আপনি কি সঠিক মানুষটিকে বিয়ে করেছেন অথবা করবেন?
প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে-
কাউকে বিয়ে করার আগে অবশ্যই নিজেকে এ প্রশ্নটি করবেন। জেনে বিস্মিত হবেন যে, উপযুক্ত মানুষটি বেঁচে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় কাজ করলেও, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নটির উত্তর হয়ে থাকে আবেগ এবং অনুভূতি নির্ভর। হরেক রকম মানুষ সম্পর্কে জানার মধ্য দিয়ে আপনি বিচিত্র ধরনের ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাবেন। মানুষ সম্পর্কে জানার গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনি যে ধরণের মানুষের সান্নিধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি এবং আরামবোধ করেন, সেইসব মানুষদের খুঁজে পাবেন। আর বয়স এবং মানসিক পরিপক্কতা বাড়ার সাথে সাথে নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও আপনার ভেতর গভীরতর উপলব্ধির বিকাশ ঘটবে।
এক পর্যায়ে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এমন একজনের দেখা পেয়ে যাবেন এবং তাকে বিয়ে করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারবেন। অনিবার্যভাবেই আপনার মনে প্রশ্ন আসবে, “তিনি কি আমার জন্য সঠিক মানুষটি?” সূরা আন-নূরে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন, “সুচরিত্রা নারী সুচরিত্র পুরুষের জন্য এবং সুচরিত্র পুরুষ সুচরিত্রা নারীর জন্য। লোকে যা বলে এরা তা থেকে পবিত্র; এদের জন্য আছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা।” (কুর’আন; ২৪ : ২৬) এই আয়াত আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় কে, কোন ধরণের মানুষের জন্য, তা আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নীচে কিছু অনুভূতির বর্ণনা দেওয়া হলো যেগুলো আপনি সঠিক মানুষটিকে বেছে নিয়েছেন কিনা তা জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক মানুষ হবেন এমন কেউ আপনি যার সান্নিধ্যে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন — এমন কেউ যার হতে নিজেকে নিশ্চিন্তে তুলে দেওয়া যায়। সঠিক মানুষটি আপনাকে আপনার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করবেন। এটা হতে পারে আপনার সুষ্ঠু জীবনযাত্রার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, হতে পারে পরিবার ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় আপনার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্যমী হতে আপনি অনুপ্রাণিত বোধ করবেন এবং মানসিক অবলম্বন খুঁজে পাবেন যখন জানবেন যে, আপনি যে মানুষটিকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন সে নেতিবাচক, স্বার্থপর বা খুঁতখুঁতে মানসিকতার নয়। আপনি যখন সেই মানুষটির সাথে থাকবেন তখন নিজের ভাবনা এবং অনুভুতিগুলো তার সাথে ভাগাভাগি করতে নিরাপদ বোধ করবেন। আপনি তার সহযোগিতায় নিজের সম্পর্কে সমুন্নত ধারণা পোষণ করতে পারবেন। সঠিক মানুষটি হবেন এমন যার সাথে আপনার নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে এবং আপনারা উভয়েই উভয়ের সঙ্গ উপভোগ করবেন। বন্ধুত্বের উপর দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে ওঠা জরুরি কারণ বন্ধুত্বের উপর ভিত্তি করেই ভালোবাসার বিকাশ ঘটে।
আপনি এবং আপনার জন্য উপযুক্ত মানুষটির জীবনের লক্ষ্য ও মূল্যবোধগুলো হবে একই ধরণের। এর অর্থ এই নয় যে, উভয়ের জীবনের লক্ষ্য ও মূল্যবোধগুলো হুবহু এক হতে হবে। এর অর্থ হলো, দু’জনের জীবনযাত্রায় সাংঘর্ষিক কোনোকিছু থাকবে না। ফলে আপনারা দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে সম্মত হতে পারবেন এবং একসাথে অর্জনও করতে পারবেন। সঠিক মানুষটির কাছে আপনি অনুভূতি ও উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারবেন। ফলে নিজের আবেগ অনুভূতিগুলোকে মনের মধ্যে চেপে রাখার কোনো প্রয়োজন বোধ হবে না। কোনো বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারবেন। একে অপরের মতামত শুনবেন এবং একটা সমঝোতায় পোঁছতে পারবেন। সেই মানুষটির সাথে আলোচনা হবে উপভোগ্য যা বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য সহায়ক। স্বাভাবিকভাবেই দম্পতিদের বিবাহিত জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। এসব পরিবর্তনের সাথে সুষ্ঠুভাবে খাপ খাওয়ানোর জন্য দরকার নিজেদের ভেতর কার্যকর এবং সফল বোঝাপড়া।
