( পর্ব -২ ) অত্যন্ত বাজে এবং কিছুতেই ভয় না পাওয়া ভুতের গল্প [ ১০% shy-fox ভাই এর জন্য বরাদ্দ ]

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

image.png

image source

ভূতেরা মুক্তি পেল বটে, কিন্তু গোপাল চাটুয্যের ওপর ভেতরে ভেতরে চটে রইল। ভাবল, বাগে পেলাই ঠাকুরের ঘাঁড় মটকাবে। এ ঘটনার পর কেটে যায় মাস দুয়েক।

একদিন সন্ধ্যা বেলায় গোপাল চাটুয্যে ফিরছিলেন কাজল গাঁয়ের হাট থেকে। হাতে ঝোলা ভর্তি হাটের সওদা - পাঠার মাংস, তরিতরকারি আর ফলফলাদি। ফিরতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, তাই পথে আজ লোকজন নেই। মাঠের কাছ দিয়ে যেতেই একটা দমকা শীতল হাওয়া, আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে বয়ে গেলো। গোপাল ঠাকুরের কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল। হঠাৎ আরেকটা হ দমকা হাওয়ার ঝাপটা আসতেই, সেই হাওয়াতেই ভর করে যেন, তিন চার টি বিদঘুটে ছায়া শরীর লাফিয়ে গোপাল ঠাকুরের সামনে এসে পড়ল।

গোপাল ঠাকুর অবাক হয়ে বললেন,
“ কিরে, ব্যাপার কি? ” প্রথম ভূত হাতজোড় করে বলল - “আঁজ্ঞে ঠাঁকুরমশাই.. আঁমরা মাঁনে হেঁ হেঁ একটা নিবেদন নয়ে এসেছি আপনার কাছে। ”

গোপাল ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, “ অ.. তা তোমাদের কি নিবেদন বাবারা? ” ভূত বলল, “ আজ্ঞে আমাদের বাবা শ্রীঁ বঁরদাচরণ বেঁম্মোদত্যি.. প্রেত লোক ছেড়ে নরক লোকে গত হয়েছেন।

কবে? আজ্ঞে এই মঙ্গল বার বাবা ঠাকুর।

তা কি হয়েছিল? আজ্ঞে উনি দর্পে মগ্ন হয়ে কৈলাশ ভূতনাথের পুত্র ওই গনপতি মহারাজের এক ভক্তের ওপর ভর করতে গিয়েছিলেন, ব্যস মহারাজের কোপে পরে, আমাদের বাবার তো জ্বলে পুরে যাওয়ার অবস্থা তারপর অনেক ক্ষমা প্রার্থনা হ্যানা ত্যানার পর গনপতির দয়া হল, উনি বাবামশাইকে নরকে ফেলে দিলেন। গোপাল ঠাকুর মৌখিক শোক প্রকাশ করে বললেন,
“ আহা রে!! তোর বাবা মরে গেল!! বড় ভালো লোক ছিল রে।”

ভূত গদগদ স্বরে বলল - “ হ্যাঁ কত্তা বাবা... বাবা তো আপনাকে খুব ভালোবাসতো, ইহলোক ছাড়ার আগে তো ‘গোফলা তরেও নিয়া যামু.. গোফলা তরেও নিয়া যামু.. ’ করতে করতেই গেলেন...”

এমন ভয়ঙ্কর ভালোবাসার কথা শুনে, গোপাল ঠাকুর বেজায় বিষম্ খেলেন। ঠাকুর কে বিষম্ খেতে দেখে, ভূত গুলো ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“ কি হল কি হল বাবাঠাকুর!! শরীর খারাপ করেছে নাকি? এই বয়সে.. অ্যাতো হাটবাজার খাটাখাটুনি কি আর দেহে সয়? বলি পাশের শ্মশানে একটা মরা পোড়াচ্ছে, মরার খাট খানা এখনো পোড়ায়নি দেখে এলুম!!! সেটা এনে দিই বাবা ঠাকুর? সেখানে কিছুক্ষণ গা এলিয়ে বিশ্রাম নিলে হাল্কা বোধ করবেন।”

এমন বিচিত্র এবং তৎসহ ভয়প্রদ যত্ন-আত্যির প্রস্তাব পেয়ে গোপাল চাটুয্যে এক লাফে, শিঁড়দাড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে বল্লেন , " কই.. কই নাতো.. !! শরীর খারাপ নেই তো। দিব্যি সুস্থ সবল আছি। সেসব ছাড়, এখন আমাকে কি করতে বলছিস সেটা বল দিকিনি বাপু!! ”

ভূতেদের মধ্যে একজন বলল, “ আজ্ঞে কত্তা.. আমরা ঠিক করেছি আমাদের বাপের শ্রাদ্ধ খানা বেশ শুদ্ধ মত করতে চাই। আমাদের এই এলাকার মধ্যে আমাদের বাপই বামুন ছিলেন.. তিনিই তো থাকলেন না। তাই ঠাকুর বাবার শ্রাদ্ধখানা আপন পৌরহিত্য করে দিন।”

