( ধারাবাহিক উপন্যাস ) ★কে সেই লোকটা? ★ প্রথম খন্ড [ ১০ শতাংশ shy-fox ভাই এর জন্য ]
তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে - সাতটা বাজে।
আমি তিস্তা উদ্যানের অপেক্ষাকৃত নিরবিলি এবং হালকা অন্ধকারাচ্ছন্ন এক কোনায়, চুপচাপ বসে আছি। তাকিয়ে আছি একটু দুরের আলো ঝলমলে বাড়ি আর দোকান গুলোর দিকে। চারিদিকে কত লাল নীল সবুজ গোলাপি নিয়ন আলোর ঝলমলে কারুকার্য তাদের কৃত্তিম সৌন্দর্য বিকিরণের আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে ক্রমাগত।
পার্কের মধ্যেও প্রায় সমস্ত টা জুড়েই মনোরোম আলোর রোশনাই খেলা করে বেড়াচ্ছে। কত স্ত্রী পুরুষ বালক-বৃদ্ধ এসেছেন, তিস্তা নদীপার্শ্বের এই মনোরম পরিবেশের আস্বাদ গ্রহণ করতে। নব্য যৌবনাগমনের আনন্দে উৎফুল্ল, যুবক যুবতীরা সহর্ষে ভীড় জমিয়েছে এই উদ্যানে। জীবনের মধ্য গগনে উদ্ভাসিত দম্পতিরাও যেন, পুরোনো প্রেমের সুখস্মৃতি ঝালিয়ে নিতে উপস্থিত হয়েছে এখানে। ভরা সন্ধ্যায় জীবনের পরন্ত বেলার, যৌবনের আড্ডা মুখোর সন্ধ্যা গুলির স্মৃতি গুলোকে আরেকটু উজ্জ্বল করে নিতে, আড্ডা জমাতে দল বেঁধে হাওয়া খেতে এসেছেন বহু প্রৌঢ় বৃদ্ধরা। কতজন ঘুরে বেড়াচ্ছে, কত জন বসে বসে প্রিয় মানুষটির সাথে, গল্পে মশগুল হয়েছে। উজ্জ্বল আলোয় তাদের বেশ দেখাচ্ছে।
কিন্তু আমি যেখানে বসে আছি সেখানটায় লোকের ভীড় প্রায় নেই বল্লেই চলে। এ জায়গাটায় আলোও তেমন আসে নি। বেশ একটা মিস্টি আলো আঁধারি খেলা করছে এই জায়গায়। আমি চুপচাপ বসে, জয়েন্টে সুখটান দিতে দিতে ভাবছিলাম একটা প্লট। একটা ভৌতিক উপন্যাসের প্লট। আমি লিখতে ভালোবাসি। হ্যাঁ পেশাদার লেখক নই বটে, কিন্তু প্রায় রোজই লিখতে হয়।। অনেকক্ষণ এসেছি। এসেছি সেই বিকেল পাঁচটায়। আর নয় এবার উঠতে হবে।
উঠব উঠব করছি, এমন সময় এক রোগাটে গোছের লম্বা মত লোক এসে, আমার পাশেই বেঞ্চের একধারে বসে পরল। তারপর বলল - " ওহঃ! কি গরম পড়েছে মশাই! " আমি আর চুপ করে থাকি কি করে। কথা না বলল্ব রীতিমতো অভদ্রতা হয়।
বললাম," হ্যাঁ বড্ড গরম পড়েছে। "
এটুকু বলেই চুপ করলাম।
লোকটা বলল - " কদ্দুরে থাকেন মশাই? "
"এই তো, নতুন পাড়ায় "
"কি করা হয়? চাকরি - বাকরি?"
আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল তো !!! কোথা থেকে কে এসে জুটল, এখন তাকে হাড়ির খবর জানাও! বললাম - " না, চাকরি বাকরি কিছুই করিনে। চাকরি পেলে তো করব.. চেষ্টা করছি কিন্তু বরাতে জোটে নি এখনো। লোকটা বলল - " কাজকর্ম না করে, দিন গুলো কাটান কি করে মশায়? "
একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, " কেন? পড়াশোনা করে কাটাই। আর লেখালেখির অভ্যেস আছে। এসবকি একেবারেই যথেষ্ট কাজ নয় দিন কাটানোর জন্য? "
" বাহ্ !! বাহ্ !! অসাধারণ!! ব্রাভো!! খুব ভালো হ! সাহিত্য চর্চা অত্যন্ত ঐতিহ্যপূর্ণ কাজ। আরে বাঙ্গালীর ছেলে... গল্প-উপন্যাস লিখবে না হতে পারে। বঙ্কিম,শরৎের দেশের লোক আমরা! তা কি ধরনের গল্প উপন্যাস লেখেন আপনি? "
" প্রধানত ভৌতিক এবং রহস্য রোমাঞ্চ জঁরের লেখালেখি করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি।"
" তাই বুঝি? তাহলে আপনি ভূত- প্রেতও বিশ্বাস করেন নিশ্চয়ই ? "
বললাম, - ভূত-প্রেত থাকলে তো বিশ্বাস করবো! যে জিনিসের কোন অস্তিত্বই নেই তাকে বিশ্বাস করতে যাবো কোন দুঃখে !!! লোকটা অবাক হয়ে বলল, - সে কি মশাই! ভূতে বিশ্বাস নেই, অথচ ভূতের গল্প লেখেন? তাতে কি হয়েছে!! আমরা তো কোনদিন দেব দেবীদেরও দেখিনি, তারা আদৌ সত্যি আছেন কিনা, তাও তো জানি না। তবুও তো তাদের নিয়ে কতজনই কত কথা লেখেন। দেখুন মশায়...!! ভূত জিনিসটার প্রতি আমার বিন্দু মাত্র বিশ্বাস নেই, সবটাই মানুষের মানসিক ও শারীরিক দুর্বলতার অছিলায় তৈরী হওয়া জনশ্রুতি মাত্র।
তবে কি না, মানুষ ভয় পেতে ভালো বাসে। অন্ধকারের প্রতি মানুষের ভয় যত টুকু, তার চেয়ে ঢের বেশি কৌতুহল কাজ করে। তাছাড়া ভূতেদের নিয়ে এমন মনগড়া গল্প লিখে আমি আনন্দ, পয়সা দুইই পাই, তাই লিখি।
লোকটা বলল, আমি কিন্তু মশাই ভূত প্রেতেদের বড় বিশ্বাস করি। সে আপনি বিশ্বাস না করলেও, তেঁনারা ঠিকই আছেন। আর তেঁনারা যখন আছেন, তখন আপনাকেও নিশ্চয়ই একদিন বিশ্বাস করতে হবে।
আমি একটু হেসে বললাম, তা দাদা আপনি দেখেছেন নাকি তেঁনাদের?
ভদ্র চোখ গুলো গোল্লা পাকিয়ে বলল - আরে আলবাৎ দেখেছি ! বলেই খুব গোপনীয় কিছু কথ বলার ভঙ্গিতে খানিক ফিসফিসিয়ে, কিন্তু চোখ মুখের ভীষণ অঙ্গি ভঙ্গি করে বলল, বলেন কি মশাই? শুধু কি আর দেখেছি? কথাও কয়েছি, একসাথে থেকেছিও। আমি বাজি রেখে বলতে পারি আপনিও ঠিকই দেখতে পাবেন।
" আচ্ছা ঠিক আছে। দেখার অপেক্ষায় রইলাম। এবার আমি উঠি।
লোকটা বলল, " আচ্ছা, আসুন। নমস্কার।" পরিবর্তে আমিও নমস্কার জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
আমার বাবা রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার। উনি এখন রয়েছেন নিউ আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশনে। ওখানেই কোয়ার্টারে মা আর বোনও রয়েছে।
