বনফুল কে নিয়ে আমার লেখা ছোট একটি গল্প - পর্ব ১
ছোটগল্প এক হিসেবে গীতিকবিতার সঙ্গে তুলনীয়। উভয় ক্ষেত্রেই মুহূর্তলীলার মধ্যে শাশ্বত জীবনরহস্যের দ্যোতনা অভিব্যঞ্জিত হয়। তফাতের মধ্যে এই যে গীতিকবিতায় কেবল কবিমানসের নিজের ভাবময় মুহূর্তগুলোরই প্রকাশ; ব্যক্তি সেখানে একটিই, অনুভূতিও স্বভাবতই আত্মনিষ্ঠ। কিন্তু ছোটগল্পে বহুব্যক্তির বহুচিত্রিত মুহূর্তের বহুনিষ্ঠ ভাব-ভাবনার উন্মেষ। স্বভাবত রূপে বর্ণে স্বাদে ও গন্ধে ছোটগল্পের বৈচিত্র্য অন্তহীন। জীবনসত্য সেখানে বহুরূপী হয়ে স্রষ্টার কাছে ধরা দেয়। বনফুলের ছোটগল্পে মানবজীবনের এই বহুরূপী রূপটিই বিচিত্রভাবে ধরা দিয়েছে। কখনো তা সুন্দর, কখনো কুৎসিত, কখনো তা উদার, কখনো তা নীচ, কখনো আত্মসুখপরায়ণতায় অতিসংকীর্ণ, কখনো পরার্থে আত্মোৎসর্গের মহিমায় গৌরবান্বিত। মানুষ স্বর্গের দেবতাও নয়, আবার নরকের শয়তানও নয়। মানুষ মানুষই। সে ভুল করে, অন্যায় করে, পাপাচরণ করে, আবার ভুলের মাশুলও তাকে দিতে হয়, পাপের প্রায়শ্চিত্তও করতে হয় মহার্ঘ্য মূল্যে। সব কিছু মিলিয়েই মানবজীবন, আবার তাই মানুষের নিয়তি। অদ্ভুত কিন্তু অত্যাশ্চর্য। বনফুল মানুষের এই জীবনকে তার যথাযথ মূল্যে সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন। জীবন সম্পর্কে যেমন তাঁর কোনো অতীন্দ্রিয় মোহ ছিল না, তেমনি কোনো বিশেষ আদর্শের প্রতিও তাঁর অকারণ অনুরক্তি ছিল না।
দার্শনিক পরিভাষায় যাকে ‘তটস্থ দৃষ্টি' বলে, তাঁর দৃষ্টি সেই দৃষ্টি। জীবনসত্যের নিরীক্ষায় কোনো পূর্বধার্য তত্ত্বের অনুশাসন স্বীকার না করে সর্বসংস্কারমুক্ত দৃষ্টির সম্মুখে বহু পরীক্ষা ও বহু পর্যবেক্ষণের সাহায্যে জীবনকে জানার যে আবেগ, তাঁর ব্যক্তিমানসে সেই আবেগই প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। এদিক দিয়ে তাঁর মনের গড়ন ছিল দার্শনিকের নয়, বৈজ্ঞানিকের। বস্তুত আমাদের সাহিত্যে তাঁকেই প্রথম পরিপূর্ণ বিজ্ঞাননিষ্ঠ বুদ্ধিবাদী লেখক বলা যেতে পারে। অভিজ্ঞতাবাদ বা Empiricism-এর সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই তাঁর জীবনচৈতন্য গড়ে উঠেছে। জীবনকে অভিজ্ঞতার মধ্যে যতটুকু জেনেছেন, ততটুকুকেই তার যথার্থ মহিমায় তিনি প্রকাশ করেছেন। স্বভাবতই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র দিনদিন প্রসারিত হয়েছে, জীবনসত্যও সঙ্গে সঙ্গে নব নব রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে। রূপ হতে রূপে, প্রাণ হতে প্রাণে এই ক্রমশ-উদ্ভিন্নমান জীবনসত্যের স্বীকৃতিই তাঁর শিল্পি-মানসের বৈশিষ্ট্য। এমন কি তিনি তাঁর মনকে চিরমুক্ত রেখেছেন বলেই ব্যবহারবাদে নির্ভরশীল হয়েও মানুষের মনোলোকের রহস্যানুভূতির অভিজ্ঞতাকেও তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। তাঁর সাহিত্যে জীবনরহস্য যথা মানবপ্রকৃতির এই অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দেখে তাঁকে Naturalist বা প্রকৃতিবাদী বলে ভুল করা অস্বাভাবিক নয়। বস্তুত ফরাসী সাহিত্যে প্রকৃতিবাদ জোলা বা বালজাকের রচনায় একটা সার্থক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। সাহিত্যে তার মূল্যও বড় কম নয়। জীবনকে তার আপন স্বরূপে ফুটিয়ে তুলতে পারাতেও লেখকের ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু বনফুল জোলা বা বালজাক বা মোপাসাঁ-তন্ত্রের লেখক নন। তাঁকে জীবনের শুধু রূপকারই বলা যায় না, তিনি জীবনের ব্যাখ্যাকারও বটেন। আর সেখানেই তাঁর ব্যক্তিত্ব তাঁর সৃষ্টিকর্মে আত্মপ্রকাশ করেছে।