একথা শুনে গোপাল ঠাকুরের বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। একে শনিবার, তায় আবার ঘোর অমাবস্যা তিথি, এসময় এই হতচ্ছাড়া গুলো বড় এলেম পেয়ে যায়.. বাড়িতে থাকলে, এদের শুদ্ধবস্ত্রে বিভিন্ন উপাচারে এদের জব্দ করতে বিশেষ বেগ পেতে হত না। কিন্তু এমন হাট ঘাট করা, হাত মাংসের পুটলি নেওয়া অশুদ্ধ শরীরে তো সেসব কিছুই সম্ভব না!!! তবে এদের তো কিছু একটা বলে ঠ্যাকাতে হবে। ”

এদিকে ততক্ষনে আশে পাশে আরও বেশ কয়েক খানা ভূত এসে জুটেছে। সবাই মিলে ঘিরে ধরল ঠাকুর কে, বলল - “ঠাকুর মশাই!!! রাজি হতেই হবে.. নইলে পথ ছাড়বনা। ”

গোপাল ঠাকুর দেখলেন এ এক বিষম সংকট !! এখন রাজি না হয়েও উপায় নেই।তাছাড়া রাত বিরেতে কতরকম বিপদ ঘটতে পারে। কাজেই এদের মন খুশী না করলেও চলে না। তাছাড়া একটা বুদ্ধি করেই বাঁচতে হবে। তাই জিজ্ঞাসা করলেন -“ তোদের বাবার শ্রাদ্ধ কবে বাপু? "
“ এই তো আজকেই কত্তা বাবা ” “সে কি রে ?? এখন তো ভর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসছে। সন্ধ্যা বেলা কি শ্রাদ্ধ হয়? শ্রাদ্ধ তো দিনের বেলাতে করতে হয়।” | “ আপনাদের মানুষের শ্রাদ্ধ দিনের বেলা তে হয়!! আমাদের শ্রাদ্ধ তো রাতের বেলাতেই হয় কত্তা!! ”

গোপাল ঠাকুর দেখলেন মহা বিপদ। স্বীকার না হয়েও উপায় নেই। তাই বললেন - “শ্রাদ্ধ করা তো মুখের কথা নয়!!! তার জন্য৷ অনেক কিছু যোগাড় যন্তর করতে হবে। তবে তো..”

ভূতেরা ঠাকুর কে থামিয়ে বলল “ আমাদের যোগাড় যন্তর সব হয়ে গেছে কত্তা... আপনি গিয়ে কাজে বসে পড়লেই হল। খাবার দাবারও সব তৈরী। ”

গোপাল চাটুয্যে দেখলেন এখন আর রাজি না হয়ে উপায় নেই, ভূতেদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বনের একটু ভেতরে এলেন । দেখলেন সত্যিই গাছের তলায় বড় বড় মান কচুর পাতায়, মরা মানুষের মাথার খুলিতে কত সব কত কিছু সাজানো। কেঁচোর চচ্চড়ি, মরা ইঁদুরের ঘন্ট, শুকনো মর কাকের কাবাব, গুগলি আর ঝিনুকের স্যুপ, লক্ষ্ণৌ ভূত ঘরানার বিশেষ পদ, কাউয়া বিরীয়ানি। আরও কতও কিছু।

গোপাল ঠাকুর ওসব দেখে বললেন - “সত্যিই ... তোরা পেল্লায় আয়োজন করেছিস বটে”

গাছের তলায় টিম টিম করে বাতি জ্বলছে। একটু ভালো করে দেখতেই দেখলেন, ওটা বাতি নয়। কত গুলো জোনাকি পোকা ধরে এনে গোবরের মধ্যে গুঁজে রাখা হয়েছে। এ তারই টিমটিমে আলো। একটা জায়গা নিকিয়ে পরিস্কার করা হয়েছে। একটস খড়ের আসনও পাতা রয়েছে সেখানে। একটি ভূত বলল, “ এখানে বসুন কর্তা ”

গোপাল ঠাকুর সেখানে বসলেন। মনে মনে ভাবলেন, আচ্ছা ফ্যাদাদে পড়া গেল। আজ বুঝি ভূতের হাতেই বেঘোরে প্রাণটা যায়। হঠাৎ গোপাল ঠাকুরের মাথায় বুদ্ধি গজালো। তিনি বল্লেন - “আরও একটা আসন লাগবে যে !! যে পিন্ডি দেবে তাকেও তো এখানে বসতে হবে। ”

সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তামিল হল। একটা ভূত হাত বাড়িয়ে দিল সেই হাত খানা লম্বা হতে হতে গিয়ে ঠেকল জলার ধারের কাশ বনে। সেখান থেকে এক মুঠো কাশ ছিঁড়ে আনল। চোখের নিমেষে আসনও তৈরী হয়ে গেল। চোখ ছানাবড়া করে গোপাল চাটুয্যে ভূতের কান্ড কারখানা দেখলেন।

