পর্ব -২ ★মৃত্যুর পরেও? ★(ছোটদের জন্য ভুতুরে গল্প) [ 10% reserved for shy-fox ]

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

image.png

image source
সোমব্রতের ডাক নাম সোমু। সবাই ওকে সোমু বলেই ডাকে। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা ছাড়া, অন্য কাউকেই সোমু কোনদিন ওকে সোমব্রত নামে ডাকতে শোনে নি। বাবা, মা, ঠাকমা,কাকা,কাকিমা,বন্ধু-বান্ধব সবাই ওকে ওই সোমু নামেই ডাকে। ওদের বাড়ি এক মফস্বলি গ্রামে। বাড়িটা দোতলা। নীচে চার খানা ঘর, দোতলাতেও সব মিলিয়ে চার খানাই ঘর।

ওপরের চার টে ঘরের একটায় সোমু একাই শোয় এবং সাথে ওই ঘরেই পড়াশোনা করে। বাকি তিনটের মধ্যে একটাতে সোমুর দিদি ও ঠাম্মা শোয়। দিদিরও পড়াশোনার ঘর সেটাই। আর অপর দুটির একটিতে কাকু-কাকিমা, আর অপরটি গেস্টরুম হিসেবে ব্যাবহৃত হয়। সোমুর বাবা-মায়ের শোবার ঘর নীচে তলায়।চার খানা ঘরের মধ্যে একটা ওদের শোবার ঘর। একটাতে বাড়ির ঠাকুর ঘর স্থাপিত। বাকী দুটো ঘরের একটি বৈঠক খানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়, আর একটা বাড়ির রান্নাঘর। অন্যান্য ঘর গুলির থেকে এই ঘরটিও বেশ বড়। ঘরটা এতটাই বড় করে বানানো যে ওটাই রান্না ঘর, খাওয়ার ঘর এবং ভাড়ার ঘর হিসেবে ব্যাবহার হয়। সেদিন রাত নটা নাগাদ সোমু স্কুল এবং টিউশনের হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে একটি ভূতের গল্পের বই নিয়ে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়তে লাগল।

রাত দশটার আগে তাদের বাড়িতে খেতে বসা হয়না। তখোনো রাতের রান্না শেষ হয় নি। দোতালায় ওই সোমু ছাড়া আর কেউ নেই, বাকি সবাই একেবারে রাতের খাবার শেষ করে দোতালায় আসবে। বাবা বৈঠকখানায় বই পড়ছে । দিদি সম্ভবত মা কাকিমা ঠাম্মার সাথে রান্না ঘরেই আছে অথবা বাবার কাছে বৈঠকখানায়। কাকা হয়ত পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মারতে বের হয়েছে। আর সোমু এখন গল্পের বই পড়ছে।

হঠাৎ একসময় ঘরের মধ্যে থেকেই কে যেন বলল, - কি রে সোমু? ভূতের গল্প পড়ছিস নাকি?

সোমু চমকে উঠে বিছানার উপরে বসল। এদিক ওদিক তাকালো। কাউকে দেখতে পেল না। তখন সে চেঁচিয়ে বলল, - "কে রে? কোথায় তুই?
উত্তর শুনতে পেল, - " আমি তোর ঘরের মধ্যেই আছি।"

" তাহলে আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? "
"আমি লুকিয়ে আছি কি না, তাই দেখতে পাচ্ছিস না, দেখা দিলেই দেখতে পাবি"
কে তুই??

উত্তর এল, " বলছি... তা তুই আগে বলত, তুই যে বড় ভূতের গল্প পড়ছিস, তোরে ভূতের কথা ভাবলে তোর ভয় করে না? " সোমু হেসে বলল, " দ্যুৎ! ভূতকে ভয় করতে যাবো কেন? ভূত বলে কিছু নাকি ওসব ফালতু কথা!! উত্তর এল, " ফালতু কথাই যখন, তখন ফালতু কথা পড়ছিস কেন? " সোমু বলল, "পড়তে মজা লাগে তাই পড়ছি।"

" কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি একটা ভূত এসে তোর সামনে দাঁড়ায়,তাহলেও কি তোর মজা লাগবে? ", সেই অদৃশ্য অস্তিত্বের থেকে গম্ভীর উত্তর এলো। সোমু বলল, " হ্যাঁ লাগবে...! কারন আমি জানি ভূত বলে কিচ্ছু হয় না। ওটা ফালতু জিনিস , মজার জিনিস। এখন বলত তুই কে? কোথায় আছিস? আমার সামনে আয় দেখি। তোর গলাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে! আয় আমার সামনে আয়! কোথায় লুকিয়ে আছিস..খাটের তলায় নাকি? উত্তর এল, " আমি তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। কেন দেখা দিচ্ছিনে জানিস্?? কারন আমাকে দেখলে তুই ভয় পাবি তাই।