এর পর বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। আমি সেদিন বিকেলে জলপাই গুড়ি থেকে, আলিপুরদুয়ার গামী মেলের ফার্স্টক্লাসে চেপে মহানন্দে চলেছি মা বাবার কাছে। আমি যে কামড়ায় বসেছি, সে কামরায় আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন যাত্রী ছিল না। তীর বেগে ছুটে চলেছে ট্রেন , মাদারিহাট, হাসিমাড়া, হ্যামিলটন গঞ্জ -- এসব স্টেশন পিছনে ফেলে ট্রেন ছুটে চলেছে। আমি বেশ আরাম করে শুয়ে শুয়ে , এইচ.পি. লাভক্রাফ্টের দ্য কোল্ড উইন্ড গল্পটা পড়তে পড়তে চলেছি। এর মধ্যে যে কখন চোখে তন্দ্রার ঘোর এসে পরেছিল, বুঝতে পারিনি।
হঠাৎ কারো একটা গলার আওয়াজে তন্দ্রা কেটে গেলো। চশমাটা খুলে চোখ পরিস্কার করে, চশমাটা পরে সামনে তাকাতেই যারপরনাই অবাক হল। দেখলাম, আমার সামনের সিটে হাত পা ছড়িয়ে বসে রয়েছেন জলপাইগুড়িতে তিস্তা পার্কে দেখা সেই লোক টা। লোকটা এক গাল হেসে বলল,
"নমস্কার! নমস্কার! ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝি?" বলতে বলতেই সে সামনের সিট্ থেকে উঠে আমার পাশে এসে বসে পড়ল।
লোকটা বসে আবার বলল, " আমাকে চিন্তে পারছেন? "
বললাম, - হ্যাঁ পারছি বৈকি। সেদিন তিস্তা পার্কে..
"হ্যাঁ !!! আমি সেই লোক, এক্কেবারে ঠিক চিনেছেন।
বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললাম, "কিন্তু আপনি .. এখানে.. এই কামরায়... কি করে উঠলেন।"
লোকটা বলল, " এত অবাক হওয়ার কিছু নেই মশাই! সিগনাল না পাওয়ায়, ট্রেন টা হ্যামিল্টন গঞ্জে অল্প কিছুক্ষণ থেমেছিল, সেই ফাঁকে উঠে পরেছি। জিজ্ঞাসা করলাম - " তা যাবেন কোথায়? "
লোকটা উত্তর দিল, " এই আপনার সাথেই.. আলিপুরদুয়ার জংশন। " বলেই কেমন ফ্যাস্ ফ্যাসে গলায় হ্যা-হ্যা করে হেসে উঠল।
হাসতে হাসতেই লোকটা বলল, ভয় নেই৷ ভয় নেই। সত্যি সত্যি আপনার সাথে গিয়ে আপনার বাড়িতে উঠবনা ।
( ক্রমশ )
বেশ ভালো লিখেছেন গল্পটা ।শুরুটা বেশ জমে উঠেছে ।এ ধরনের ভূতের গল্প পড়তে আমার কাছে বেশ ভাল লাগে। যদিও এখন পর্যন্ত ভুতের কোন দেখা পায়নি। তবে আশা করছি পরের খণ্ডগুলো তে তাড়াতাড়ি ভুতের দেখা পাব ।তাড়াতাড়ি লিখে ফেলুন দাদা । অনেক কৌতুহল কাজ করছে ।ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য।
আপনার লেখা বেশ পরিপক্ক।দারুন লেখেন দাদা আপনি।চমৎকার হয়েছে পুরো গল্পটি।চালিয়ে যান দাদা এভাবেই,একটু ধারাবাহিক হওয়ার চেষ্টা করুন।অনেক শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য।
খুব সুন্দর ভাবে এই গল্পটি লিখেছেন আপনি। আপনার গল্পটা আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে পড়ে। আমি ভূতের গল্প পড়তে এবং শুনতে আবার দেখতেও ভীষণ ভালোবাসি। খুবই ভালো লাগে সকলে একসাথে রাত্রে বসে দেখতে। আমি বেশিরভাগ ভূতের গল্প এবং আহট দেখে থাকি। শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করি পরের খন্ড খুব তাড়াতাড়ি পাব। শুভকামনা রইল আপনার জন্য।