আমার দেখা পহেলা বৈশাখ || লাজুক খ্যাঁকের জন্য ১০% বরাদ্দ।

কেমন আছেন সবাই? আশা করি সবাই ভালো আছেন। আমিও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। সম্রাট আকবরের শাষনামল থেকে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালনের রেওয়াজ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বৈশাখের প্রথম দিন দেশের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে মেলা বসে। পহেলা বৈশাখের এই মেলা বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকায় বর্ষবরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। চারুকলার শিক্ষার্থীরা লোকজ চিত্রকলা আঁকে, হাতি ঘোড়ার মুখোশ তৈরী করে নানান সাজে নানান বৈচিত্রে বৈশাখী শোভাযাত্রায় অংশগ্রহন করে নতুন বছরকে বরন করে নেয়।

পান্তাভাত ও ইলিশ মাছ ভাজি দিয়ে বছরের প্রথম দিন টা শুরু করে বাংলার সর্বস্তরের জনগন৷ পহেলা বৈশাখে গ্রামে জমে উঠে হালখাতার উৎসব। হালখাতা উপলক্ষে ক্রেতা বিক্রেতার লেনদেনে সারা বছর যা বাকি থাকে তা পরিশোধ করা হয়। নববর্ষ উপলক্ষে একে অপরের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এজন্য বলা হয় বাংলা নববর্ষ বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি উপাদান। এই উৎসব বাঙালীর মিলনমেলার সেতুবন্ধন তৈরী করে।

আজ আমি আমার ছোট বেলার পহেলা বৈশাখের একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি -

Source
সারা রাত অধীর আগ্রহের পর এখন সকাল। প্রতি বছর এইদিনে আমার উত্তেজনা যেন চরমে পৌছায়। আজ আমি আমার মাটির ব্যাংক ভাংবো। আমার ছোট জনের আগ্রহ টাও নেহায়েত কম নয়। সে অবশ্য কোনো ব্যাংকের মালিক না। তার বয়স ৮ বছর হবে আর দুই দিনের পরেই। তার জন্মদিন পহেলা বৈশাখের পরের দিন। দিন টা আমার জন্য ছিলো স্মরনীয় একটি দিন। আমার স্পষ্ট মনে আছে-

তখন আমাদের গ্রাম এতোটাও আধুনিক হয়ে উঠে নাই। এখনকার দিনের মতো সন্তান হওয়ার আগে কেউ বুঝতো না ছেলে হবে নাকি মেয়ে। সন্তান হওয়া ছিলো সবার জন্য একটি অনবদ্য সারপ্রাইজ। আমার বাবা মায়ের আমি প্রথম সন্তান তাই তাদের খুব আশা ছিলো এবার আমার একটি ফুটফুটে বোন হবে। কিন্তু কেন জানি না আমার মনে হতো আমার একটা ভাই হবে। আমিও আসলে ভাই ই চাইতাম।
পহেলা বৈশাখের দ্বিতীয় দিন আমার ভাইয়ের জন্ম হয়। বোন না হওয়াতে আমার পরিবার কিছুটা আশাহত হলেও আমার ফুটফুটে ভাইকে দেখে তাদের মনের নিরাশা মুহুর্তেই দূর হয়ে গেছিলো। আমার তো আনন্দের সীমা ছিলো না। আমার মনের আশাই পূরন হয়েছে এখন আমি আমার ভাইয়ের সাথে খেলাধুলা করতে পারবো। আমার প্রতিবেশীদের সবাইকে আমি ই খবর টা দিয়েছিলাম আমার ভাই হয়েছে। সবাই আমার ভাই কে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো। তার নাম রাখা হয়েছিলো রাফিন। রাফিন শব্দের অর্থ প্রশংসিত।

