ঈদ স্পেশাল গল্প || ঈদ যাত্রা || ১০% লাজুক খ্যাঁকের জন্য।

কেমন আছে সবাই? আশা করি সবাই অনেক ভালো আছেন। আমিও আল্লাহ রহমতে ভালো আছি। আসকে আমি আপনাদেত সাথে আমার নিজের লেখা একটি গল্প শেয়ার করবো। গল্পটি ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে তাই আমি গল্পের নাম দিলাম ঈদ যাত্রা। তো চলেন শুরু করা যাক,

আয়না দেখে চিরুনি দিয়ে চুল গুলোকে ভাজ করে নিয়ে আয়না আর চিরুনি পকেটে রাখলো মজিদ৷ ফুল হাতা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর বাদামী রংয়ের জুতা পড়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের সামনে চায়ের দোকানে পত্রিকা হাতে বসে আছে। তাকে দেখতে খুব সহজ সরল লাগছে। তার চেহারার সরলতাই তার ব্যাবসার সম্বল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো কাউকে খুঁজছে।

আব্দুল জব্বার সাহেব, বেসরকারি একটি অফিসে চাকরি করেন। বয়স আনুমানিক ৪০ হবে। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। এবার তিনি ইদের ছুটি পেয়েছেন ৮ দিন। আজকের অফিস শেষ করেই তাকে টিকিট কেটে লঞ্চযোগে যাত্রা শুরু করতে হবে বরিশালের উদ্দেশ্যে। তার বাড়িতে দুই ছেলে আর এক মেয়ে, সবার জন্য যথা সাধ্য কেনাকাটা করেছেন। তার বাবা মা-ও বেঁচে আছেন। তাই তাদের জন্যও কেনাকাটা করতে ভুলেন নি। বাবার জন্য পাঞ্জাবি পায়জামা আর মায়ের জন্য একটি শাড়ি কিনেছেন।

source
শুধু ভুলে গেছেন তার অফিসে যাওয়ার জুতা যে ফুটো হয়ে গেছে সেই কথা। ছেঁড়া জুতা পড়ে অফিস যাওয়া তার অভ্যাস হয়ে গেছে৷ তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কথাও মনে রেখেছেন। তার স্ত্রীর জন্য আহামরি কেনাকাটা করতে না পারলেও মন খুশি রাখতে তার প্রয়োজনীয় গ্যাসের চুলা কেনার জন্য ৬ হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছেন।
এবার ইদে গ্যাসের চুলায় রান্না করা সেমাই, সবাই মিলে খেয়ে ইদের নামাজ পড়তে যাবেন। তার ভিতরে চরম উত্তেজনা কাজ করছে। কখন অফিস থেকে বের হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবেন সেই দেরি যেন আর সহ্য হচ্ছে না।

বিকেল পাঁচ টায় তার অফিস ছুটি হয়েছে। রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকা সত্বেও সে এখন লঞ্চ টার্মিনালের সামনে চলে এসেছেন। টার্মিনালে এসে তার চক্ষু চরগ গাছ হয়ে গেলো, টার্মিনালের সামনে টিকিটের বিরাট লাইন। শরীরের ক্লান্তি দূর করতে পাশেই একটি চায়ের দোকানে বসে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, আজকে টিকেট কেটে আজকেই কি রওনা করা সম্ভব কিনা!

মজিদ সামনে থেকে পত্রিকা নামিয়ে বললেন-

• ভাইজানের কথা শুনে মনে হয় বরিশালের লোক।

-জ্বি ভাই। বরিশাল ই যাবো তা টিকিটের যে লাইন পড়ছে তাতে টিকিট পাওয়া যাবে কিনা আল্লাহ মালুম। আপনি কোথায় যাবেন?

• আমি আর আপনি মনে হয় একই পথের পথিক। কিন্তু আমি মনে হয় আপনার থেকে কিছুটা এগিয়ে আছি। কারন আমি ইতোমধ্যেই টিকেট কেটে বসে আছি।

• ওহ তাহলে তো আপনার চিন্তা নাই। তা লঞ্চে না উঠে এখানে বসে আছেন কেন?

• আর বইলেন না! কি একটা বিপদে যে পড়ছি, এলাকার এক বন্ধুর জন্য টিকেট কেটে তার জন্য অপেক্ষা করছি। মনে হচ্ছে না আজ আর আসবে। ফোন করছি, ফোনও বন্ধ করে রেখেছে।

• ভাইজান কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনার লোক না আসলে কি আপনার টিকিট টা বিক্রি করবেন?

