বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের আত্মজীবনী ও বাস্তবতা ৷ ♥

in #story7 years ago

Matiur Rahman.jpg

*২০০৯ সাল

ওয়াহিদ আনমনে বিড়বিড় করছে । আমি ও বেশ চিন্তিত। এ ধরণের কেইস আগে ডিল করিনি। আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক নই । তবে নিজের আগ্রহেই ওয়াহিদ কে দেখতে এসেছি ।
ওয়াহিদ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ফ্লাইট লেফটেনেন্ট কর্মরত ছিলো। ঘটনাটা বছর দুইয়েক আগের। ফাইটার ( যুদ্ধ বিমান ) পাইলট ছিল ও। ওদের ব্যাচের সোর্ড ওফ অনার বিজয়ী এক তুখোড় পাইলট । ফ্লাইং অফিসার থেকে ফ্লাইট লেফটেনেন্টে প্রমোশন পাবার পরপরই তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয় । ও হঠাৎ নিজেকে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর দাবী করে । ওর ব্যাচ মেইট রা প্রথমে জিনিসটা বেশ হালকা ভাবেই নিয়েছিলো । ভাবছিলো ওয়াহিদ ফাইজলামি করছে । কিন্তু ওর পাগলামির মাত্রা চূড়ান্ত হতে থাকে .........!
একদিন আকাশে উড়ন্ত অবস্থাতে রাডার স্টেশনে কথোপকথনরত অবস্থায় সে বলে ওঠে -
" ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর বলছি , করাচির মসরুর বিমান ঘাঁটি থেকে । আমি এই মাত্র একটা টি ৩৩ ফাইটার হাইজ্যাক করেছি । এক পাকিস্তানী পাইলটকে কে হত্যা করেছি .......! হে বাংলাদেশ........ অপেক্ষা করো ! আমি ছুটে আসছি তোমাকে মুক্ত করতে ! "
রাডার স্টেশন থেকে স্কোয়াড্রন লিডার শাফকাত চিৎকার করে বলেন -
" হোয়াট হেপেন্ড ডিয়ার লেফটেনেন্ট ওয়াহিদ !!!!!
আর ইউ অল রাইট ???
আপনি অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত রানওয়েতে ল্যান্ড করুন। আপনি বাংলাদেশেই আছেন । বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। "
ওয়াহিদ বলে ওঠে -
" ইয়েস স্যার !!!!! ইয়েস।
আই লাভ মাই মাদার , আই লাভ বাংলাদেশ । ইয়েস ইয়েস ........... আই এম ল্যান্ডিং । দিস ইজ লেফটেনেন্ট মতিউর......! অ্যাট লাস্ট আই গট দ্যা ফাইটার ফর বাংলাদেশ । "
ওয়াহিদ নিরাপদে ই ল্যান্ড করে। ককপিট থেকে নেমে প্রথম প্রশ্ন করে - " স্বাধীনতা যুদ্ধের কি খবর ! "

ওয়াহিদের পাগলামি দিনদিন বাড়তে থাকে । মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন - সিজোফ্রেনিয়া ( জটিল মানসিক রোগ ) নামক রোগে ও আক্রান্ত ।
ওকে সারিয়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টাই করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে । তবু ওয়াহিদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে । আস্তে আস্তে সে সম্পূর্ণ
মানসিক ভারসাম্য হারায় । বাধ্য হয়েই ওয়াহিদ কে অবসরে যেতে হয় ।


ওয়াহিদ বসে আছে আমার ঠিক সামনে ।
চুপচাপ কাগজে কি জানি লিখছে ....! মায়া লাগছে ছেলেটার জন্য । ওয়াহিদ আমার দূর সম্পর্কের অাত্মীয়। ওর মা আমাকে আজ ডেকেছেন একটু ওকে দেখার জন্য । ওয়াহিদ কয়েক বছর ধরে ই এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ খাচ্ছে ।
ওয়াহিদ বয়েসে আমার সমান প্রায় । এখন একা একা থাকে । একেবারে চুপচাপ !!
------" খালাম্মা ওয়াহিদ ভাই অসুস্থ হলো কবে ? "
---" বাবা ! ও ফ্লাইট লেফটেনেন্ট হবার পরপরই ওর পাগলামিটা সবার চোখে পড়ে । বিমানের ককপিটে উঠে ই বিড়বিড় করতে থাকতো ছেলেটা । বিষয়টা ওর বন্ধু নাসির প্রথম আমাকে জানায় ।
একদিন ফোন দিয়ে বলে - ' খালাম্মা ! ওয়াহিদ পাগলামি করছে । রুমের দেয়ালে মতিউর , মতিউর লিখে ভর্তি করে ফেলছে ! কথাবার্তাও আগোছালো ! কালকে ওর ফ্লাইং আছে , আমার তো মনে হয় - এভাবে ও ফ্লাইং করতে পারবে না আর । " এর পরদিন থেকেই আমার ছেলেটা আস্তে আস্তে অসুস্থ হতে থাকে । ইদানিং নিজের মাথা নিজে বাড়ি মারে । প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হয় ছেলেটার। "


রাত বাড়ছে । বাসায় ফিরতে হবে আমার । আমি ডায়েরীতে নোট করলাম -- নাসির ( ওয়াহিদের বন্ধু ) , সালাম স্যার ( আমার দেখা সবচেয়ে ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট ).......!
যাবার সময় ওয়াহিদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বিড়বিড়িয়ে বললেন -
" আমার জন্মদিনটাও তুই ভুলে গেলি !!!!! হায়রে অভাগা তুই ....... । এতো বড় লজ্জা দিলি আমাকে ! "


