প্রকৃতির কাছে মানুষ অতি নগণ্য(10% carepoint70জন্যে)
প্রকৃতি কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় না।
মানুষ যেমন হয়।
প্রকৃতি কখনো অভিসম্পাত করে না।
মানুষ যেমন করে।
প্রকৃতি কখনো লোভী হয় না।
মানুষ যেমন হয়।
প্রকৃতি হয় শান্ত-স্নিগ্ধ-অপ্রতীম।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, প্রকৃতি কখনো হৃদয় আর ভালোবাসার সঙ্গে ধোঁকা দিতে পারে না।
কিন্তু আমরা যারা নিজেদের মানুষ বলে দাবি করি, সেই আমরা হৃদয় ভাঙি, ভালোবাসার সঙ্গে করি মিথ্যাচার। ভাঙাগড়ার খেলায় জলকাদা মিশিয়ে একাকার করে দিই। প্রকৃতিও তখন বিস্মিত হয়।
ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা খরা—এসব তো প্রকৃতিরই লীলা। মানুষ তার অপার ক্ষমতায় সেসব দুর্যোগ জয় করে নিজেকে অতিমানব থেকে কখনো কখনো ঈশ্বর ভেবে বসে। সেই অহংকারের মিথ্যা অভিলাষ মানবজাতিকে আজ বোধহয় টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে এনেছে গভীর এক খাদের কিনারে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘ন্যাচার অব রিভেঞ্জ’। কিন্তু শুরুতেই বলেছি প্রকৃতি কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ বা নেতিবাচক হয় না। তাহলে ন্যাচার অব রিভেঞ্জ কথাটা কেন বলি? তার নিশ্চয় একটা কারণ আছে। প্রকৃতিও মানুষের মতো প্রাণের দাবি রাখে। সহনশীলতা সম্প্রীতি বোধের মাত্রা তারও তো আছে, তা–ই নয় কি? তাই সময়ের তাগিদে কখনো কখনো প্রতিশোধপরায়ণ তাকেও হতে হয়। কী দেয়নি এই প্রকৃতি আমাদের! আলো-বাতাস-নদী-পাহাড়-ঝরনা-ফুল-প্রজাপতি-মেঘ এমনকি গহিন অরণ্য।
তাই জন মুরের ভাষায় বলি, যখন আমি প্রকৃতির কাছে যাই, মনটাকে হারিয়ে ফেলি, খুঁজে পাই আমার আত্মাকে।
কিন্তু হায়, এই মানবসমাজের অমানবিক আমরা নানা ঘাতপ্রতিঘাতে ধরণির ঐশ্বরিক সৌন্দর্যকে এতটাই বিপর্যস্ত করে তুলেছি যে প্রকৃতির খুব কাছে যেয়েও মন আর আত্মাকে বোঝার মতো মানবিক বোধ আজ মৃতপ্রায় বিকেলে।
অভিমানী প্রকৃতিতে হানা দিয়েছে মরণব্যাধী কোভিড-১৯। কত রকম রোগ–শোক প্রকৃতি তার বুক পেতে আগলে রাখে এই মানবসভ্যতার জন্য। কিন্তু মনুষ্যত্ব ভূলণ্ঠিত হতে হতে আমরা এমন এক বীভৎস রূপ ধারণ করেছি যে সত্যি প্রকৃতি আজ আমাদের প্রতি বিরূপ। তার কোনো ক্ষমতাই আজ আর আমাদের রক্ষা করতে নারাজ এই মৃত্যুগ্রাসী করোনাভাইরাসের ভয়ংকর থাবা থেকে।
আচ্ছা বলুন তো, কী করে প্রকৃতি উদার হবে? বন, বৃক্ষ, নদী, পাহাড় এমনকি পশুপাখিদের আবাসস্থলেও আজ মানবজাতির রাজত্ব। বয়ে চলা শান্ত নদীর বুক চিরে বানানো হয় মহারাজের পঙ্খীরাজ পাজেরো মার্ডিসিজের জন্য পিচঢালা কংক্রিট পথ। সাগরের সলিল শুভ্র ফেনায় আজ বিষাক্ত দানবের হুংকার। সবুজ কচি পাতার আড়াল ভেঙে গাছেদের বুকে ধারালো করাত বসিয়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে মানুষ আমরা হয়ে উঠি বণিক বাদশা।
