ঢাকার ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল জাদুঘর ভ্রমণ কাহিনী। ১০% @btm-school
২০১৬ সাল। আমার ছোট কাকা পুরান ঢাকায় থাকেন, একদিন কাকার ওখানে ঘুরতে গেলাম, কাকা সদরঘাট পাটুয়াটুলী থাকেন। কাকাকে বললাম পুরান ঢাকায় তোমার এই আশেপাশে দর্শনীয় স্থান কি আছে? কাকা তখন আমাকে আহসান মঞ্জিল এর কথা বললো, যদিও আমি জানতাম আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকায় আর বুড়িগঙ্গা নদীর পাশে। তো যাই হোক, ইসলামপুরের কুমারটুলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষা ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ, যা বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। তবে নদীর ধারে হওয়ায় সুন্দর ছিল, কিন্তু নদীর পানি দূষন আর নোংরা আবর্জনার কারনে প্রচণ্ড বাজে গন্ধ ছিল চারদিক। যেটার কারণে নদীর ধারে এই আহসান মঞ্জিলের সৌন্দর্য শতভাগ ফোটে উঠেনি। তারপরও প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন এই ঐতিহাসিক স্থান, প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিল। আমি অবশ্য একাই গিয়েছিলাম।
তো যাই হোক, এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। ১৮৫৯ সালে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পথ শুরু আহসান মঞ্জিল থেকেই। এখান থেকেই ১৯০৬ সালে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থান রঙমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে তার ছেলে শেখ মতিউল্লাহ রঙমহলটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। বাণিজ্য কুঠি হিসাবে এটি দীর্ঘ দিন পরিচিত ছিল। এরপর ১৮৩০ সালে বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গণির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এটি কিনে বসবাস শুরু করেন। এই বাসভবনকে কেন্দ্র করে খাজা আবদুল গণি মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ও প্রকৌশল-প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেন। ওই যুগে নবনির্মিত প্রাসাদ ভবনটি রঙমহল ও পুরাতন ভবনটি অন্দরমহল নামে পরিচিত ছিল।
১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রবল ভূমিকম্পে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্থ আহসান মঞ্জিল পুনঃর্নির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়। পুনঃর্নির্মাণ ও মেরামতের জন্য রাণীগঞ্জ থেকে উন্নতমানের ইট আনা হয়। মেরামত কর্ম পরিচালনা করেন প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়। সেই আমলে ঢাকা শহরে আহসান মঞ্জিলের মতো এত জাঁকালো ভবন আর ছিল না। এর প্রাসাদোপরি গম্বুজটি শহরের অন্যতম উঁচু চূড়া হওয়ায় তা বহুদূর থেকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো, যেটা এখন আর বহুদূর থেকে দেখার সুযোগ নেই, কারণ প্রচুর বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে আহসান মঞ্জিলের চারপাশে তথা ঢাকা শহরে। দ্বিতীয় বারের মতো ১৮৯৭ সালে ১২ জুন ঢাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এ মঞ্জিলের দক্ষিণের বারান্দাসহ ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবত খানাটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। পরবর্তীকালে নবাব আহসানুল্লাহ তা পুনঃনির্মাণ করেন। ১৯৫২ সালে জমিদারী উচ্ছেদ আইনের আওতায় ঢাকা নওয়াব এস্টেট সরকার অধিগ্রহণ করে। কিন্তু নওয়াবদের আবাসিক ভবন আহসান মঞ্জিল এবং বাগানবাড়িসমূহ অধিগ্রহণের বাইরে থাকে। কালক্রমে অর্থাভাব ও নওয়াব পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে যাওয়ায় আহসান মঞ্জিলের রক্ষণাবেক্ষণ দুরূহ হয়ে পড়ে। এই প্রাসাদের ছাদের উপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এই গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও দেখতে সুন্দর। মেইন গেট থেকে টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট না কাটলে মূল ভবনের ভিতরে প্রবেশ করা যাবে না, তখন টিকেট মূল্য ছিলো সম্ভবত ২০ টাকা করে, এখন হয়তো কিছুটা বাড়তে পারে। একইভাবে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দু’টি মনোরম তোরণ আছে যা সবচেয়ে সুন্দর। আহসান মঞ্জিলের অভ্যন্তরে দু’টি অংশ আছে। বৈঠকখানা ও পাঠাগার আছে পূর্ব অংশে। পশ্চিম অংশে আছে নাচ ঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ। নিচতলার দরবার গৃহ ও ভোজন কক্ষ রয়েছে। নিচতলায় গিয়ে আমি হাতির মাথার কংকালও দেখেছিলাম, কি আশ্চর্য সেই কংকাল। ছবি তোলা নিষেধ ছিল তাই তোলা হয়নি। প্রাসাদের বাইরের সৌন্দর্য অনেক সুন্দর। প্রাসাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একতলার সমান উঁচু করে বারান্দা। দক্ষিণ দিকের বারান্দার ওপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে একটি সুবৃহৎ খোলা সিঁড়ি সম্মুখের বাগান দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। সেই সিঁড়িতে বসে এই ছবিটি তুলেছিলাম।
প্রাসাদের উভয় তলার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলান সহযোগে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা ও কক্ষগুলোর মেঝে মার্বেল পাথরে শোভিত। গম্বুজের সৌন্দর্যে আহসান মঞ্জিল আলোকিত। এর দোতলায় নির্মিত অনুরূপ গোলাকার কক্ষের ঊর্ধ্বাংশে স্কুইঞ্চের মাধ্যমে ছাদের কাছে কক্ষটিকে অষ্টভূজাকৃতির করা হয়েছে। এই অষ্টকোণ কক্ষটিই ছাদের উপর গম্বুজে পরিণত হয়েছে। পরিশেষে অষ্টবাহুর মাথাগুলোকে কেন্দ্রের দিকে ক্রমে হেলিয়ে গম্বুজটি তৈরি করা হয়েছিল। ভূমি থেকে গম্বুজ শীর্ষের উচ্চতা ২৭ দশমিক ১৩ মিটার। গম্বুজের সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মন ছুঁয়ে যায়। আহসান মঞ্জিলের প্রতিটি কক্ষ ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। রঙমহলের ৩১টি কক্ষের ২৩টিতে প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয়েছে। ৯টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে প্রাপ্ত ও মি. ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা ও ক্রোকারীজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র ও নওয়াব এস্টেটের পুরনো অফিস এডওয়ার্ড হাউজ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শনীতে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এই আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি ও সমসাময়িককালের সাদৃশ্যপূর্ণ নিদর্শনাদি ক্রয় ও সংগ্রহ করে গ্যালারিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এ যাবৎ সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা মোট ৪০৭৭টি।
পুরান ঢাকার ইতিহাস সমৃদ্ধ হওয়ার পেছনে আহসান মঞ্জিলের ভূমিকা অতুলনীয়। বর্তমান সময়ে মুক্ত পরিবেশে আড্ডা দেওয়ার উৎকৃষ্ট স্থানে পরিণত হয়েছে। আহসান মঞ্জিল ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঢাকা শহরে আসলে, এই দর্শনীয় স্থানটি দেখে নেওয়া ভালো তাই আমি এর অন্যথা করিনি। আপনারাও চাইলে একদিন দেখে আসতে পারেন, ঢাকার এই যান্ত্রিক জীবনের বাইরে আহসান মঞ্জিল দর্শন খারাপ হবে না। বর্ননা অনুযায়ী সব ছবি দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত, দুটো ছবি দিয়ে কেমন বোঝাতে পারলাম পড়ে জানাবেন সবাই। নতুন প্রজন্মের জন্য আহসান মঞ্জিল হতে পারে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।
সবাই ভালো এবং সুস্থ্য থাকবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।
লেখাটি ভালো হয়েছে।
ছবিগুলো রিসেন্ট হলে আরও ভালো হতো।
এভাবেই লিখে যান প্রতিনিয়ত।
শুভ কামনা।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আমি কলেজ থেকে আহসান মঞ্জিল যাওয়ার জন্য টাকা জমা দেই কিন্তু করোনার জন্য আর যাওয়া হয়নি। আপনার পোস্ট পড়ে ধারনা পেয়ে গেলাম অনেক
অনেক সুন্দর হয়েছে আপনার লেখাটি।