বাংলার কৃতিসন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।steemCreated with Sketch.

in OPEN THE WORLD3 years ago (edited)

আসসালামু আলাইকুম


হ্যালো বন্ধুরা!

কেমন আছেন সবাই। আমি @mamunxxx 🇧🇩 বাংলাদেশ থেকে। আজ আমি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে লিখবো।


_IMG_1635828624767.jpg

_IMG_1635828639731.jpg

_IMG_1635828646085.jpg
" শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত;
যার রক্তে ভেজা
প্রতিটি বাংলা বর্ণমালা "
মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা, বাংলা ভাষায় মনভরে কথা বলতে পারছি; যে সকল কালজয়ী মহান ব্যক্তিদের কঠিন সংগ্রাম, অক্লান্ত ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে; তাদের অন্যতম ছিলেন বাংলার কৃতিসন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

পাকিস্তান গণপরিষদে যিনি প্রথম মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবি তুলে ধরেছিলেন, একাত্তরে হানাদারদের হাতে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত যিনি স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তিনি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ত্রিপুরা এবং বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন কসবা ও নবীনগর মুন্সেফ আদালতের সেরেস্তাদার। ছেলেবেলা থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয় ১৯০৫ সালের পর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার দাবি গণপরিষদে উত্থাপনে তিনি পূর্ব বাংলায় ‘বীরের মর্যাদা’ পান।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নবীনগর হাইস্কুল, কুমিল্লা কলেজ এবং কলকাতা রিপন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ১৯০৬ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লার মুরাদনগরের পূর্বধইর গ্রামের আইনজীবী কৃষ্ণকমল দাসমুন্সীর কন্যা সুরবালা দাসকে বিয়ে করেন। তাদের সাত মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে বড়ছেলে সঞ্জীব দত্ত লেখক ও সাংবাদিক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ২৭ এপ্রিল ১৯৯১সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ছোটছেলে দীলিপ দত্ত ১৯৭১-এর মার্চ মাসে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন।

ধীরেন দত্ত; দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন, বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনি আইন পাসের সাথে ধীরেন দত্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেন। ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন কারাগারে দণ্ড ভোগ করেন।

১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস দলের বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ঐ বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ হতে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের পর একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের এ অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই পূর্ব বাংলায় অফিস-আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষায় করার দাবীতে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনেরই প্রতিফলন ঘটে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবের মধ্যে।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতির দাবীর প্রেক্ষিতে লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, গজনফর আলী সহ অনেকে বিরোধিতা করেন এবং সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের তকমা লাগিয়ে এই দাবী নাকচ করে দেন।

বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার এই দাবী; পূর্ব বাংলার পক্ষে প্রথম একটি মৌলিক রাজনৈতিক দাবি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরম সাম্প্রদায়িক দর্শনের মধ্যে একজন অমুসলিম নাগরিক হিসেবে আইন সভার এই দাবী উত্থাপন তাঁর জন্যে বেশ ঝুঁকি ছিল। তবু তিনি এবং অন্য ক'জন গণপরিষদ সদস্য যে যুক্তিনিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তা আজ ইতিহাসের বিচারে এক অনন্য নজির হিসেবে স্বীকৃত।

বাঙ্গালী এবং মাতৃভাষার প্রতি তার সহজাত আবেগ নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ ১৯৪৮ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে; তিনি যেভাবে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করছেন; সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই তিনি বলেছিলেন,

“So sir, I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore Bengali should not be treated as provincial language. It should be treated as the language of the state.”

গণপরিষদের সেই অধিবেশনে তার বক্তব্য যতটা না আবেগের ছিলো; তার চেয়ে বেশি ছিলো যুক্তির ধার। পাকিস্তানের ছয় কোটি নব্বই লক্ষ জনগণের মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লক্ষই যে বাংলা ভাষাভাষী এবং পাকিস্তানের রাজকার্যে তাদের ভাষাকে বাদ দিলে সমস্যার সৃষ্টি হবে সেটিও তার বক্তব্যে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

পূর্ব বাংলা থেকে সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্য প্রেমহরি বর্মন এবং কংগ্রেসের রাজকুমার চক্রবর্তী বাদে প্রায় সকল বাঙ্গালী গণপরিষদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সেই বক্তব্য বিনা বাক্যব্যয়ে হজম করেও নিলেন। ফলাফল হিসেবে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাঙ্গালী স্পিকার তমিজউদ্দিন খানও রায় দিতে বাধ্য হলেন প্রস্তাবটি গৃহীত হচ্ছে না।

২৬ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অনেকটা ব্যথিত হৃদয় নিয়েই করাচি থেকে ঢাকায় ফিরলেন। ওই দিন সারা পূর্ব বাংলায় প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচীর অধিবেশন থেকে ঢাকায় ফিরে এলে, তেজগাঁ বিমান বন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাকে বিপুল সম্বর্ধনা জানান। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত মূলতঃ সেখান থেকেই।

শুধু ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সমগ্র পর্যায়টিতে পরিষদের অভ্যন্তরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার সপক্ষে এবং ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তৃতা করেন।

সেই বছরের ১১ মার্চ সমগ্র প্রদেশে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাওয়ার ফলে তিনিও ব্যথিত হয়েছিলেন, প্রতিবাদ আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন নিজেকে।

১১ মার্চের ছাত্র ধর্মঘটে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মত শিক্ষকেরাও সামনে থেকে রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। এই আন্দোলনে গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, রণেশ দাশগুপ্তসহ অসংখ্য ছাত্রনেতা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তখন বাঙ্গালীকে একদম ভেতর থেকে নাড়া দিয়েছে।

বাঙ্গালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম উপাদান বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে পুর্ব বাংলার ছাত্র জনতাকে রাজপথে নামতে হলো। অনেক রক্ত ঝরলো! চার বছরের ঘটনাক্রমেই ১৯৫২ সালের সেই একই ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রাণের ভাষার দাবী আদায় করে পাকিস্তানী শাসকদের ভিত নাড়িয়ে দিলো বাঙ্গালী।

শুরু থেকেই কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা ধীরেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ভারত ভাগ না হোক, অন্তত ধর্মের ভিত্তিতে তো নয়ই। বাংলাকে ভাগ করার সিদ্ধান্তেও চরমভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ। কংগ্রসের অসংখ্য নেতা-কর্মী, বন্ধুবান্ধব আর অনুসারীদের অনুরোধ উপেক্ষা করেও থেকে গেলেন পূর্ববঙ্গে, মাতৃভূমির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেননি।

১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে একটি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন।

পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং তখন থেকে তাকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা হয়। এতদসত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখতেন।

আজীবন এই মানুষটি নিজেকে মাটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবেই চিন্তা করে গেছেন। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন বাঙ্গালীর স্বায়ত্ত্বশাসনের সূর্য ওঠার কথা।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এ্যাডভোকেট আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পবিত্র রক্তে আজো ভিজে আছে বাংলাদেশের মাটি, আমাদের প্রতিটি বাংলা শব্দে পরম মমতায় জড়িয়ে আছেন বাংলা ভাষা আন্দোলনের এই ধ্রুবতারা। এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।


সকলকে ধন্যবাদ!

Coin Marketplace

STEEM 0.17
TRX 0.15
JST 0.028
BTC 60111.17
ETH 2322.86
USDT 1.00
SBD 2.53