মৃত্তিকার মেঠো গন্ধে ভরে ওঠে মন। বৃষ্টিস্নাত ধুলায় উবে যায় যাবতীয় গ্লানি। অথচ নিয়মের অবাধ্য হয়ে সেই মাটির ওপর গড়ি বিশালকার সব অট্টালিকা আর একশ্রেণির মানুষকে পিঁপড়ার মতো পিষে মারি পায়ের তলায়। যে মাটি থেকে জন্ম যেখানে আবার ফিরে যাওয়া, সেই মাটিকেই করি নিতান্ত তুচ্ছতাচ্ছিল্য।
বছরের পর বছর যুগের পর যুগ এভাবেই প্রকৃতি হচ্ছে ক্ষতবিক্ষত। অশ্রুসিক্ত প্রকৃতি নিজেও আজ মানুষের এমন অসহায়ত্বে স্তব্ধ-নির্বাক।
ক্ষমতা, শিক্ষা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অহংকার মানুষকে নিয়ে গেছে এক মিথ্যার মহাজাগতিক স্রোতে ভাসিয়ে ভাসিয়ে অন্ধকারের পথে। পাপে পাপে ভরে গেছে ধরণির প্রতিটি বিন্দুকণা। অথচ চাইলেই আমরা শিক্ষা নিতে পারি নির্মল স্নিগ্ধ এই প্রকৃতির কাছ থেকে। কীভাবে অহর্নিশ তারা দিয়ে চলেছে আমাদের অবিরাম ধারায় দুহাত ভরে।
বৃষ্টিজল যেমন ধুয়ে নেয় জাগতিক পাপ–তাপ। রৌদ্রের প্রখরতায় শেওলা জমা সব দুঃখ–বেদনা হয়ে যায় আনন্দরাশি। তেমনি শান্ত নদীর বুকে নরম জলের সঙ্গে মধ্য দুপুরে কাটে যে একাকী সময় তার অনুভূতি ঐশ্বরিক সৌন্দর্যকেও যেন হার মানায়। তাহলে কেন আমরা প্রকৃতির মতো হই না? কেন হতে পারি না রাতের রুপালি আলোর মতো উদার? সবুজ–শ্যামল প্রকৃতির সব অবদান কি তবে মিথ্যা?
বহতা নদী হয় ভরাট পাথরের ঢিবি, সবুজ বনানী হয়ে যায় কলকারখানা, সাগর হয় ভাগবাঁটোয়ারা, রাতের আকাশও হয়ে যায় দ্বিখণ্ডিত। মানুষ আর প্রকৃতিতে এখন যোজন যোজন ব্যবধান। মানুষের এই নিষ্ঠুরতায় প্রকৃতি সত্যি নিশ্চুপ। অথচ প্রকৃতিও নিজের মতো করে বাঁচতে চায়।
সারা পৃথিবীতে মহামারি আকার ধারণ করেছে করোনাভাইরাস। যা কিনা দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না। পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ নির্বিকার চেয়ে আছে ওই আকাশের দিকে। কখন ওপরওয়ালা নিস্তার দেবেন এই ভয়ংকর বিপদ থেকে। থেমে গেছে পুরোটা পৃথিবী। অচল হয়ে পড়েছে জাগতিক সব কর্ম।
বন্ধ হয়ে আছে আকাশে বিমান চলাচল। ভিনদেশে আটকে আছেন অনেকেই। ভাবুন তো, টাকাই কি তবে সব? মুঠোভর্তি টাকা মাথায় কত বিদ্যে কিন্তু প্রকৃতির অঘোষিত হঠাৎ আসা এক মরণথাবা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা। তাহলে কোথায় মানুষের ক্ষমতা? মানুষ প্রকৃতির কাছে সত্যিই অতিক্ষুদ্র।
দামি ফ্ল্যাট ঝা–চকচকে গাড়ি অথচ আপনি চার দেয়ালে বন্দী। যে টাকার অহংকারে মানুষকে মানুষ ভাবতে ভুলে গেছেন, ব্যবহার করেছেন নগণ্য প্রাণী হিসেবে, সেই টাকা দিয়েও কিনতে পারছেন না ইচ্ছেমতো খাবার বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী। কারণ, বাইরে অদৃশ্য শত্রু কোভিড–১৯। যাদের মানুষই ভাবেননি, কোনোকালে সেই তাদের সাহায্য নিতে হচ্ছে একটু খাবার বা ওষুধ কেনার জন্য। ভেবে দেখুন, আমরা মানুষেরা কত অসহায়! অথচ প্রকৃতি কিন্তু থেমে নেই। এখনো সূর্য উঠছে, রোজ সকালে পাখিও ডাকছে। ফুলেরাও হেসেখেলে দিব্যি রয়েছে। থেমে গেছি কেবল আমরা যাদের সৃষ্টিকর্তা আশরাফুল মাখলুকাত বলেছেন। আমরা কি সেই মর্যাদাটুকু রাখতে পারছি? তবে কিসের এত দাম্ভিকতা?