ফ্লাইট লেফটেনেন্ট নাসির সাহেব চমৎকার মানুষ । এখনো বিমান বাহিনীতেই আছেন। উনার সাথে কথা বলার একপর্যায়ে ভদ্রলোক কেঁদে ফেললেন । বললেন
---" আমাদের ব্যাচে ওয়াহিদ সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছিলো । এক কথায় অসাধারণ একটা ছেলে । ওর আইকন ছিলো - বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর । মতিউরের আত্মত্যাগ ই তাকে উৎসাহ দেয় বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার । একদিন আমাকে খুব আক্ষেপ করে বলেছিলো - ' বুঝলি নাসির ! বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর আমাদের মতো বয়সেই পাকিস্তানের করাচির মসরুর বিমান ঘাঁটি থেকে একটা টি ৩৩ ফাইটার হাইজ্যাক করতে চেয়েছিলো । কার জন্য !!!! এই বাংলাদেশের জন্য । এক পাকিস্তানী পাইলটের সাথে বিমান টা ছিনতাই করতে গিয়ে ওর ধস্তাধ্বস্তি হয় । বিমানের নিয়ন্ত্রন নিয়ে হাতাহাতির এক পর্যায়ে বিমানটা বিধ্বস্ত হয় !
মতিউরের দাফন হয়েছিলো কোথায় - জানিস ? মসরুর বিমান ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে । কবরে লেখা ছিল - ' ইধার শো রাহা হে এক গাদ্দার । ' "
সেদিন আমি দেখেছিলাম ওয়াহিদের চোখে পানি । ওয়াহিদ প্রমোশন পায় ২৯ শে অক্টোবর । যতদূর মনে পড়ে সেদিন ও কেঁদেছিল । কারণ সেদিন ছিলো মতিউরের জন্মদিন । বাংলাদেশের সব কয়টা জাতীয় পত্রিকা খুলে আমায় বলেছিলো - ' আজ মতিউরের জন্মদিন ! অথচ কোথাও মতিউর কে একটা শুভ জন্মদিন ও কেউ দিলোনা !!!!! আহা ! অভাগা জাতি আমার !
বুঝলি নাসির ! আমি বা তুই দেশের জন্য বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শহীদ হলেও এদেশ একদিন আমাদের ভুলে যাবে হয়তো ! '
নাসির ভাইয়ের চোখে পানি - '' ওয়াহিদ কে মিস করি খুব ! ও পরবর্তীতে ডিপ্রেশনে চলে যায় আস্তে আস্তে । হয়তো হতাশা ওকে গ্রাস করতে থাকে ..........! একদিন আমাদের কমান্ডিং অফিসারের সামনে ই চিৎকার করে বলে - " আমি বীরশ্রেষ্ঠ ! অথচ আমার বার্থডে তে কেউ উইশ ই করলেন না আমাকে ! আমি দেশের জন্য শহীদ হলাম ........! আর আপনারা সব বেমালুম ভুলে গেলেন ? এই আমার প্রাপ্য !!!!!! "
নাসির কাঁদছেন।
সব শুনে আমার মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো ।


সালাম স্যার হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে বারান্দায় বসে আছেন। ওয়াহিদ ভাই কে নিয়ে এসেছি স্যারের কাছে। বেচারা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আর একটু পর পর চিৎকার করছে ।
স্যার নাম করা সাইকিয়াট্রিস্ট। স্যার সবশুনে আমাকে বললেন - " ওয়াহিদের একটা এম আর আই - ব্রেন করা । আর ছেলেটার সমস্যাটা ভয়াবহ । বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর ছেলেটার আইকন ছিলো। মানুষ যাকে সবচেয়ে ভালোবাসে তার অপমান সহ্য করা মানুষের পক্ষে সহজ নয় । কিছু ওষুধ চেন্জ করে দিলাম ! যোগাযোগ রাখিস, ছেলেটাকে আমার ফলোআপে রাখিস। ওর শারিরীক অবস্থা খুব নাজুক। মাথা ব্যাথার ধরণটা মোটেই সুবিধার লাগছে না ! এম আর আই করিয়ে নিউরোফিজিশিয়ান কাওকে দেখাবি । "


*২০১৫ সাল
ওয়াহিদ মারা গেছে মাস খানেক হলো..........! সুইসাইড করেছে ছেলেটা !
সালাম স্যার অনেক ট্রাই করেছেন , বেশ কয়েকটা মেডিকেল বোর্ড করেছেন ছেলেটার জন্য । লাভ হয়নি কোনো। গত মাসে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওয়াহিদের মা কাঁদতে কাঁদতে আমার ওয়াহিদের ব্যক্তিগত ডায়েরীটা দেখালেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ছেলেটা লিখে গেছে ----"
I AM EXTREMELY SORRY ON BEHALF OF MY COUNTRY DEAR MOTIUR RAHMAN.
I LOVE YOU....... LOVE MY MOTHER....... LOVE MY MOTHERLAND......

ITS 29TH OCTOBOR.......
HAPPY BIRTHDAY TO YOU , DEAR..........!! "
( কাল্পনিক )

ছোট গল্প - ফ্লাইট লেফটেনেন্ট ওয়াহিদ আর বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর ৷

Sort:  

Hii.. i upvote. Nd follow.. do the same to us.. thank u

nice post brother

Coin Marketplace

STEEM 0.20
TRX 0.13
JST 0.030
BTC 66631.72
ETH 3487.54
USDT 1.00
SBD 2.71