আমি মাঝখানে আর আমার চারপাশে গোল হয়ে সবাই বসেছে। সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে আমি কত টাকা জমিয়েছি। আগ্রহের আরো একটা কারন আছে, আমি যত টাকা জমিয়েছি আমার বাবা আমাদের দুই ভাই কে তার দ্বিগুন টাকা দিবে।
ব্যাংক ভাঙা হলো এখন টাকা গুনার পালা। আমি আর আমার মা টাকা আর পয়সা গুলোকে আলাদা করে গুনতে লাগলাম। আমি পয়সা গুলো গুনছি আর আমার মা টাকা গুনছে। সবগুলো পয়সা মিলে টাকার পরিমান দাঁড়ালো ৩৭২ টাকা আর টাকাগুলো মিলে হলো ১২১০ টাকা৷ তার মানে আমি এক বছরে ১৫৮২ টাকা জমিয়েছি।

কাল পহেলা বৈশাখ, বিরাট ঐতিহ্যবাহী মেলা বসবে। এমন কোনো জিনিস নাই যেটা আমাদের এই মেলায় পাওয়া যাবে না। মেলাটি থাকবে ৩ দিন। আমি আর আমার ভাই ৩ দিনই মেলায় যাবো প্রথম দিন যাবো বাবার সাথে, দ্বিতীয় দিন চাচ্চুর সাথে আর শেষদিন যাবো ছোট মামার সাথে। প্রথম দিন যাবো মেলায় ঘুরে বেড়াতে আর দেখতে কি কি জিনিস কেনা যায় তার একটা ছক বানাতে। কতো ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা যে থাকবে বলে শেষ করা যাবে না।
সব কিছুর মধ্যে নাগরদোলা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। মেলার সময়েই আমার নাগরদোলায় উঠার সুযোগ হয়। আমি মেলার প্রতিদিন ই একবার করে উঠি নাগরদোলায়৷ দুই বছর আগে যখন রাফিন ছোট ছিলো সেইবার আমরা সবাই একসাথে নাগরদোলায় উঠেছিলাম আর রাফিন ভয়ে হিসু করে দিছিলো৷ রাফিনের প্রিয় পুতুল নাচ তার আগ্রহের জন্য আমাদের প্রতি বছরই পুতুল নাচ দেখার সুযোগ হতো।

আমার চাচ্চু ভোজন রসিক মানুষ তার সাথে মেলায় গেলে তার চোখন থাকবে খাবারের দিকে। মেলায় বাহারি ধরনের খাবার থাকে যেগুলো সাধারনত সারা বছর পাওয়া যায় না। পহেলা বৈশাখ উপক্ষেই এসব খাবার তৈরী করা হয়। আমাদের মেলার দ্বিতীয় দিন হলো খাওয়া দিবস। যার যেটা ইচ্ছা খাবো আর বাড়ির জন্য অনেক খাবার নিয়ে আসবো। মেলায় এক ধরনের মিষ্টি খাবার পাওয়া যায় যেগুলো বানানো হয় বিভিন্ন প্রানীর আকৃতিতে। আমরা খুজে খুজে সব রকম আকারের খাবার নেই।

Source
মেলার শেষ দিনের আকর্ষন টা বেশী থাকে। মেলা শেষ, তাই দোকানদাররা কম দামে সব জিনিস বিক্রি করে দিবে সেই আশায় খেলনা কিনতে যাই মামার সাথে। মামা সবসময় বাজার থেকে জিনিস কিনে জিতে আসে, সে দামাদামি করার লোক। এজন্যই কেনাকাটা করতে সব সময় মামার সাথেই যাওয়া হয়৷ মামা দোকানদারের সাথে রীতিমতো ঝগড়া শুরু করে দিতো নির্দিষ্ট দামের থেকে অনেক বেশী দাম বললে। যাইহোক, নানান ধরনের খেলনা কিনে আমারা বাড়িতে ফিরি।

এভাবেই আমাদের মেলার তিন দিন অতি উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে কেটে যেত।