• সেইরকম লোক পেলে বিক্রি করবো। জানেন ই তো আমাদের দেশ টা চোরে ভরে গেছে বিশ্বাস করার মতো মানুষ পাওয়া মুশকিল।

• হ্যাঁ। তা অবশ্য।

• আপনার সাথে যেহেতু পরিচয় হলো আপনি চাইলে আপনার সাথে জার্নি করাটা মন্দ হবে না।

• বাচঁাইলেন ভাই। আজকে আমি লাইনে দাড়াইলে মনে হয় না বাড়ি যেতে পারবো।

মজিদ পকেট থেকে টিকেট টা বের করে জব্বার সাহেবের হাতে দিলেন। টিকেটটি নিয়ে জব্বার সাহেব টাকা বের করার জন্য পকেটে হাত দিলেন। মজিদ বললো না না এখনি দিতে হবে না। আজ যেহেতু সারারাত একসাথে জার্নি করবো পরে দিলেও চলবে।

• না না এখনি দিয়ে দেই। দিতে যেহেতু হবে এখনি নিন৷

দুই জনের কামড়া। তাই দুটো সিংগেল বেড পাতা দুইপাশে। দুইজন দুইপাশের বেড ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। লঞ্চটি লম্বা হুইসেল দিয়ে ঘাট ত্যাগ করলো। লঞ্চের বেয়ারা দরজায় উঁকি দিয়ে বললো -

-স্যার দরজা বন্ধ করে রাখবেন।

• আচ্ছা তোমার চিন্তা করা লাগবে না আমরা বন্ধ করে দিবো।
• চোর ছেচ্চরে দেশ ভরে গেছে স্যার। সতর্কতাই একমাত্র উপায়।

মজিদ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন -

• দেখছেন ভাই, লঞ্চে দরজা খুলে একটু আরাম করে বাতাস খেয়ে জার্নি করবো তারও উপায় নেই। দেশ টা যে কি হয়ে গেলো!
  বলেই মজিদ তার সাথে ঘটে যাওয়া একটা ছিনতাই এর ঘটনা সুন্দর ভাবে বর্ননা করলো।

জব্বার সাহেব দীর্ঘ এক বছর পর ছেলেমেয়েদের সাথে ইদ পালন করতে যাচ্ছে সেই ভাবনাতেই সে বিভোর। তার সব জিনিস পত্র গুছিয়ে রেখে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।

মজিদ তার ব্যাগ থেকে একটি ইংরেজি বই বের করে চোখ বুলাতে শুরু করলেন। যদিও সে ইংরেজি বানান করে কোনো শব্দ মিলাতে পারে না৷ খুব মনোযোগের সাথে পড়তে পড়তে এক সময় দুই বেড এর মাঝে থাকা টেবিলের উপর বইটি উলটা করে রেখে পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার কাল্পনিক স্ত্রীর সাথে গল্প করতে আরম্ভ করলো -

-রুমানা সব ঠিকঠাক আছে তো।

• আরে নানা চিন্তার কোনো কারন নেই আমার পাশের সীটে অনেক ভদ্র একজন কে পেয়েছি।
• আর শোনো। এতো সকালে বেচারা ড্রাইভারের লঞ্চঘাটে আসার কোনো দরকার নেই। আমি একটি ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসতে পারবো।
• হুম হুম। তিন্নি কি করে? দাও দেখি তার সাথে কথা বলি।

তারপর তিনি তার কাল্পনিক মেয়ের সাথে প্রায় তিন মিনিট ধরে কথা বললো। জব্বার সাহেব তার সমস্ত কথোপকথন না শুনলেও ঠিক ই আন্দাজ করতে পারলো লোকটি তার পরিবারের সাথে কথা বলছে। আর লোকটি একজন সচ্ছল মানুস এবং পারিবারিক ভাবে সুখি।

জব্বার সাহেব কম কথা বলা স্বভাবের মানুষ হলেও শেষ পর্যন্ত মজিদের সাথে আলোচনায় মেতে উঠলো। হাল্কা কিছু রসিকতাও হলো দুই জনের মধ্যে।

এরপর মজিদ উদাসীন ভংগিতে জানালার দিকে তাকিয়ে বললো তাড়াহুড়ার কারনে বাসা থেকে খেয়ে বের হতে পারি নি। খুব ক্ষিধা লেগে গেছে ভাই৷ আপনি খেয়ে এসেছেন?

