উৎপল দত্ত র কথা গুণ গল্প

in #story7 years ago (edited)

IMG_20180819_162546.jpg

তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।’- সেই বিচিত্র নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। পুরো নাম উৎপলরঞ্জন দত্ত। জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার বরিশালের কীর্তনখোলায়। বাবা গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মা শৈলবালা দত্ত। পড়াশোনা করেছেন শিলঙের এডমন্ডস স্কুলে, পরে কলকাতার সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৪৮ সালে ইংরেজি অনার্স নিয়ে স্নাতক করেন তিনি। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন উৎপল। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি অনার্সে তাঁর স্থান হয় পঞ্চম। স্কুলজীবনেই বাবা-মায়ের সঙ্গে পেশাদারি থিয়েটার দেখা শুরু এ মানুষটির। এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম, যার উক্তি পাওয়া যায় পরবর্তীকালে তাঁর কথায়- ‘সেই সব মহৎ কারবার দেখে মনে হলো, আমার পক্ষে অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই হওয়ার নেই।
কলেজজীবনেই অভিনয় শুরু করেন উৎপল দত্ত। ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগলের ‘ডায়মন্ড কাট্স্ ডায়মন্ড’ এবং মলিয়েরের ‘দ্য রোগারিজ অব স্ক্যাপাঁ’ দিয়েই তাঁর কলেজজীবনের অভিনয় শুরু। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিল কলেজের ইংরেজি একাডেমি এবং পরিচালনায় অধ্যাপক ফাদার উইভার। ক্রমশ উৎপল ও কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল- ‘দ্য অ্যামেচার শেকসপিয়ারিয়ান্স’। তাঁদের প্রথম উপস্থাপনা ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ এবং ম্যাকবেথ নাটকের নির্বাচিত অংশ। সেই সময়েই, ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা জেফ্রি কেন্ডাল তাঁর ‘শেকসপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদল নিয়ে ভারত সফরে আসেন। কেন্ডালের আহ্বানে উৎপল যোগ দেন সফররত সেই নাট্যদলে। ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ১৯৪৮ পর্যন্ত শেকসপিয়ারিয়ান নাট্যদল কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাদের প্রযোজনা মঞ্চায়ন করে। নাট্যমোদীরা অভিভূত হন। জেফ্রি কেন্ডালের দলে তখন নিয়মিত অভিনয় করেছেন তিনি। ইউরোপীয় থিয়েটার দলের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা উৎপলের নাট্যজীবনে ফেলেছিল বিশেষ প্রভাব। কেন্ডালের কাছেই শিখেছিলেন- There is no art without discipline and no discipline without sacrifice. তাঁর কাছেই উৎপল পেয়েছেন শেকসপিয়রের নাটকে অভিনয় করার বিশেষ শিক্ষা। এ সময়েই কেন্ডাল-কন্যা জেনিফারের সঙ্গে উৎপলের পরিচয়, অচিরেই যার উত্তরণ ঘটে প্রণয়ে। পরবর্তীকালে জেনিফারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলে তীব্র কষ্ট উৎপলকে ঘিরে ধরে। সে দহনের রেশ ছিল আজীবন। জেনিফারের সম্পর্ক মনে রেখে একাধিক কবিতাও লিখেছেন এ নাট্যকার। সহধর্মিণী শোভা সেনের কথন অনুযায়ী, উৎপলের ছিল কবিতা, ছিল ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি অথবা কোনো তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম।

উৎপল দত্ত কেবল একজন অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখকই ছিলেন না, রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী ও মার্কসবাদী। আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের ইতিহাসে অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যকার হিসেবে তাঁর স্থান সুনির্দিষ্ট। ১৯৪৭ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে শেকসপিয়র, বার্নাড শ, ক্লিফর্ড ওডেটস প্রমুখের নাটক ইংরেজিতে প্রযোজনা করতে করতেই সীমিত দর্শকসমাজের সীমাবদ্ধতায় বিব্রত হয়ে লিটল থিয়েটার গ্রুপকে (এলটিজি) বাংলা প্রযোজনার দিকে পরিচালিত করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই বৃহত্তর দর্শক সমাজের কাছে পৌঁছানোর আন্তরিক আগ্রহে গণনাট্য সংঘে ও রাজনৈতিক পথ-নাটিকার ক্ষেত্রে গ্রহণ করেন অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৫৯ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ কর্তৃক মিনার্ভা থিয়েটার অধিগ্রহণ ও নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের কর্মসূচি গ্রহণ এবং তাঁর পরিচালনায় তাঁরই লেখা ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘কল্লোল’ প্রভৃতি নাটকে রাজনৈতিক বোধ, আঙ্গিক প্রয়োগ- নাটক ও নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
গ্রুপ থিয়েটার অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয় এই শিল্পীকে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে পিপলস লিটল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক তাঁর একটি বড় পদক্ষেপ। কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ এবং আগন্তুক সিনেমায় তাঁর অনন্য অভিনয়-প্রতিভা দেখেছেন বাংলার দর্শক। তাঁর বিখ্যাত নাটকের মধ্যে রয়েছে টিনের তলোয়ার, মানুষের অধিকার, রাইফেল, সীমান্ত, ঘুম নেই, মে দিবস, দ্বীপ, রাতের অতিথি, কল্লোল, সমাজতান্ত্রিক চাল, সমাধান ইত্যাদি।
উৎপলের রাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় শ্রেণিচেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণিসচেতনতা, তেমনি ‘টোটা, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যবিত্ত চেতনা তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা। নাটক, যাত্রাসহ বহু বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও ব্যাপক খ্যাতির অধিকারী হন উৎপল দত্ত। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে বিদ্যাসাগর (১৯৫০), মাইকেল মধুসূদন (১৯৫০), চৌরঙ্গী (১৯৬৮), ভুবন সোম (১৯৬৯), ক্যালকাটা ৭১ (১৯৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (১৯৭৩), যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪), অমানুষ (১৯৭৫), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), গোলমাল (১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), আঙ্গুর (১৯৮২), পথভোলা (১৯৮৬), আজ কা রবিনহুড (১৯৮৭), আগন্তুক (১৯৯১), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উৎপল দত্ত পরিচালিত ছবি- মেঘ, ঘুম ভাঙার গান, ঝড়, বৈশাখী মেঘ, মা প্রভৃতি। শেকসপিয়রের সমাজচেতনা’ তাঁর লেখা গুরুত্বপূর্ণ এক গ্রন্থ। তিনি দীর্ঘকাল ধরে এপিক থিয়েটার নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন এবং দেশ-বিদেশের নাট্যবিষয়ক বহু সভা-সেমিনারেও অংশগ্রহণ করেছেন। নাট্যচর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি লাভ করেন দীনবন্ধু পুরস্কার, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। তবে পদ্মভূষণ উপাধি ও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট কলকাতায় প্রয়াত হন এ মহান শিল্পী।!

Coin Marketplace

STEEM 0.13
TRX 0.33
JST 0.034
BTC 110702.49
ETH 4281.10
USDT 1.00
SBD 0.83