শেষ বিকেলের মায়া - আমার লেখা ছোট একটি গল্প - পার্ট ০৪
ডিরেক্টর। ‘আমি আমার মায়ের হাত ধুয়ে দিয়েছি। আর মায়ের বাকি কাপড়গুলোও ধুয়ে দিয়েছি।' কথাটা বলতে বলতে যে তরুণের চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল তা ডিরেক্টরের দৃষ্টি এড়াল না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে নিলয় আবার বলা শুরু করল, ‘আজ আমি যা তা সবটাই আমার মায়ের জন্য।' ডিরেক্টর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তরুণের দিকে। ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বলে চলল তরুণ, ‘আজ বুঝতে পারছি কাজের মূল্যায়ন কাকে বলে। মাকে সাহায্য করে আজ আমি বুঝলাম, একা একা নিজে থেকে কোনো কাজ করাটা কতটা কঠিন। আর নিজের পরিবারকে সাহায্য করার গুরুত্ব এবং মূল্যও আমি আজ উপলব্ধি করতে পারলাম।’ ‘আমি একজন ম্যানেজারের মধ্যে এই গুণটাই খুঁজছিলাম।' এটুকু বলে ডিরেক্টর নিজের চেয়ারে হালকা করে হেলান দিয়ে বললেন, ‘এমন একজন যে অন্যের সাহায্যের মূল্যায়ন করতে পারে। অন্যের কাজের প্রশংসা করতে পারে। যে কিনা অন্যের কতটুকু কাজ করার ক্ষমতা আছে তা বুঝবে। অন্যের কষ্ট নিজে উপলব্ধি করতে পারবে। এমন কেউ যে নিজের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে টাকাকে রাখে না'—বলতে বলতে একটু থামলেন ডিরেক্টর। চেয়ারে সোজা হয়ে বসে নিলয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘ইউ আর হায়ারড, ইয়াং ম্যান।' কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অধীনস্থদের সম্মান অর্জন করে নিল নিলয়।
অন্য সবাইও খুব যত্নের সাথে দলীয়ভাবে কাজ করে। ফলে সেই কোম্পানির পারফরম্যান্স অনেক উন্নতির দিকে এগুচ্ছিল। খুব আদর যত্নে তুলুতুলু করে যে শিশুকে বড় করা হয়, সে নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বুঝে না; এমনকি তার বাবামায়ের যত্নেরও মূল্যায়ন করতে জানে না। কর্মক্ষেত্রে তাই সহকর্মীদের কায়ক্লেশ তাকে নাড়া দিতে পারে না। অন্যের কাজের দোষ ধরায় বা খুঁত খুঁজতেই ব্যস্ত থাকে সে। এমন মানুষরা হয়তো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব ভালো হতে পারে; হয়তো সাময়িকভাবে সফলও হতে পারে; কিন্তু দিন শেষে তাদের অন্তরটা শূন্য পড়ে রয়। কৃতিত্বের কোনো অনুভূতিই তাদের ছুঁয়ে যেতে পারে না, ফলে তারা খুব ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের বুকের ভেতরটা ভরে ওঠে অন্যের প্রতি ঘৃণায়। এর থেকে বের হতে তাদের মধ্যে ‘আরও চাই আরও লাগবে' এমন একটা মনোভাব গড়ে ওঠে। আম্মি একটা কথা প্রায়ই বলে, ‘টবের গাছ হবা না' কথাটার ভাব-সম্প্রসারণ হলো, টবের গাছের খুব বেশি যত্ন নেওয়ার পরও তা হয় দুর্বল। কিন্তু এই একই গাছ রুক্ষ শুষ্ক কোথাও একেবারে যত্নহীন অবস্থায় বেড়ে ওঠেও হৃষ্টপুষ্ট ফল দেয়।
একেবারে দাগহীন, কোমল হাত। ডিরেক্টর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি কখনো -তামার মাকে কাপড় ধুতে সাহায্য করেছ?' কখনই না। মা সব সময়ই চেয়েছেন আমি যেন ভালো করে পড়াশোনা করি। বেশি বেশি বই পড়ি। এর বাইরে কোনো কাজ আমাকে কখনো করতে দেন না। তা ছাড়া, মা আমার থেকেও অনেক দ্রুত কাপড় ধুয়ে ফেলেন। আমি ধুতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যায়।’ ‘আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করতে চাই। রাখবে?' ‘জি, স্যার। নিশ্চয়।' বিনয়ী কণ্ঠে বলল নিলয়। ‘আজ বাসায় গিয়ে তোমার মায়ের হাত জোড়া নিজের হাতে ধুয়ে দিবে। তারপর কাল সকালে আমার সাথে দেখা করবে।' ܀܀܀ অফিস থেকে বের হয়ে মনটা বেশ প্রফুল্ল লাগছে নিলয়ের।
মনে হচ্ছে চাকরিটা হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে তার হাত জোড়া চাইল ধুয়ে দিতে। ছেলের এমন অদ্ভুত আবদারে মা বেশ অবাক হলেন। সাথে খুব খুশিও হলেন। আনন্দ আর আশ্চর্যের এক মিশ্র অনুভূতি খেলা করে গেল মায়ের মন জুড়ে। হাসি মুখে নিজের হাত জোড়া বাড়িয়ে দিল ছেলের দিকে। তরুণ বেশ মনোযোগ দিয়ে ধীরে ধীরে মায়ে হাত ধুয়ে দিতে লাগল৷ ধুয়ে দিতে দিতে ছেলেটার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। জীবনে এই প্রথম ছেলেটা তার মায়ের কুঁচকে যাওয়া হাতটা খেয়াল করল। হাত দুটোর এখানে সেখানে কত ক্ষত চিহ্ন। কিছু ক্ষত তো এখনো তাজা। ছেলের স্পর্শে মা ‘উফ!' বলে ব্যথায় চোখ বুজে ফেলছে। এই হাত জোড়া প্রতিদিন কত কাপড় ধুয়ে, কত পরিশ্রম করে তার পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছে। প্রতিটা ক্ষত চিহ্ন যে তার স্কুলের ফি, বইপত্রের খরচ আর ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়; নিলয় এই প্রথম তা উপলব্ধি করল। মায়ের হাত ধুয়ে দিয়ে নিলয় নীরবে মায়ের বাকি কাপড়গুলোও ধুয়ে দিল। মা ছেলে খুব গল্প করল সে রাতে।
This post has been upvoted by @italygame witness curation trail
If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness
Come and visit Italy Community
Hi @fxsajol,
my name is @ilnegro and I voted your post using steem-fanbase.com.
Come and visit Italy Community