পাশেই আসন পাতা হয়ে গেল। গোপাল ঠাকুর বললেন, “ তোদের মধ্যে একজন কে এখানে বসতে হবে।মন্ত্র পড়তে হবে। ” একটা লিকলিকে ভূত এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, “পিন্ডি দেবার সময় ঐ ওনার নাম নিতে হবে না তো? ”

গোপাল ঠাকুর বললেন, “ কাদের নাম? প্রভু শ্রী রামের? না না .. ওই মুখে তার নাম নিতে তোদের নিতে হবে না। ”

গোপাল ঠাকুরের হাতে যেই ঝোলা খানা ছিল, তাতে ছিল বেশ কিছু খাবার দাবার। সেটার উপর নজর সবারই ছিল। লোভও ছিল সকলেরই। তারা ভেবেছিল ঠাকুর মশাই যেই মন্ত্র পড়তে বসবেন, ওমনি ঐসব জিনিসের সদ্গতি করবে। কাজেই গোপাল ঠাকুর ঝোলা খানা পাশে রেখে আসনে গিয়ে বসতেই, কয়েকটা ভূত উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল।

গোপাল ঠাকুর সেটা বুঝতে পেরে বললেন, “শোন্ !! তোরা সবাই উপুস করে আছিস তো? শ্রাদ্ধ শেষ না হওয়া অবধি উপুস করে থাকতে হয়।”

এবার আর কোন ভূতের মুখে রা নেই। গোপাল ঠাকুর বল্লেন, “ আমার ঝোলায় আছে পাঠার মাংস, মাছ, সন্দেশ, মিহিদানা, গজা। তোদের শ্রাদ্ধের জন্য কাজে লাগবে। যেই একজন উপুস করে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়বে, সেই শুধু একা ওগুলো খাবে। অন্য কারুর খাওয়া একেবারে নিষেধ।

কথা শেষ হতে না হতেই একটা সিঁটকে ভূত আসনের উপর গিয়ে বসে পড়ল। বলল - “ আমি মন্তর পড়ব” সঙ্গে সঙ্গে মামদো ভূত তাকে টেনে তুলে বলল, “ ব্যাটা জোচ্চোর কিম্ভুত!! তুই কিনা মন্তর পড়বি তুই উপুস করেছিস হতভাগা ? ”

“ তো কি করিনি ? ” “ তো দুপুর বেলা, ওই মরা ছাগলের বাচ্ছাটাকে কে খেল ? ওঠ ওঠ, আমি মন্তর পড়ব। ” বলেই ধুপ করে মামদো ভূত টা, আসনে গিয়ে বসে পড়ল।

অমনি পাশ থেকে একটা হোমড়া চোমরা মেছো ভূত মামদোর গালে বসিয়ে দিল, এক থাপ্পড়। বলল, - “ কি? তুই পড়বি মন্তর? তুই আর উপুস করলি কখন? পচা ডবা থেকে শামুক গুলো তুলে খেয়েছিলিস যে, ভুলে গেছিস নাকি? যা যা.. আমি পড়ব মন্তর। ”

হঠাৎ গাছ থেকে আরও একটা গেছো ভূত, লাফ দিয়ে মেছো র ঘাড়ের উপর পড়ে বলল, “ ফের মিছে কথা কইছিস গোবরা? তুই আবার কোথাকার উপোসী? আজ সক্কাল বেলাতেই তো.. বাগদীদের আস্তাকুড় ঘেটে কত এটো কাটা খেয়ে এলি! মন্তর যদি পড়তেই হয় তবে আমিই পড়ব।”

গোবরাও ছাড়বার পাত্র নয়। সে বিরাশি সিক্কা ওজনের এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল গেছো ভূত নন্টের গালে। বলল - “ আমার ওপর কর্তালি করতে আসিস কোন সাহসে রে? তুই কি খেয়েছিস আমি দেখিনি? ” “কি খেয়েছি..? ”
“ ব্যাঙ খেয়েছিস.. ”

ওদিকে আগের ভূত গুলোও হাতাহাতি শুরু কর দিয়েছে। তুমুল হাতাহাতি। তাদের দেখে বাকি ভূত গুলোও একেকটা,পক্ষ নিয়ে তুমুল মারামারি শুরু করে দিল। যে আসনে বস্তে চায়, তাকেই কেউ না কেউ উত্তম মধ্যম পেটায়। চোখের নিমেষে লঙ্কাকান্ড বেঁধে গেল।

গোপাল ঠাকুর দেখলেন এই তো সুযোগ। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ঝোলাটা কোনমতে হাতে নিয়েই দে ছুট। মুখে জোড়ে জোড়ে রামনাম আওড়াতে লাগলেন। যত দূর যান ততই রাম রাম করে জোরে জোরে চেঁচান। শেষ অব্ধি কোন মতে বাড়িতে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।

( ভুতের গল্প শেষ খতম টাটা বাই বাই :D )

Coin Marketplace

STEEM 0.17
TRX 0.16
JST 0.031
BTC 60343.62
ETH 2490.29
USDT 1.00
SBD 2.53