সঠিক মানুষটি হবেন আপনার ও আপনার চারপাশের মানুষের প্রতি সদয়, সুবিবেচক এবং বিনয়ী। তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো আপনাকে শুধু মুগ্ধ করার জন্যই নয়। এই মানুষটি আপনাকে আপনার পরিবার পরিজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে উৎসাহিত করেন। আপনারা দু’জনই বুঝতে পারবেন যে, বিয়ে হলো দুটি পরিবার মাঝে সম্পর্কের একটি সেতুবন্ধন এবং কখনোই তা বিচ্ছিন্ন দাম্পত্য জীবনের কারণ নয়। আপনার পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি এমন আচরণ একজন মানুষের আসল চরিত্রেরই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। শুধু আপনাকে সহৃদয়তায় সিক্ত করে রাখল কিন্তু আপনার পরিবার ও স্বজনদের গুরুত্ব দিলো না — এটা অসামঞ্জস্য চরিত্রের লক্ষণ। চরিত্র হলো তা-ই যা স্থান, কাল এবং পাত্র নির্বিশেষে ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত কর্ম এবং আচরণের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে ধরা দেয়।
আপনারা উভয়েই মুখে যা-ই বলুন না কেন, কর্মের মাধ্যমেই আপনাদের চরিত্র প্রকাশিত হবে। আপনার জন্য উপযুক্ত মানুষটি কখনো অমার্জিত, অপরিপক্ক মানসিকতার, উদ্ধত অথবা স্বার্থপর হবেন না; বরং তিনি হবেন বিবেকবান এবং তার আশেপাশের প্রত্যেকের প্রতি যত্নশীল। যেমন : শুধু বাবা-মা, এবং অফিসের বসের প্রতিই নয়, এমনকি হোটেলের ওয়েটার এবং অফিসের পিওন বা কেরানীর প্রতিও তিনি বিনয়ী হবেন। বিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। এসব যদি ভেতর থেকে স্বাভাবিকভাবে না আসে, তবে বিয়ের আগে আপনাকে মুগ্ধ করার জন্য যে যত সুন্দর ব্যবহারই করুক না কেন, প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডে তার আসল রূপটা বের হয়ে পড়বে।
পরিশেষে, উপযুক্ত মানুষটি হবেন সৎ — এমন একজন কাজে বিশ্বাস করা যায় এবং যার উপর আস্থা রাখা যায়। জীবনের বিভিন্ন উদ্বেগ এবং সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনি আপনার সাথে সত্যবাদী থাকবেন। তাকে বিয়ে করলে তিনি আপনার জীবনের উপর খবরদারি করবেন না; বরং নিজের জীবনকে আপনার সাথে ভাগাভাগি করে নেবেন। তিনি আপনাকে বিশ্বাস করবেন এবং আপনার সবকিছুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন না অথবা আপনি আপনার প্রতিটি কাজকে তার কাছে গ্রহণযোগ্য করবেন এমন প্রত্যাশাও তিনি করবেন না। তার সাথে থাকলে নিজেকে নিরপদ মনে হবে এবং আপনার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যেগুলো নিয়েই তিনি আপনাকে গ্রহণ করে নেবেন। মনে হবে আপনি আপনার ভুলগুলো নিয়ে তার সাথে আলোচনা করতে পারেন এবং যৌথ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নিজের দুর্বলতাগুলো শুধরে নিতে চেষ্টা করতে পারেন।
এখানে অনিবার্যভাবেই বলা দরকার যে, অসৎ অথবা আপনার নীতি ও মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত কোনো ব্যক্তিকে আপনার কখনোই বিয়ে করা উচিত নয়। দু’জন মানুষের সততা এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার উপর ভিত্তি করে একটি সুষ্ঠু দাম্পত্য জীবন বিকাশ লাভ করে।
অনেকগুলো বিষয় বিয়ের উপযুক্ততা নির্ধারনে কাজ করে। তবে সবচেয়ে অস্পষ্ট অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো সেই মানুষটির প্রতি আপনার ভালো লাগার অনুভূতি। কিছু মানুষ আছে যাদেরকে আমরা তাৎক্ষনিকভাবে পছন্দ করে বসি; আবার কাউকে আমাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয় এবং তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করি। এগুলো হচ্ছে প্রাথমিক আবেগ অনুভূতি। কিন্তু যখনই আমরা কারও সম্পর্কে জানতে চাইব এবং উপযুক্ততা যাচাই করব, আমাদেরকে মূল্যবোধ ও লক্ষ্যের উপর জোর দিতে হবে। তাদের অনুভূতির গভীরতাকে সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
সঠিক মানুষটির সাথে থাকার আরেকটি অর্থ হলো নিজের নৈতিক বা মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো। সুসম্পর্ক শান্তি বয়ে আনে, কুর’আনে বলা হয়েছে :
“এবং তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্যে হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি পাও। এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক দয়া ও ভালোবাসার সঞ্চার করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা রুম : ২১)
যেহেতু কোন মানুষই নিখুঁত বা ত্রুটিমুক্ত নয়, তাই অবাস্তব গুণসম্পন্ন মানুষ খোঁজা আমাদের উচিত হবে না। আপনার উচিত আপনার মতো একজন মানুষকে খুঁজে বের করা। মনে রাখবেন, সঠিক মানুষটি খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জের অর্ধেক মাত্র। বাকি অর্ধেক হলো নিজেকে সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যাতে অন্য কেউ আপনাকে সঠিক মানুষ হিসেবে বিয়ে করতে চায়।