-জ্বি ভাই। আমি খেয়েই বের হয়েছি।

আমি আসার সময় ফার্স্টফুডের দোকান থেকে কয়েকটা স্যান্ডউইচ কিনে নিয়ে এসেছি। আপনি অনুমতি দিলে খাওয়া শুরু করতে পারি৷

• হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই আপনি খেয়ে নিন।

মজিদ তার ব্যাগ থেকে কয়েকটা স্যান্ডউইচ বের করলো। প্রথম টায় ধুতরা বিষ মিশানো। অনেক বার পরিক্ষা করে তিনি দেখেছেন বাজারের অন্যসব বিষের তোলনায় ধুতরা বিষ অনেক ভালো। কোনো গন্ধ নেই, কোনো প্রকার তিতো স্বাদ নেই তাই খাবারের সাথে খুব সহজেই মানুষকে খাওয়ানো যায়।

মজিদ একটা ভাব নিয়ে বললো অনেক গুলো দিয়েছে দেখি! খাবেন নাকি একটা।

• না না আমি খেয়ে এসেছি। আপনি খেয়ে নিন।

মজিদ দ্বিতীয় স্যান্ডউইচ টা নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।

তারপর তিনি বাঙালীর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কিছুটা রসিকতা করে বললো -
-আমরা হলাম মাছে-ভাতে বাঙালী। আমাদের কি আর ইংরেজ দের স্যান্ডউইচ খেয়ে পেট ভরে!

• কি আর করার বিপদে পড়ে অনেক সময় খাওয়া লাগে, খেয়ে নিন।

এরপর মজিদ ব্যাগ থেকে দুইটা কোকের ক্যান বের করলো একটায় ধুতরা বিষ মিশানো অন্যটা ভালো। বিষ মিশানো ক্যান টা নিয়ে জব্বার সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো-

• সাথে আমার এক বন্ধু থাকার কথা ছিলো তাই দুইটা কোক এনেছি। বাসা থেকে ভাত খেয়ে আসলেও নিশ্চয়ই কোক খেয়ে আসেন নাই। বলেই হাসয়ে হাসতে কোকটা এগিয়ে দিলো।

লোকটার সাথে এতখন সময় পার করার পর যেকোনো মানুষ কোক নিয়ে খাবে তার সম্ভাবনা শতকরা নব্বই ভাগ। জব্বার সাহেবও কোক টা নিলো। হাতে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে দেখলেও বোঝার কোনো সুযোগ নেই নিক্ষুত হাতে সিরিঞ্জের সুচ ব্যাবহার করে কোকের ভিতরে বিষ মিশানো হয়েছে। তাই কোকের ক্যান টা খুলে কিছুটা কোক তিনি খেয়ে নিলেন।

সাথে সাথে মজিদের বুকের উপর থেকে বিশাল একটা পাথর নেমে যায়। তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। কাজ হয়ে গেছে এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। ঘুম থেকে উঠে হয়তো জব্বার সাহেব নিজেকে আবিষ্কার করবেন কোনো হাসপাতালের বেড এ শুয়ে আছেন এবং ভাবতে শুরু করবেন কিভাবে তিনি এখানে আসলেন।

Source
মজিদ আড়চোখে জব্বার সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখলেব তিনি পুরো কোক টা শেষ করে ফেলেছে। জব্বার সাহেব তার দিকে তাকাতেই তিনি উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কোকটা খাওয়ার পরই জব্বার সাহেবের চোখে রাজ্যের সব ঘুম চেপে বসলো। তিনি কোনোভাবেই আর তার দুই চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছেন না। তার কাছে লঞ্চের পুরো কেভিনটা ঘোলাটে হয়ে যেতে লাগলো। তিনি তলিয়ে গেলেন ঘুমের মহাসমুদ্রে৷

মজিদ তার কানের কাছে এসে বললো আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকুন। তার জ্ঞান ফিরতে অন্তত বারো ঘন্টা সময় লাগবে৷ তারপর তার হাতে থাকা ঘড়ি, মোবাইল, টাকা, সবার জন্য কেনা জামা কাপড়, যা কিছু ছিলো সব ব্যাগের ভিতরে তুলে ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হয়ে লঞ্চের ডেকে থাকা হাজারো মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেলো৷

শেষ হয়ে গেলো জব্বার সাহেবের পরিবারের সাথে ইদ কাটানো। হারিয়ে গেলো তার কষ্টার্জিত অর্থ। শুধু পড়ে রইলো তার জ্ঞানহীন দেহ।