সোমু বলল, " কেন খামোখা তোকে ভয় পেতে যাবো?" উত্তর এল, " কারন বাকি যাদের দেখা দিয়েছিলাম, তারা সবাই আমায় দেখে চমকে ভয় পেয়েছে। ভেবেছিলাম মা খুশি হবে, মা তো আমায় দেখে রীতিমতো চিৎকার মরে পালিয়ে গেল। যেই মা আমায় দেখলে বুকে টেনে নিত, সে এখন আমায় দেখলে ভীরমি খায়। অনেকের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু তারা উল্টে আমাকে অশুভ আত্মা বলে তান্ত্রিক পর্যন্ত ডেকে এনেছিল। আমি পালিয়ে আসি.." সোমু বলল , " ধ্যাৎ পাগল!! "
‘ধ্যাৎ’ বলল বটে, কিন্তু সত্যিই তার কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। তারপর গলায় জোর দিয়ে বলল - " বের হ বলছি খাটের তলা থেকে, আর আমাকে ভয় দেখাতে হবে না। উত্তর এল, " তুই বল ভাই সোমু, আমাকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যাবি না? সোমু বলল, " আরে বাবা..!! ভয় কেনো পাবো? "

আমি সত্যিই যে শরীর হীন প্রেতযোনীর আত্মা । আমি কে সেটা আগে বলি শোন, তোর অনিল কে মনে আছে?? অনিল কুন্ডুকে?? ওই তোরা যে দোকান থেকে মুদি খানার জিনিসপত্র নিস, সেই নরহরির কুন্ডুর ছেলে অনিল, তোর বন্ধু। সোমু ভয়ে বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, অনিল...!!! অনিল তো মারা গেছে প্রায় বছরখানেক আগে..

উত্তর এল, " আমি সেই অনিলই রে সোমু!! আমি প্রায়ই ভাবি তোর সাথে দেখা করব - তারপরই ভাবি আমাকে দেখলে যদি তুই ভয় পেয়ে পালিয়ে যাস, তাই আর দেখা করতে আসিনি ভাই। কিন্তু তোর সঙ্গে কথা বলার জন্যে আমার মনটা বড়ই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, তাই না এসে থাকতে পারলাম না।"

এতক্ষণ ধরে ভূতের কথা শুনে শুনে সোমুর ভয় অনেকটা কেটে এসেছে। তাই সে বলতে পারল - তা তুই যে অনিল, বুঝবো কি করে? তোকে দেখতে পেলেও না হয় বুঝতাম। উওর এল, - বেশ তো, তবে দেখ এবার। এই যে - সোমুর চোখের সামনে, খাটের একপাশে, ধীরে ধীরে একটা মানুষের আকৃতির কুয়াশা জাতীয় আবছা ধোঁয়াটে প্রতিকৃতি ফুটে উঠল। অস্পষ্ট হলেও অনিলের মুখাবয়ব পরিস্কার চিনতে পারল সোমু।

সে দেখল, হ্যাঁ এই তো তার বন্ধু অনিল! দেখে প্রথমটা তার বুকের ভেতরটা চমকে উঠলেও, নিজেকে সামলে নিল তাড়াতাড়িই। সামলে নিয়ে প্রশ্ন করল, -" মরে গিয়ে কেমন আছিস রে, ভাই অনিল? লোকে বলে, তোর মত জলে ডুবে বা এমন কোনো অপঘাতে মরলে নাকি মানুষ নরক যন্ত্রণা ভোগ করে? তোর কি খুব কষ্ট হয়?

অনিল বলল, " শূন্যতার কষ্ট হয় আমার। আমার ভীষণ শূন্যতার কষ্ট হয়!! আমার বুকে শূন্যতার জ্বালা। আমার কেউ কোথাও নেই, সারা বিশ্ব আমার কাছে খাঁ- খাঁ করছে। কেউ আমাকে দেখবার নেই ...কেউ আমাকে ভালো বাসবার নেই.. আমার খাদ্য নেই.. পাণীয় নেই... আমার দেহ নেই। কিন্ত আমাকে দেখে লোকে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, তাই কারুর সামনে আমি নিজেকে প্রকাশ করি না। তোরা আমায় দেখতে পাস না ঠিকই, কিন্তু আমি তোদের সবসময় দেখতে পাই।

সোমু বলল, " ভূত আমি কখনো বিশ্বাস করিনি - আজ করলাম। লোকে বলে, ভূতেরা নাকি ঘাড় মটকে দেয়, তোরা বুঝি তাই করিস? অনিলের আবচগা ছায়াটা কেমন যেন হাওয়ার উবে গেল, এই তো সামনে দাড়িয়ে ছিল। আবার সে অদৃশ্য হয়েছে। অদৃশ্য থেকে সোমুর কথার উত্তরে বলল, " ধ্যুৎ! শুধু শুধু লোকের ঘাড় মটকাতে যাবো কেন? আর আমরা ঘাড় মটকাইনা .. ওসব তো গল্পের বইয়ের কথা। কিন্তু আমাদের অন্যরকম কিছু শক্তি আসে, যদিও তার সাথে বয়ে আনে ঋণাত্মকতা তাই, যা দেহধারী জীবের পক্ষে ক্ষতিকর হয় মাঝে মাঝে। তাই মানুষ আমাদের থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে চায়.. কিন্তু আমাদের কষ্ট তারা বোঝে না। "

অনিল বলে চলল, " দেখ ভাই সোমু, আমি ভেবেছিলাম তুই হয়ত আমাকে দেখে ভয় পাবি, সেজন্য তোর কাছে আসছিলাম না, তুই যে ভয় না পেয়ে আমার সাথে গল্প করছিস, সেজন্য আমার খুব শান্তি অনুভূত হচ্ছে রে। তুই আমার অনেকদিনের বন্ধু, তোকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
সোমু বলল, " তোর বাড়ি? সেটা আবার কোথায় রে? "
অনিল বলল, আমার থাকার এখন তো আর কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই, আমি যে থেকেও নেই। চল তাহলে বাইরে থেকে একটু বেরিয়ে আসি, আর চল তোকে আরেকজনের সাথে দেখা করাবো, সে ও তোর খুব চেনা ছিল, সেও আমাদের বন্ধুই। "কে সে? " - সোমু জিজ্ঞাসা করল,
" ও পাড়ার পুরোহিত ঠাকুরের ছেলে নান্টু !" সোমুর মনে পড়ল, " আরে হ্যাঁ হ্যাঁ সেই.. নান্টু.. গাড়ির ধাক্কায় মরেছিল"

অনিল বলল, " যখন বেঁচে ছিলাম, তখন তোদের বাড়িতে কাকিমার হাতে কত খাবার খেয়েছি। যখনই তোদের বাড়ি আসতাম, তোর মা আমায় খেতে দিতেন। কখনো দিতেন সন্দেশ, কখনো পায়েস, কখনো লুচি- আলুরদম কখনো নারকেল নাড়ু, কখনো আপেল আঙুর। আজ তোর যা ইচ্ছা হবে তাই খাওয়াবো। তুই চ দেখি আমার সাথে... এক কাজ কর.. তুই চোখ বন্ধ কর। আমি তোকে নিয়ে পেছনে ওই শ্যাওড়া গাছের তলায় যাই চল। ওখানে নান্টুর সাথেও দেখা হয়ে যাবে। যা খেতে চাইবি, তাই খাওয়াবো।" সোমু বলল, " আচ্ছা রাবড়ি খাওয়াতে পারিস? "

অনিল বলল, " কেন পারব না, চল তোকে লুচি মাংসও খাওয়াবো।" লোভ সামলাতে না পেরে সোমু, চোখ বন্ধ করল, চোখ খুলতেই দেখল , সে শ্যাওড়া গাছের সামনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। সোমু অনিলকে ডাকল, কিন্তু অনিল সাড়া দিল না। কোথাও দেখতেও পেলনা অনিল কে।
কেমন যেন হঠাৎ করেই চারপাশ টা খুব নিস্তব্ধ লাগছে সোমুর। একটা হিমশীতল বাতাসের ঝাপ্টা এসে লাগে গায়ে... ভরা বৈশাখের সন্ধ্যা রাতেও, শীতে গায়ে কাঁটা দিল সোমুর।

এবার তার সত্যিই ভীষণ ভয় করতে লাগল। সে চিৎকার করে অনিলকে ডাকল... সাড়া তো পেলই না উপরন্তু তার চারপাশ তোলপার করে ভীষণ কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব শুরু হল... আর চারিদিক থেকে কে বা কারা জানি বীভৎস ভাবে হেসে উঠল...সেই প্রবল ভয়ানক অট্টহাসির আওয়াজে যেন কান ফেটে যাবার জোগাড় হল সোমুর.. প্রচন্ড ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। হঠাৎ সব আওয়াজ ছাপিয়ে কোথা থেকে যেন মা এর ডাক শুনতে পেলো সোমু। মায়ের আওয়াজে যেন ধড়ে একটু প্রাণ পেল। বেচারা সোমু চোখ বন্ধ করেই... মায়ের আওয়াজ শুনে সেদিকে এগোতে লাগল... এদিকে মা ডেকেই চলেছে, " সোমু...! এই সোমু "

একটু একটু করে সোমু যেন, তার মায়ের গলার আওয়াজ আরও জোরে আরও স্পষট ভাবে শুনতে পাচ্ছে... এবার তার খুব জোরে ডেকে উঠল.." এই সোমুউউউউ.."

মায়ের ডাকে ধড়ফড় করে, ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল সোমু।গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, মা এসে ডেকে ডেকে তুলেছে তাকে। ওহ! কি ভয়ানক স্বপ্ন টাই না দেখছিল সে... বাঁচা গেল। সোমু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কপালের ঘাম মুছল।

Sort:  
 2 years ago 

বেশ সুন্দর একটি ভূতুড়ে গল্প আপনি আমাদের মাঝে শেয়ার করেছেন। আশা করি আপনার এই গল্পটি বাড়ির দুষ্টু বালকদের শুনিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আমার কাছেও খুব ভাল লেগেছে আপনার এই গল্প।

Coin Marketplace

STEEM 0.29
TRX 0.12
JST 0.032
BTC 63645.37
ETH 3067.90
USDT 1.00
SBD 3.81