প্রচারে জাহাঙ্গীরের হইচই, ভোটাররা জিম ধরে আছেন।
ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে নগরের ছয়দানা এলাকায় জাহাঙ্গীর আলমের যে বাড়ি, তাতে কম্পিউটার কক্ষ, সার্ভার আর লোকজনের যে তৎপরতা, তা দেখে বলা যায় গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এই প্রার্থী ‘হইচই’ ফেলেছেন। তবে এই হইচই ভোটের বাস্তব চিত্র কি না, তা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভাসমান মানুষ ও তরুণদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম বেশ আলোচিত। গাজীপুরের শিববাড়ি মোড়ে লেগুনা চলাচলে শৃঙ্খলা রক্ষায় যে শ্রমিকটি কাজ করছেন, তাঁর বুকেও আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও নৌকার একটা প্ল্যাকার্ড ঝোলানো। ভোগড়া বাইপাসে দেখা গেল নৌকা ও জাহাঙ্গীর আলমের জন্য ভোট চেয়ে তৈরি করা রেকর্ড এক ব্যক্তি হ্যান্ডমাইকে প্রচার করছেন।
গাজীপুর শহর, জয়দেবপুর চৌরাস্তা, ভোগড়া বাইপাস ও টঙ্গীর বেশ কিছু এলাকা ঘুরে শ-খানেক ভোটারের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের জয় মোটাদাগে তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে; স্থানীয় আওয়ামী লীগের ঐক্য, জাতীয় রাজনীতির প্রভাব এবং শ্রমজীবী ভোটারদের সমর্থন।
কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় ছয়জন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে একান্তে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দলীয় এসব সূত্র বলছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ এখনো জাহাঙ্গীর আলমের পেছনে পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। কারণ, তাঁর উত্থান ভালোভাবে নিচ্ছে না স্থানীয় আওয়ামী লীগ। জাহাঙ্গীরের সমর্থকেরাই বেশি সংখ্যক কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন-এই অভিযোগও আছে স্থানীয় পর্যায়ে। এসব অভ্যন্তরীণ বিভেদ মেটাতে ঢাকায় ডেকে ও গাজীপুরে গিয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
আওয়ামী লীগ গাজীপুরকে বরাবরই তাদের ঘাঁটি বিবেচনা করে। কিন্তু সর্বশক্তি নিয়োগ করেও ২০১৩ সালে বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে ১ লাখ ৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। তখন আলোচনা ওঠে যে জাতীয় রাজনীতিতে সরকারবিরোধী মনোভাবের কারণেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয়। এবার জাতীয় রাজনীতির আমেজ ঠেকাতে ঝাঁকে ঝাঁকে কেন্দ্র থেকে নেতাদের প্রচারে না যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুর চৌরাস্তায় একজন ভোটার বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ‘টাকাওয়ালা’। খরচও করছেন দুই হাতে। আর তরুণ প্রার্থী, নিজস্ব লোকবল আছে। ফলে তাঁর সম্ভাবনা ভালো।
অবশ্য ভোগড়া বাইপাসে এক ভোটার বলেন, বাসাবাড়ির ভোটাররা এখনো ঝিম ধরে আছেন। শেষ পর্যন্ত নৌকা আর ধানের শীষেরই লড়াই হবে। এর বাইরে গোষ্ঠীর জোর, টাকার জোর, এলাকাপ্রীতি কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে।
১৫ মে দলীয় প্রতীকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ভোট হবে। ভোটার ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। ২০১৩ সালে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় চাপে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মূল শক্তি তরুণ, শ্রমিক, নারী ও দল। আধুনিক শহর গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কারণে সাড়া পড়েছে। তাঁর দাবি, দলের সবাই এখন মাঠে নেমেছেন।
প্রচারে ‘হইচই’ বাধিয়েছেন জাহাঙ্গীর
নির্বাচন লক্ষ্য রেখে গত বছর প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন’। এর অধীনে ৩২০ জন ব্যক্তি ট্রাফিক পুলিশের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। যাঁদের সর্বনিম্ন বেতন ১০ হাজার টাকা। ফাউন্ডেশনের অধীনে ২২ হাজারের মতো শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে মাসে খরচ কোটি টাকার ওপরে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে-পরে বিভিন্ন কর্মীর খাওয়াদাওয়া, প্রচার, পোস্টার টানানো, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ রক্ষা-সব কটিরই আলাদা আলাদা কমিটি করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। এর বাইরে ৪২৫টি কেন্দ্রের আলাদা কমিটি রয়েছে। গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের রয়েছে ১১৬টি কমিটি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ছয়দানা এলাকায় মহাসড়ক ঘেঁষে জাহাঙ্গীর আলমের চারতলা বাড়ি। সোমবার গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেলে ভরা। বাড়ির পূর্ব পাশে একটি খোলা স্থানে বড় মঞ্চ। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই নানা ধরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে। দ্বিতীয় তলায় জাহাঙ্গীর আলমের নিজস্ব কার্যালয়। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য যুবকদের কয়েকজনের হাতে ওয়াকিটকি দেখা গেল।
জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ফাউন্ডেশনে কত টাকা খরচ হয়, এর হিসাব বলা কঠিন। কোনো মাসে বাড়ে, কোনো মাসে কমে। তিনি দাবি করেন, তাঁর ফাউন্ডেশনের অধীনে চীনের সঙ্গে যৌথ সহায়তায় ফ্ল্যাট ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মেয়র হলে এই কাজ ত্বরান্বিত হবে।
দলে বিভেদ
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ১০ জন নেতা দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। আজমত উল্লা খানসহ সবাই দলের স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা। জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এ জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে পাশে থাকার ঘোষণা দিলেও মাঠের প্রচারে তাঁদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে কম।
আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে এক সপ্তাহের বেশি। এর মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র পদে মনোনয়নবঞ্চিত আজমত উল্লা খান ২৭ এপ্রিল একবার মাঠে নামেন। মান ভাঙাতে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে আজমত উল্লাকে দলীয় প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট করা হয়। ২৮ এপ্রিল কালিয়াকৈরে জেলা আওয়ামী লীগের যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তবে আজমত উল্লাকে দেখা যায়নি।
জানতে চাইলে আজমত উল্লা প্রথম আলোকে বলেন, দল ঐক্যবদ্ধ। দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। তিনি গতকাল দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে প্রচারে অংশ নিয়েছেন বলে জানান।
১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাহাঙ্গীর ভাওয়াল বদরে আলম কলেজের ভিপি নির্বাচনে হেরে যান। এরপর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য হন। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে সদর উপজেলা থেকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এখান থেকেই তাঁর উত্থান। এরপর এক লাফে ২০১৫ সালে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দলের বড় একটা অংশ জাহাঙ্গীরের পাশে হাঁটছে না। আবার জাহাঙ্গীরও মনে করছেন, তাঁর নিজের লোক দিয়েই নির্বাচন করে জিততে পারবেন। দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে জরিপে জাহাঙ্গীরই এগিয়ে ছিলেন। ভোটের আগে মান-অভিমান কমে আসবে বলে মত ওই নেতার।
গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সর্বশেষ ঠিকানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জাহাঙ্গীরকে প্রার্থী করেছেন। সরকারের উন্নয়নের কারণেই তাঁদের প্রার্থী জয়ী হবেন।
জাহাঙ্গীর ব্যতিক্রম
গাজীপুর সিটি করপোরেশনে তিন-চার লাখ শ্রমিক ভোটার আছে। গাজীপুর ও টঙ্গীতে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত নেতা আছেন বা ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রায় সব নেতাই দীর্ঘদিন মাঠে থেকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শিল্প এলাকা বলে শ্রমিকনেতাদের শক্ত অবস্থান বরাবরই। আহসান উল্লাহ মাস্টার শ্রমিকনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। এম এ মান্নান কাউলতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, সাংসদ, প্রতিমন্ত্রী ও সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র হন। টঙ্গীতে সরকার পরিবার প্রভাবশালী দীর্ঘদিন থেকেই। হাসান উদ্দিন সরকার টঙ্গী পৌরসভার মেয়র, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাংসদ হয়েছেন। আজমত উল্লা খানেরও টঙ্গীতে পারিবারিক ঐতিহ্য আছে। এ তালিকায় জাহাঙ্গীর আলমের বংশের জোর কিছুটা কম। রাজনৈতিক জীবনও এতটা বর্ণাঢ্য নয়।
কাউন্সিলর নিয়ে জটিলতা
গাজীপুর সিটির ৫৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১ টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর হয়ে গেছেন। বাকি ৫৬ টির প্রায় সব কটিতেই আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী আছেন। অথচ আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড কেন্দ্রীয়ভাবে সব ওয়ার্ডে এক প্রার্থী ঘোষণা করেছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, দলের সমর্থন পাওয়া ৫৬ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীর বেশির ভাগই জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থক। এই নিয়ে বিভেদ তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নের ফরম সংগ্রহ করা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওয়াজ উদ্দিন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক বলে দিয়েছেন কাউন্সিলর নির্বাচন যার যার, অর্থাৎ উন্মুক্ত। ওয়াজ উদ্দিনের ভাতিজা শাহজাহান মিয়া ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী।