার ভূস্বর্গের সান্নিধ্য মেলে তিন দিন পর ১০ জুলাই।

42838571_649363582131268_4745653830870368256_n.jpg

বান্দরবান জেলা শহর থেকে থানচি উপজেলা সদরের দূরত্ব ৭৯ কিলোমিটার। রিজার্ভ চাঁদের গাড়িতে বান্দরবান থেকে থানচি যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। সাঙ্গু নদীর পারে অবস্থিত থানচি বাজার। এই সাঙ্গু নদী ধরে ইঞ্জিনবোটে উজান ঠেলে আমরা রওনা হই পদ্মঝিরি অভিমুখে। নদীর দুই পাশে সবুজে মোড়ানো প্রতিটি পাহাড় যেন মেঘের কোলে শুয়ে আছে অবলীলায়। অপূর্ব দৃশ্য! প্রকৃতি যেন নিজ হাতে তুলির আঁচড় বুলিয়ে পুরো চিত্রটা ক্যানভাসে এঁকে রেখেছে। যেদিকে তাকাই কেবলই মুগ্ধ হওয়ার পালা। দুই ঘণ্টার ট্রলারযাত্রা শেষে আমরা পৌঁছে যাই পদ্মঝিরিতে। নৌকা থেকে নেমে পাহাড়ি ও ঝিরিপথ পেরিয়ে ত্রিপুরাপাড়া দিয়ে রিমাক্রি খালে পৌঁছতেই রাত হয়ে যায়। অগত্যা পাহাড়িদের সহযোগিতায় খাল পার হয়ে পৌঁছি থুইসাপাড়ায়।

থুইসাপাড়ার হেডম্যান থুইসা খিয়াংয়ের ঘরেই আমাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা হয়। আলাপচারিতায় তিনি বললেন, ‘আমিয়াখুম জলপ্রপাতের অবস্থানস্থল যথেষ্টই দুর্গম এলাকায়। ওদিকে লোকজনের আনাগোনা তেমন একটা ছিলই না। জলপ্রপাতটি আমাদেরই (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ) প্রথম নজরে আসে মাত্র ১৮ থেকে ২০ বছর আগে। আর পর্যটকের আনাগোনা শুরু মাত্রই ১০ থেকে ১২ বছর আগে। প্রথমদিকে পর্যটকের দেখাও মিলত কালেভদ্রে। তবে পাঁচ বছর ধরে পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে।’

যা হোক রাত যাপন শেষে পরদিন সকালে রওনা হই। আবারও ঝিরি পার হতে হলো। এরপর আমরা উঠে যাই দেবতা পাহাড়ে। পাহাড়ে ওঠার পর দেখা গেল সামনে সুউচ্চ দুটি পাথরের পাহাড়। আর তার নিচ থেকে অবিরাম ভেসে আসছে পানি পড়ার শোঁ শোঁ শব্দ। বুঝতে বিলম্ব হয় না, জলপ্রপাতের অনেকটা ওপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এবার নামার পালা। কিন্তু তা যথেষ্টই কষ্টসাধ্য, ঝুঁকিও আছে কিছুটা। কারণ দেবতা পাহাড় থেকে নামতে হয় ১২০ থেকে ১৪০ ডিগ্রি খাড়া পথ বেয়ে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা বেয়ে বেয়ে নেমে আসি পাহাড়ের নিচে।

পাথর আর সবুজে ঘেরা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে রেমাক্রি খাল। খালে বিশাল সব পাথর। খালের পাশ দিয়ে পাথর পার হয়ে একটু উজানে যেতেই চোখের সামনে বিস্ময়—আমিয়াখুম জলপ্রপাত। বাংলাদেশে এমন ঐশ্বর্যের অবস্থান দেখে আমরা বিমোহিত। পাথুরে পাহাড়ের মাঝে এমন দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা যেন কথা হারিয়ে ফেলি। একই সঙ্গে হারিয়ে যায় এত কষ্ট স্বীকার করে এখানে আসার সব ক্লান্তি, অবসাদ।

কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে টগবগে যৌবনে আমিয়াখুম। সুবিশাল জলধারা প্রবল গতিতে নেমে আসছে। পাথর কেটে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে নিচের দিকে।

পর্যটকের চাপে সহজগম্য দেশের অন্যান্য জলপ্রপাত প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবেশ হারিয়ে ফেলে। এ ক্ষেত্রে আমিয়াখুম জলপ্রপাত ব্যতিক্রম। অবস্থানস্থল দুর্গম হওয়ায় এখানে পর্যটকের আনাগোনা খুবই কম। নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এখানে যাতায়াতে কিছুটা রাশ টেনে ধরা আছে। সে সুবাদে এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশটা এখনো অক্ষুণ্ন রয়ে গেছে। আর পুরো প্রকৃতির নির্মলতা ধারণ করে অপার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়েছে বাংলার এই ভূস্বর্গ।

ট্রাভেলার নেস্টের অ্যাডমিন খায়রুন আক্তার প্রিয়া বললেন, ‘প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য আমাকে বারবার টানে। এখানে এলে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার সব কষ্ট ভুলে যাই। এ পর্যন্ত আমি পাঁচবার আমিয়াখুম জলপ্রপাতে এসেছি, ভবিষ্যতেও আসব।’

থানচি থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বললেন, ‘প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ হাজার পর্যটক থানচির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করে। আমিয়াখুম জলপ্রপাতটি বেশি দুর্গম এলাকা হওয়ায় আমরা সাধারণত যাওয়ার অনুমতি দেই না। তার পরও আমার ধারণা, পর্যটকদের একটি অংশ আমিয়াখুম জলপ্রপাত ভ্রমণ না করে ঘরমুখো হয় না।
Source

Coin Marketplace

STEEM 0.30
TRX 0.12
JST 0.033
BTC 64093.86
ETH 3123.80
USDT 1.00
SBD 3.94