মার্গারিটা ও তিন পাহাড়ের বিভীষিকা --- ( প্রথম পর্ব ) - [ ১০% shy-fox ভাই এর জন্য বরাদ্দ ]

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

image.png

image source

আমি তাকে স্পষ্ট দেখতে পাই। এখনও এখানে আমার এজা একা দিন কাটে। কি যে অসুখ হয়েছে আমার? বাবা মা আমায় কিছু খুলে বলেনি।

এই আমি, মার্গারিটা.. যখনই সময় পাই তখনই লিখি আমার এই ডায়েরি। গত বছর মার্চে,থার্টিন কমপ্লিট করেছি আমি। আজ একুশে জানুয়ারী। তুষার পড়তে শুরু করেছে। বসে বসে আমি ভাবছি আর কতদিন এমন করে একলা থাকতে হবে আমায়। এখানে আমার মতো আরো অনেকে রয়েছে। যাদের, তাদের মা বাবারা পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে। ঐ যে কোঁকড়া চুলের মেয়েটি, যার দু চোখে অনেক দুঃখ জমে আছে, ওর নাম গ্লোরিয়া। সেও আমার মত এক অসুখে ভুগছে। তাকেও তার মা বাবা পাঠিয়ে দিয়েছে তিন পাহাড়ের এই স্যানেট্যরিয়ামে।

অথবা ওই রেবেকা!! ছটফটে মেয়েটি, সব সময় কথার ফুলঝুরি জ্বেলে দেয়। সে আমার হাতে হাত রেখে বলে, " মার্গারিটা!! দুঃখ করো না। আমারও একটা ফুসফুস নষ্ট হয়ে গেছে। আমিও তোমার মত। আমাকেও আমার মা বাবা একদিন....। কথা শেষ করতে পারে না সে, হাতে মুখ গুঁজে অঝোরে কেঁদে ফেলে। এখানে আমি, গ্লোরিয়া, রেবেকা, সেলেনা আরও অনেকে, আমরা সবাই, আমাদের অদ্ভুত অসুখ বুকে নিয়ে বেঁচে আছি। আমরা জানিনা, আবার কোন দিন সুস্থ হতে পারবো কি না? আবার ফিরে যেতে পারবো কি না মা - বাবার কাছে।

এখনো আমায় হাতছানি দিয়ে ডাক দেয় আমার পুরোনো শহর। সেখানকার প্রতিটি রাস্তা ঘাট সব কিছু মনে পড়ে যায় আমার। যে স্কুল আমি পড়তাম, সেখানকার টিচাররা, খুব ভালোবাসতেন আমাকে, ভীষণ স্নেহ করতেন। তাঁদের কথাও মনে পড়ে বৈকি। যখন দিনের আলো ক্রমশ কমে আসে। যখন ঘন সন্ধ্যার অন্ধকার থমকে থেমে দাঁড়ায়, তিন পাহাড়ের বুকে। একরাশ অন্ধকার বুকে নিয়ে, পরিত্যক্ত দূর্গের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি তারাভরা আকাশের দিকে। আএ মনে মনে জেসাসের কাছে প্রার্থনা জানাই। জেসাস তুমি আমার সমস্ত অসুখ সারিয়ে দাও। শুধু আমার নয় এই যে আমার বান্ধবীরা, রেবেকা, সেলেনা,গ্লোরিয়া তাদের সবাইকেও তুমি সুস্থ করে দিও প্লিজ। আমরা আবার ফিরে যাবো আমাদের বাবা মায়ের কাছে। আবার আমরা হারিয়ে যাবো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে।

রাত্রি নেমে আসে। আরেকটু বেশি শীত এসে আঁকড়ে ধরে শরীর। আমি ভাবি লর্ড জেসাস ক্রাইস্ট বোধহয় আমার প্রার্থনা শুনবেন না। কত কাজ আছে তাঁর। আমার মত কত আর্ত মানুষের কষ্ট লাঘব করতে হয় তাঁকে। তিনি কি আর ছোট্ট মার্গারিটাকে মনে রেখেছেন? মনে পড়ে যায় তার, অনেক বছর আগে, ঐ ছোট্টবেলায়, যখন চার্চে ক্যারল গান বেজে উঠতো, চব্বিশে ডিসেম্বর, একটু বাদে শুরু হবে উৎসব - ফাদার বলতেন কখনো বিশ্বাস হারাবে না।বিশ্বাস হারানো মহাপাপ।

তাইতো এখনো আমি সন্ধ্যের অন্ধকারে ক্যান্ডেল জ্বেলে নিয়মিত প্রেয়ার করি। মোমের আলোয় যীশুর মূর্তি যেন অনেকটা মায়াবী লাগে। মনে হয় এক্ষুনি জীবন্ত হয়ে উঠবেন তিনি। আমার জন্যে বহন করে আনবেন তার অনন্ত করুণা। আমি মনে মনে তাকে স্মরণ করি। প্রার্থনা করি, যেন তাঁর ভালোবাসা লাভে কখোনো ব্যার্থ না হই।

তবে কাল রাতে,অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আমার বান্ধবীদের বললেও তারা আমার কথা বিশ্বাস করেননি। জানিনা কেন, এই কদিন ধরে এই একই দৃশ্য বার বার দেখেছি আমি। আমি ভাবতে থাকি, কবে যেন ? হ্যাঁ। গতবছরে শেষতম দিনে। অর্থাৎ একত্রিশে ডিসেম্বর। এখানে এই তিন পাহাড়ের কোলে এই স্যানেটোরিয়ামে আমরা যারা থাকি তাদের মন যেন ভালো থাকে, তাই মিস্ট্রেস মাঝে মধ্যেই না না ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন আমাদের জন্য। একত্রিশে ডিসেম্বর এমনই একটি গেট টুগেদারের আসল বসেছিল।

আলোয় আলোকিত করে সাজানো হয়েছিল স্যানেটোরিয়ামটিকে। সান্তাক্লজের ম্যুর্তিটা তখনো তাকিয়ে ছিল জ্বল জ্বল চোখে। আমরা রাইম শুনিয়ে ছিলাম। আমি আবৃত্তি করেছিলাম। মেরি গো রাউন্ডে চরেছিলাম সবাই মিলে!! তারপর, যখন গভীর রাত ঘনিয়ে এসেছিল, গভীর ক্লান্তি নেমে এসেছিল দুই চোখের তারায়। তখন মিস্ট্রেস আমাদের সবাইকে তার কাছে ডেকে বলেছিলেন, “লেট আস হোপ ফর আ ব্রাইট অ্যান্ড ভেরি ভেরি হ্যাপি নিউ ইয়ার, মাই ডিয়ার চিল্ড্রেন্স.. স্টে হ্যাপি অ্যান্ড ব্লেসড” তারপর নিউ ইয়ারের গান গেয়ে, আমরা শেষ করেছিলাম বছর শেষের সেই অনুষ্ঠান। মাঝরাতে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি আমার রুম মেট সিসিলিয়া , তখনও ঘুমে অচেতন। তার ঘুমটা ভাঙাতে আর ইচ্চগে হয় নি আর। পাশ ফিরে আবার শুতে যাবো সহসা, আমার মনে হল জানালার ওপারে যেন একটা মিশমিশে কালো ছায়া যেন থমকে রয়েছে।

