( ইতিহাস ও সমালোচনা - ২ ) বই- পুস্তক-কিতাব-মহাফেজখানা [ ১০% লাজুক খ্যাক্স ভাই এর জন্য বরাদ্দ ]

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

image.png

image source

ফরাসি বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নাট্যকার ওলিম্পে দ্যা গগ্স (Olympe De Gouges)। ফরাসি রাজকীয় মহলে জনশ্রুতি ছিল যে ওলিম্পে, সম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের অবৈধ সন্তান। জন্মকালে ওঁর নাম ছিল মারি গগ্স। ওলিম্পে ছদ্মনামটি উনি গ্রহণ করেছিলেন পরবর্তীকালে। ১৭৮০ সাল থেকে আমৃত্যু ওলিম্পে বহু নাটক, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেন। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আহ্বান বিশ্বব্যাপী নারী কর্মীদের কাছে অভূতপূর্ব সাড়া জাগানো সত্ত্বেও নারীর প্রত্যাশিত মুক্তি আসেনি। ১৭৯১ সালে ওলিম্পে ‘নারী অধিকার এবং মহিলা নাগরিকদের ঘোষণা' প্রকাশ করেন। এই ঘোষণা আদতে ছিল ফরাসি বিপ্লবোত্তর 'Declaration of the Rights of Man' - এর নারীবাদী সংস্করণ। ওলিম্পে এই ঘোষণাপত্রে বলেন: 'নারী জেগে উঠো; গোটা বিশ্বে যুক্তির সঙ্কেত ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। আবিষ্কার করো নিজের অধিকারকে। প্রকৃতির শক্তিশালী সাম্রাজ্য এবং পক্ষপাত, গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও মিথ্যা দিয়ে অবরুদ্ধ নয়।' ষোড়শ লুইয়ের গিলোটিনে মুণ্ডচ্ছেদের পর অলিম্পে একটি বিস্তারিত লেখা লিখেছিলেন জ্যাকোবিনদের বিরুদ্ধে। আক্রমণের লক্ষ্য বিশেষ করে ছিলেন মারাত ও রোবসপিয়ার। ফলে গ্রেপ্তার হতে হয় ওলিম্পেকে। আজ অবধিও ১৭৯১ সালে রচিত “Declaration of the Rights of Woman and the Female Citizen” নারীবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। ওলিম্পে একটি জায়গায় লিখছেন : “Man, are you capable of being fair? A woman is asking: at least you will allow her that right. Tell me, what gave you the sovereign right to oppress my sex? Your strength? Your talents? Observe the creator in his wisdom, examine nature in all its grandeur, for you seem to wish to get closer to it, and give me, if you dare, a pattern for this tyrannical power.” ১৭৯৩ সালে ওলিম্পেকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করার সাথে সাথে নারীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। মৃত্যু পূর্বে অসীম সাহসিকতা নিয়ে ওলিম্পে বলেছিলেন : নারীর যদি ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে, তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে ইউরোপজুড়ে নাজি, ফ্যাসিস্ট, ফ্যালানজিস্ট ও কম্যুনিস্টরা যে গণহত্যা চালায় তার বিস্তৃত বিবরণ দিতে গেলে পাঠকের অকারণ ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। কেবল দুটি ঘটনার উল্লেখ করবো সে কারণেই।
ইহুদি গণহত্যার মাধ্যমে থার্ড রাইখ কার্যত পরিণত হয়েছিল একটি ‘জনোসাইড স্টেটে’। প্যারিশ চার্চগুলো ও ইন্টেরিয়র মিনিস্ট্রি নাজিদের সরবরাহ করতো জন্ম রেকর্ড, যা থেকে জানা যেত কে ইহুদি ও কে ইহুদি নয়। পোস্ট অফিস সরবরাহ করতো ডিপোর্টেশন ও ডিনেচারেলাইজেশন অর্ডার, ফিন্যান্স মিনিস্ট্রি বাজেয়াপ্ত করতো ইহুদিদের সম্পত্তি, জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলি ইহুদিদের চাকরিচ্যুত করতো এবং পূর্ণরূপে দেউলিয়া করতো ইহুদি স্টকহোল্ডারদের। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইহুদিদের ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানাতো। যেসব ইহুদি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এরই মধ্যে অধ্যয়নরত ছিল, তাদের ডিগ্রি দিতেও অস্বীকার করা হতো। অন্ধকারের রাজত্ব তখন জার্মানি জুড়ে। এই বিচিত্র সময়ে অস্ট্রীয় লেখক-সাংবাদিক হুগো বেটাওয়ার (Hugo Bettauer) লিখলেন তাঁর ব্যাঙ্গাত্মক উপন্যাস Die Stadt ohne Juden অর্থাৎ "The City Without Jews"। ১৯২২ সালে রচিত এই উপন্যাসে হুগো নির্মিত কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন হুবহু হিটলারের আদলে গড়া এক উন্মাদ প্রশাসক , যিনি ভিয়েনা থেকে সব ইহুদিকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রকল্প করছেন। প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই বইটির আড়াই লক্ষ কপি বিক্রীত হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই নাজিদের রোষানলে পড়েন বেটাওয়ার। ১৯২৪ সালে প্রখ্যাত অস্ট্রীয় চলচ্চিত্র পরিচালক-অভিনেতা হান্স ব্রেসলাওয়ার এই বইটিকে চলচ্চিত্র রূপ দেন। ১৯২৪ সালের ২৫শে জুলাই মুক্তি পায় ছবিটি। তার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১০ই মার্চ ১৯২৫ সালে অটো রোথষ্টক নামের এক উন্মাদ নাত্সি সমর্থক গুলি করে হত্যা করে বেটাওয়ারকে।