একটা ঘটনা বলি -
তখন আমি ছোট। সম্ভবত আমি চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেনিতে পড়ি। রাফিন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। মেলার প্রথম দিন আমরা আমাদের পরিবারের সবাই মিলে মেলায় গেছি ঘুড়তে। বাড়ির মহিলাদের নিয়ে মেলায় গেলে সাধারনত সন্ধ্যার পড়ে যাওয়া হতো। যথারীতি সন্ধ্যার দিকে সবাই মিলে ঘুড়তে গেছি। আকাশের অবস্থা কিছুটা খারাপ থাকলেও মনে হচ্ছিলো না বৃষ্টি নামবে। কিন্তু সেইদিন ঘটেছিলো এক ভয়ংকর ঘটনা।

Source

বৈশাখের প্রথম দিন, গ্রীষ্মেরও প্রথম দিন৷ অনেক বছরই এইদিন বৈশাখ তার কাল বৈশাখী রূপ দেখিয়ে দেয়। আমি সেদিন দেখেছিলাম কাল বৈশাখীর তান্ডব।

বৈশাখের ১ম দিন স্বভাবতই অনেক মানুষ মেলায় যায়। প্রচুর ভীড় ছিলো সামনে আগানোই কষ্ট হচ্ছিলো। নানান রঙ বেড়ঙের কারনে আকাশের অবস্থা একদম বুঝা যাচ্ছিলো না। কখন যে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আমরা খেয়ালই করি নাই। হঠাৎ করে প্রচুর বাতাস শুরু হলো, ধুলাবালি উড়তে শুরু করলো। ধুলায় তাকাইয়া থাকা যাচ্ছিলো না। আমরা ছিলাম ৬ জন, আমি ছিলাম চাচ্চুর কাছে, রাফিন আম্মুর কোলে আর আব্বুর হাত ধরে ছিলো আরিফা আপু। মানুষজন এদিক ওদিক উলটা পাল্টা ভাবে ছুটাছুটি করছিলো মেলা থেকে বের হওয়ার রাস্তাই পাওয়া যাচ্ছিলো না। এর মধ্যে চাচ্চুর চোখে বালি ঢুকে যাওয়াতে আমাকে নিয়ে বের হওয়া তার জন্য কষ্ট হচ্ছিলো। তাই আমরা একটা মিষ্টির দোকানের ছাওনিতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম কালবৈশাখীর ভয়াবহতা। মেলায় দোকানপাট সাধারনত টিনের ছাওনী দিয়ে করা হয়, এসব দোকানের টিন গুলো বাতাসে এদিক ওদিক উড়াউড়ি করছিলো। কি ভয়ংকর দৃশ্য যে ছিলো সেটা বলে বুঝানো যাবে না। বিভিন্ন খেলনার দোকানের খেলনা গুলো উড়ে কোথায় চলে গেছিলো তার কোনো হিসেব ছিলো না। প্রায় এক ঘন্টা ধরে ধ্বংসাযজ্ঞ চলার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয় আর আমরা মেলা থেকে বের হই। মেলা থেকে বের হয়ে রাফিন বলে আম্মু আমার জুতা!
আমরা সবাই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলি।

কালবৈশাখীর এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা কোনোদিন ভুলবো না।

এখন বড় হয়ে গেছি আনন্দ পরিবর্তন হয়ে গেছে। গত চার পাঁচ বছর পহেলা বৈশাখে বাড়িতে থাকা হয় না। পরিবারের অন্য সদস্যরাও যার যার কাছে ব্যাস্ত হয়ে গেছে। সবার একসাথে থাকার সুযোগ হয় হাতে গোনা কয়েকবার। এখন পহেলা বৈশাখ উৎযাপন করি অনলাইনে। বৈশাখ নিয়ে আবেগী কোনো পোষ্ট করার মধ্যেই সেই আনন্দ সীমাবধ্য থাকে।

সময় নিয়ে আমার লেখা পড়ার জন্য জন্য সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।

"আমি সাইদুল ইসলাম কাকন। আমি বর্তমানে অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। আমি ভ্রমন প্রিয় মানুষ। ছবি আঁকতে অনেক ভালোবাসি। এছাড়াও রান্না করতে পছন্দ করি। আমি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তবু্ও চেষ্টা করি গরীবদের সাহায্য করতে। "