অথচ, যেখানে আমাদের রুম অর্থাৎ পাহাড়ের ওপরে, বাড়ির দোতলায় , সেখানে তো কারুর বাইরে থেকে বিল্ডিং এ উঠে তাকানো সম্ভব নয় কারন তিন পাশে ঢালু পাহাড় আর গিরিখাত আছে। আর প্রবেশদ্বারে সর্বদা গার্ড আঙ্কলরা পাহাড়ায় থাকে। তাহলে? মনের মধ্যে ভয় চেপে বসেছিল। এমন অদ্ভুত দমবন্ধ করা আতঙ্ক ঘন পরিবেশ আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। তখন আমি মোটা কম্বলে আদ্যোপান্ত মুখ ঢেকে শুয়ে আছি। মনে মনে প্রভু যীশুর নাম স্মরণ করছি। ইচ্ছে করছিল, চিৎকার করে মা কে ডাকি। কিন্তু এখানে তো মা নেই। তবে ওই কালো ছায়াটা কিসের যেটা জানালার ওপারে জমাট বেঁধেছিল ? সাহসে ভর করে একবার উঠে দাঁড়ালাম। জানালার কাছে গিয়, পর্দা সরাতেই যা দেখলাম, আমার হাড় হিম হয়ে গেল আমার। দেখি সম্পুর্ণ জানালা জুড়ে এক গভীর নিকষ কালো জমাট বাঁধা অন্ধকারের পিন্ড ক্রমশ ঘনিভূত হয়ে চলেছে। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটি আবছা বিভৎস অমানবিক মুখাবয়ব যেন তার গনগনে জ্বলন্ত চোখে আপাদমস্তক নিরিক্ষণ করে চলেছিল আমায়...

আকৃতিটার মাথার ওপর কেমন যেন ছাগলের মত বাঁকানো শিং, মুখের গড়নও অনেকটা ছাগল প্রজাতির মত দেখে কিন্তু চোখ গুলো কি ভয়ানক লাল। যেন গনগনে নরকের আগুন জ্বলছে সেই চোখে। সম্পুর্ণ মুখাবয়ব থেকে ঝরে পরছে গভীর আক্রোশ। দু-একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছিল আমার গলা থেকে। ছুটে এসেছিলেন সুপার। সবসময় তাকে সতর্ক থাকত্ব হয়। তিনি জানেন, বিদেশ বিভুঁইতে যারা আছে এখানে, এইসব অসহায় ছোটখাটো বালিকার দল, তাদের কিছু হয়ে গেলে ঈশ্বর তাঁকে ক্ষমা করবেন না। তিনি এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন - কি হয়েছে!!!!!!!! তোমার কি হয়েছিল মার্গারিটা?

আমি ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছিলাম। আমার চোখে মুখে জল ছিটিয়ে আমার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। ভোরের দিকে একটু সুস্থ হওয়ার পর আমি বলে ছিলাম সুপারকে সব ঘটনাটা। বলেছিলাম- “ম্যাডাম আমি স্পষ্ট দেখেছি... ইট ওয়াজ দ্য ডেভিল.. সাক্ষাৎ শয়তান। ওর আগুনে চোখে গভীর ঘৃণা আর রাগ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষছিল ওই নরকের প্রাণীটা।”

ম্যাডাম হেসে উঠে ছিলেন। বলেছিলেন - “ তাই কি কখনো হয় মার্গারেটা? তুমি বোধহয় আজকাল, খুব বেশি হরর নোভেলস পড়ছ, তাই না? তাই হয়ত তোমার মাথায় এসব ভূত-প্রেত দৈত্য-দানো ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আঁৎকে উঠে বলেছিলাম - “ প্লিজ ম্যাম! আপনি আমার কথা গুলো অন্তত একটি বার বিশ্বাস করুন।”

লোক পাঠিয়েছিলেন তিনি। অন্য কিছু না পাওয়া গেলেও, লোক গুলো খোঁজ খবর করে এসে একটি অদ্ভুত কথা বলেছিল সুপার ম্যাডাম কে -
জানালার নীচে যে কটা ফুলের গাছ ছিল, সেগুলো নাকি সবকটা কেমন যেন হঠাৎ করেই শুকিয়ে সব পাতা ঝরে মারা পরেছে। সেখানে পাশেই কয়েকটি পাইন গাছও ছিল, তাতে ছোট ছোট কিছু পাখির বাসাও দেখা যেত.. সেই পাখি কয়টির নিথর প্রাণহীন দেহ, গাছের নীচেই এখানে ওখানে পরেছিল। এসব শুনে ভয়ে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল, সুপার ম্যাডামের।

( ক্রমশ )

Coin Marketplace

STEEM 0.18
TRX 0.16
JST 0.031
BTC 62108.38
ETH 2582.55
USDT 1.00
SBD 2.57