পরবর্তী গল্পের নায়ক ইসাক ব্যাবেল। জন্মস্থান রাশা। স্ট্যালিনের রাশা। রুশ ভাষায় ‘স্ট্যাল’ অর্থ ইস্পাত ‘স্ট্যালনোই’ অর্থ ইস্পাত কঠিন! ‘লৌহমানব’ খ্যাত নিষ্ঠুর শাসক জোসেফ স্ট্যালিন। ইসাক ব্যাবেল বলশেভিকদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। রাশায় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন রাজনৈতিক কমিসারের দায়িত্বে ছিলেন ব্যাবেল। ওঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার একটি ছোটগল্পের সংকলন 'Red Cavalry' ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে ইহুদি জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে লেখা বই 'Odessa Tales' প্রকাশ পায়। গোলযোগ সৃষ্টি হয় ১৯৩৫ সালে রচিত 'Mariya' নামক ওঁর একটি নাটক নিয়ে। এই নাটকে স্তালিনী জমানার রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিকে ঝটিকা আক্রমণ করেন ব্যাবেল। ফলস্বরূপ নাটকটি মহড়া চলাকালীন সময়েই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ও ব্যাবেল গ্রেপ্তার হন। নাটকটি সম্পর্কে বলা হয় : The play not only went counter to Stalin’s artistic preferences, but was loaded with depictions of official corruption. ব্যাবেলকে গ্রেপ্তার করার পরেই একটি গোপন স্থানে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওঁর পরিবারকে মৃত্যুর খবর দেওয়া হয় ১৯৪১ সালে। সরকারি নথিতে আজ অবধিও ১৭ই মার্চ ১৯৪১ , ব্যাবেলের মৃত্যদিবস হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। ওঁকে হত্যা যদিও করা হয়েছিল গ্রেপ্তার করার সাথে সাথেই।
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত দ্য স্যাটানিক ভার্সেস (The Satanic Verses) সালমান রুশদির চতুর্থ উপন্যাস। খুব অল্পসংখ্যক পাঠকই আছেন হয়তো, যাঁরা এই উপন্যাসের নামের সাথে পরিচিত নন। এই উপন্যাসের কিয়দংশ মুহাম্মাদ এর জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত। বইয়ের নামটি তথাকথিত স্যাটানিক ভার্স বা শয়তানের বাণী-কে নির্দেশ করে। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার মাত্রই বিশ্ব তোলপাড় হয়ে যায়। পাঠকদের একাংশ অভিযোগ করেন যে বইটিতে ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও বিষয়বস্তু নিয়ে তীব্র কটাক্ষ ও অবমাননাকর বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। বিতর্ক আর বিক্ষোভের ঝড় দেশে দেশে আলোড়িত হয়। প্রসঙ্গত, বইটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই বইটির প্রকাশক হুমকিপত্র পান। সেই হুমকির চিঠিতে লেখা ছিল, ‘প্রকাশকের জন্য সাবধান বাণী, বইটি চরম বিতর্কের সূত্রপাত ঘটাবে।’ কিন্তু বইটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভাইকিং পেঙ্গুইন বইটি ছাপা থেকে বিরত থাকেননি। ১৯৮৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বইটি প্রকাশ করা হয়। ১৯৮৯ সালে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেইনী সালমান রুশদিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ফতোয়া জারি করেন। দেখা যায় বিশ্বের কিছু দেশে বইটি পোড়ানোর উৎসব, আবার কিছু দেশে ইচ্ছুক ক্রেতাদের সারি।
দ্য স্যাটানিক ভার্সেস বইয়ের সাথে যুক্ত সর্বমোট তিনজন মানুষের ওপর নেমে আসে সাংঘাতিক প্রত্যাঘাত। ১৯৯১ সালে আক্রান্ত হন বিশ্বের দু প্রান্তের দুজন মানুষ। জাপানের টোকিওয় আক্রান্ত হন ৪৪ বর্ষীয় অনুবাদক-অধ্যাপক হিতোশি ইগারাশি। জুলাই মাসের ১২ তারিখ যখন সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের অফিস থেকে ইগারাশির মৃতদেহ উদ্ধার হয়, পুলিশ সেই দেহের মুখে ও হাতে পায় অজস্র , অসংখ্য ছুরিকাঘাত চিহ্ন। সেই একই মাসে ইতালির অনুবাদক ইতোরে ক্যাপ্রিওলোকে ওঁর মিলানের আবাসনে ছুরিকাঘাত করা হয়। ক্যাপ্রিওলো আঘাতের চিহ্ন নিয়ে আজও জীবিত রয়েছেন। এর দু বছর পরে ১৯৯৩ সালে, নরওয়ের প্রকাশক উইলিয়াম নাইগার্ডকে, ওসলোয় ওঁর বাড়ির দোরগোড়ায় অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীরা তিনবার গুলি করে। তিনিও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।

( চলবে )

Coin Marketplace

STEEM 0.30
TRX 0.12
JST 0.033
BTC 64093.86
ETH 3123.80
USDT 1.00
SBD 3.94