কী নির্মম, করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় সন্তানেরা মাকে জঙ্গলে ফেলে গেছেন। আর কীভাবে বোঝালে আমরা বুঝব যে অমানবিকতার সর্বোচ্চ শিখরে আমরা পৌঁছে গেছি।
শুধু কি তা–ই, রোজ রোজ কাগজে চ্যানেলে দেখছি কত মানুষ অভুক্ত দিন পার করছে। কাজের অভাবে মানুষ পাগলপ্রায়। অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করেছে। মুখে খাবার দিতে না পেরে মা হয়ে সন্তানকে ছুড়ে ফেলছে নদীতে। কী নির্মম কী বেদনাদায়ক! এসব দেখেও যাদের হৃদয় পাথর হয়ে থাকে, তারা মানুষ নামের কলঙ্ক। গোটা পৃথিবী দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে যাচ্ছে। এমন মহামারি সংকটেও জনপ্রতিনিধি চুরি করছেন ত্রাণ। মানুষ কতটা নীচ হলে, কতটা অপদার্থ হলে এমন জঘন্য অপরাধ করতে পারে, তা বোধগম্য নয়।
মানুষের সামনে আজ সব দুয়ার বন্ধ। মহান আল্লাহ তাআলা মানুষকে কঠিন এক পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, কোনো ক্ষমতাই তোমাদের নেই। এমনকি প্রকৃতিও মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে মাত্র। বেঁচে থাকাটাই মানুষের জন্য আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অহংকার, লোভ, লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ—এসব তোমাদের মানায় না, তোমাদের সামর্থ্য খুব সীমিত।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, প্রকৃতির কাছে গেলে মন ভালো হয়ে যায়, প্রকৃতি সুন্দর হলে মনও সুন্দর হয়ে যায়। কিন্তু কোথায় গেলে আর কতটা বোঝালে মানুষ বুঝবে, মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে? বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি কিছু লাগে কি? এমন বিপর্যের মুখোমুখি হয়েও যদি আমরা সেটা বুঝতে না পারি তবে মানুষ হিসেবে আমরা সত্যি অযোগ্য।
পৃথিবীর ফুসফুসে আজ অক্সিজেনের ঘাটতি। আসুন আমরা পৃথিবীটাকে বাঁচতে সুযোগ দিই।
খুব কষ্ট হয়, দুঃখ হয়। সারা পৃথিবীর মানুষ যেখানে যুদ্ধ করে চলেছে কোভিড–১৯–এর বিরুদ্ধে সেখানে আমরা এমন এক লোভী জাতি সরকারি ত্রাণের চাল চুরি করতে ব্যস্ত। ছি ছি, কী লজ্জা কী লজ্জা। আমরা আর কবে মানুষ হব? এসব দেখে তো মনে হচ্ছে কেয়ামতের মাঠে দাঁড়িয়েও আমরা এ ওর পকেট মারতে দ্বিধা করব না।
সম্প্রতি চলে গেল বাঙালির সবচেয়ে আনন্দমুখর উৎসব পয়লা বৈশাখ। করোনাভাইরাসের কারণে সবাই ঘরে বসে পালন করেছে এবারের বৈশাখ ১৪২৭। এমন ফ্যাকাশে বিবর্ণ বৈশাখ আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। সম্ভবত প্রকৃতিও লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলেছে। আমাদের আনন্দ–উল্লাসের জন্যই তো প্রকৃতিতে এমন রঙের ছোঁয়া লাগে।
সবাই জানি এবং বুঝতে পারছি সময়টা একদমই ভালো যাচ্ছে না। আমরা যে যেখানে আছি কেউই ভালো নেই। তবে আমি আশাবাদী মানুষ দুঃখকে জয় করতে সদা প্রস্তুত। আপনারাও আমারই মতো বিশ্বাস করেন খুব কাছে সুদিন। কাজেই আসুন নিজেদের সবটুকু মনোবল শক্তি সাহস দিয়ে এ যুদ্ধে লড়ে যাই। দূরে থেকেই কাছে থাকার চেষ্টা করি। আবার নিশ্চয় দেখা হবে আড্ডা জমবে প্রিয় বন্ধুর বাড়িতে উঠবে চায়ের কাপে ঝড়। মাত্র তো কটা দিন ঘরে থাকি সুস্থ থাকি আর নিরাপদ থাকি।
আমাদের কমিউনিটিতে স্বাগতম। নিয়মিত পোস্ট করবেন।
Ok