|| ছেলেবেলা আর ভাগীরথী ||
মুর্শিদাবাদের একটি ছোট্ট শহর জঙ্গিপুর। যে শহরে আমার বেড়ে ওঠা। আজ সে শহর নিয়েই দুটো কথা হলো। আর কথা বললাম সে শহরের বুক দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ভাগীরথীকে নিয়ে।
আমার বাড়ির আশেপাশে বিশেষ কোন বন্ধু নেই। কেবল একটি আছে। ছেলেবেলা থেকে হোস্টেলে পড়বার কারণে সেরকম কোন বন্ধু হয়ে ওঠেনি। যারা আছে তারা প্রত্যেকেই হোস্টেলের আশেপাশের। তাই বন্ধুদের জন্য আমাকে একটু বেশি ছুটতে হয়। মন খারাপ হলে আমাকে ট্রেন ধরে চলে যেতে হয় জঙ্গিপুরে। জঙ্গিপুর মুর্শিদাবাদ জেলার একটু ছোট্ট সুন্দর ফুলের মত সাজানো শহর। আমার দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে এই শহরে। এই শহরেই আমার বেড়ে ওঠা। দশ থেকে ষোলো বছর অব্দি বয়সটা আমার এখানেই কেটেছে। এই জায়গায় আমি থেকেছি, এখানকার মাটিতে খেলেছি, এখানকার মাটি মেখে আমার বড় হয়ে ওঠা। এই জায়গায় আমার আসল বন্ধু হয়ে উঠেছে। তাই স্কুল হোস্টেল ছেড়ে দিলেও এই জায়গা এখনো ছাড়তে আমি পারিনি। আমার যে সকল বন্ধুরা এখানে আছে, তাদের ভালোবাসায় মূলত এ জায়গা থেকে আলাদা আর কখনো হতে হয়নি।
এই তো কিছুদিন আগে, ঈদের আগে হঠাৎ করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম জঙ্গিপুরে, আমার বাড়িতে থেকে জঙ্গিপুর অনেকটাই দূর। ট্রেনে যেতে হলে তিন ঘন্টা তো লেগেই যায়, আর বাসে সাড়ে তিন-চার! এত দূরে থেকেও আমার সেই জায়গাকে দূর ভুলে কোনদিন মনে হলো না। যখনই ছেলেবেলা স্মরণ করি তখনই সে জায়গা ভেসে ওঠে সেই স্থান সেই স্কুল সে বাড়ি, সে আমার ঘুরে বেড়ানো, সেই মাঠ, সে গাছপালা, সেই আকাশ। সমস্ত কিছু একত্রে স্মরণ হলে আমি সব দূরত্ব ভুলে গিয়ে ছুটে চলে যাই।
ঈদের আগে যখন জঙ্গিপুরে আমি গেলাম, তখন কাছাকাছি জায়গায় থাকা সকল বন্ধুরা হাজির হয়ে গেছে একসাথে। গাড়ি থেকে নামা মাত্রই সকলকে একত্রে দেখতে দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। আমার সকল ছুটে আসা তো এই কারণেই।
তারপর যে কদিন থাকি শুধু আনন্দই কাটে।ছেলেবেলায় ঘুরে বেড়ানোর সমস্ত জায়গায় তো আমার চেনা। সুভাষ দ্বীপ- যে দ্বীপে আমরা 'চিলড্রেনস ডে' পালন করতে যেতাম। দ্বীপটা খুবই সুন্দর ছিল। ছোট্ট। একটা দিক অনেকটাই উঁচু। চারিপাশে নদী। প্রধান নদী ভাগীরথী এক পাশে বয়ে গেছে। অন্যদিকে একটা ছোট নদী। এইভাবে সুভাষ দ্বীপ মুর্শিদাবাদের একটি নামকরা দর্শনীয় স্থান ও সময় কাটাবার জায়গা হয়ে উঠেছে। দ্বীপে প্রচুর গাছ রয়েছে। রয়েছে সবুজ ঘাস। শিশুদের জন্য খেলার নানা ব্যবস্থা আছে। টয় ট্রেন রয়েছে সহ আরো অনেক কিছু। স্কুল থেকে আমাদের বাসে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হতো। সাথে যেতেন সমস্ত আঙ্কেলরা রান্নার যাবতীয় বাসনপত্র খাবার ও সরঞ্জাম নিয়ে। সেখানে রান্না হতো। আমরা সুভাষ দ্বীপে সবুজ ঘাসের আনন্দে ঘুরে বেড়াতাম। তারপরে একসাথে সবাই মিলে খেতাম। সাথে মিষ্টি সিঙ্গারায় ভরা টিফিনের প্যাকেট দিতো শুরুতে। সবমিলিয়ে ওই দিনটা আমাদের কাছে ভীষণ উপভোগ্য ছিল।
বহুদিন পর বন্ধুদের নিয়ে হঠাৎ করে সেই ছেলেবেলাকে স্মরণ করে সুভাষ দ্বীপে গেলাম। গিয়ে দেখি অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। দ্বীপে ঘন ঘাস -গাছপালা এখন বিশেষ আর নেই। শিশুদের খেলনার ব্যবস্থাপনাও পুরনো অকেজো হয়ে উঠেছে। শুধু দেখলাম একটি মাত্র দোকান রয়েছে, যে দোকানটি আগেও ছিল। তারও দশা বিশেষ ভালো নেই।
স্কুলে একটা প্রিয় খাবার আমাদের ছিল আমাদের। সেটা হল মোগলাই পরোটা। জঙ্গিপুরে দুটো হোটেল ছিল, একটি সঙ্গম ও একটি মিলন। দুটো হোটেলেই খাবারের মান কোয়ালিটি ভীষণ সুন্দর ছিল। তবে আমরা বেশি সঙ্গমেই মোগলাই খেতাম।
ছেলেবেলায় মোগলাই সকলের প্রিয় ছিল। তখন দাম আর কত হবে, খুবই কম! আমরা তখন কিনতাম আঠেরো টাকায় বড় একটা মোগলাই। এবার গিয়ে দেখি সে মোগলাই আশি টাকা হয়ে গেছে। যেভাবে চারপাশের দাম বাড়ছে, সেটারও বেড়েছে! আর এতদিন পর গিয়ে সেই ফারাকটা দেখে সেটাই নিয়ে বন্ধুরা আলোচনা করলাম।
বহুদিন পর ভাগীরথীর বুকে দাঁড়ালাম। দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগলো। যেন বহুদিনের সেই 'আমি'কে চিনতে পেরে জানান দিল! আমিও মুহূর্তেই বহু বছর আগের সেই ছেলেবেলার দিনগুলো স্মরণ করতে পারলাম। যখন কারণে-অকারণে স্কুল থেকে পালিয়ে ভাগীরথীর ধারে এসে দাঁড়াতাম। একই রকম হাওয়া এসে বুকে লাগতো। এভাবেই।
এই হাওয়া সমস্ত ব্যথা-বেদনা মুহূর্তে মুছে ফেলতে পারে। মুহূর্তে একটা নস্টালজিক মোমেন্ট তৈরি করে! যেখানে সমস্ত কিছুই স্বর্গ মনে হয়! এই ভালোলাগা পেতে মাঝে মাঝেই আমাকে এই ভাগীরথীর পাশে দাঁড়াতে হয়।
Place - Jangipur, Murshidabad
Camera - NIKON D5200
বন্ধুরা আজ এই অব্দি রইল। আগামীকাল আবার নতুন একটি লেখা নিয়ে হাজির হব। ততক্ষণ ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।
সত্যি বলতে আপনার পোস্ট টা পড়ে আজ একটা অন্যরকম অনূভুতি জানতে পারলাম। আপনার গ্রামের নামটা শুনে অবশ্য বেশ অবাক লেগেছে জঙ্গিপুর। তবে তাতে কী। আপনার কথা শুনে মনে হলো জঙ্গিপুর জায়গাটা বেশ সুন্দর। আসলে জীবনের কঠিন খারাপ সময় গুলো বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে সহজেই কেটে যায়।
একেবারেই ঠিক বলেছেন দাদা। ধন্যবাদ আপনাকে মন্তব্য করার জন্য।