সার্জারি ওয়ার্ড

in আমার বাংলা ব্লগlast year

surgery-g4f60f60d8_1280.jpg
source
অনেকদিন নিজের পেশাগত ব্যাপার নিয়ে লিখি না। আসলে লিখতে মন চায় না। তবে দীর্ঘদিন পর আজ নিজের ফেলে আসা জীবনের ছোট্ট একটা ঘটনা লিখতে যাচ্ছি।

মূলত সার্জারির ভিতরে অনেকগুলো ভাগ আছে। জেনারেল সার্জারির ব্যাপারে আমি তেমন কোন কথা বলতে চাচ্ছি না। কারণ সেই ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা খুবই সীমিত। তবে ওরাল ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি ওয়ার্ডে যেহেতু দীর্ঘ সময় ডিউটি করে ছিলাম, তাই এই ক্ষেত্রে টুকটাক অভিজ্ঞতা আছে। তবে একটা কথা শুরুতেই বলছি, এই ওয়ার্ডে কিন্তু দাঁতের তেমন কোন চিকিৎসা দেওয়া হতো না। মূলত এই ওয়ার্ডে যে সকল রোগী ভর্তি হতো, তাদের অবস্থা থাকতো অনেকটাই গুরুতর ও আশঙ্কাজনক।

বিভিন্ন দুর্ঘটনায় যারা মুখমণ্ডলে গুরুতর ভাবে আঘাত পেত, যাদের মাড়ি বা চোয়াল ভেঙে যেত বা ট্রমাকেন্দ্রিক অর্থাৎ মুখমন্ডল একদম কেটে ছিঁড়ে শেষ হয়ে যেত , সেই সকল সিরিয়াস রোগীরাই এই সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি হতো।

কত যে জটিল কেস সেই সময় দেখেছিলাম বা পাশে দাঁড়িয়ে থেকে প্রফেসরদের সহযোগিতা করার মতো সুযোগ আমার হয়েছিল, তা এক কথায় বলাবাহুল্য। মেডিকেল কলেজের সামনেই লক্ষ্মীপুর বাজারের কাছেই আমি মেসে থাকতাম। ভালোই সম্মান করতো এলাকার লোকজন। যেহেতু গায়ে সাদা এপ্রোন কমবেশি সব সময় জড়ানোই থাকতো, তাই অনেকেই বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতো।

সার্জারি ওয়ার্ডের প্রথম ডিউটির দিনে যে প্রফেসর আমাদের সবকিছুর তদারকির দায়িত্বে ছিলেন, ভদ্রলোক আমাকে এর আগেও বহুবার দেখেছিলেন। ওয়ার্ডে ডিউটির প্রথম দিনেই আমাকে বলেছিল, অন্যান্য ওয়ার্ডের মত কিন্তু এখানে ঢিলেঢালা কাজ করলে হবে না। যা করতে হবে, অনেকটা বুঝে বুঝে কাজ করতে হবে।

ঐ সময়গুলো যে কি পরিমাণ চাপের ভিতরে কেটেছিল, তা এখনো ভাবলে যেন গা শিউরে ওঠে। দেখা গিয়েছে যে, অপারেশন রুমে ঢুকেছি সেই সকালবেলা বের হতে হতে কখন যে বিকেল হয়ে গিয়েছে বা কখন যে সন্ধ্যা, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তাছাড়া অপারেশন শেষে আবার ওয়ার্ডের ভিতরে ঢুকে রোগীদের কে কাউন্সিলিং করা, তাদের দায়িত্বে আবার নিজেকে ডিউটি ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত করা, ব্যাপারগুলো মোটেও সহজ ছিল না।

এক কথায় বলতে গেলে কি, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের আসলে ইন্টার্নির সময় অনেকটা নাজেহাল অবস্থা হয়ে যায়। কারণ একেক ওয়ার্ডের একেক রকম কাজ।

সেদিন সকালবেলা হসপিটালে ঢুকেছি, সার্জারি ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের চেষ্টা করছিলাম ফলোআপ দেওয়ার জন্য। তারপরে সারাদিন অপারেশন রুমে থেকে ছোট বড় দুইটা অপারেশনে সহযোগিতা করতেই সারাদিন শেষ। শরীর অনেক বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। অপারেশন রুম থেকে বের হয়ে নিজের পরিধেয় কাপড় পড়ে আবারো চেষ্টা করলাম হসপিটালের সামনে চায়ের দোকানে বসে দুধ চা দিয়ে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়ার জন্য।

আজ আর ওয়ার্ডে যাওয়ার জন্য মন টানছে না। তাই সিনিয়র কলিগ কে মুঠোফোনে জানিয়ে দিলাম শরীরটা খুব একটা ভালো ঠেকছে না, কষ্ট করে আজকের দিনটা একটু সামলিয়ে নেওয়ার জন্য । ভদ্রলোকের পক্ষ থেকে অবশ্য কোন না ছিল না। কারণ দেখা গিয়েছে আমরা এইরকম অনেক করেছি, একজনের যখন ঝামেলা হয়েছে তখন আরেক জন বাড়তি দায়িত্ব নিয়েছি।

এমনিতেই সারাদিন যে দুটো অপারেশন হয়েছে সেই রোগীগুলোর চোয়াল ভাঙ্গা ছিল, সেগুলো অপারেশন করে ঠিকঠাক করতেই মোটামুটি আমাদের অবস্থা কাহিল। তারপরে সন্ধ্যাবেলা কেবল একটু বাহিরে বসে থেকে নিজের মত করে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম, তাতেই প্রফেসরের ফোন। তার কোন এক আত্মীয় যেন হঠাৎ করে মোটরবাইক এক্সিডেন্ট করে পুরো মুখমন্ডল থেঁতলে ফেলেছে, অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক দ্রুত হসপিটালের ওয়ার্ডের অপারেশন রুম প্রস্তুত করতে বলল।

dog-g997c080f3_1280.jpg
source

সত্যি বলতে কি, প্রফেসরের ফোন কলে যেন মুহূর্তেই মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। পাউরুটি হাতে নিয়েই দৌড়াচ্ছিলাম ওয়ার্ডের দিকে। হসপিটালের গেটের সামনের কুকুরগুলো আমার পাউরুটি হাতে নিয়ে দৌড়ানি দেখে ঘেউঘেউ করতেছিল। বেশি কিছু করিনি, শুধুমাত্র পাউরুটিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, তাতেই যেন সব কুকুর গুলো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।

যাইহোক সেই রাতটা যে কি পরিমান ঝামেলার ভিতর দিয়ে গিয়েছিল, একদিকে প্রফেসরের পরিচিত রোগী, দ্বিতীয়ত তার মুখের অবস্থা ভেঙ্গেচুরে করুন, তৃতীয়ত তার জন্য আবার অতিরিক্ত রক্ত ম্যানেজ করা লেগেছিল। আবার অন্যদিকে যে সকল রোগী ওয়ার্ডে ভর্তি আছে, তাদের তো খোঁজ খবর নেওয়া লাগতেছিলই।

আমার সিনিয়র কলিগ- আমি, দুজন নার্স আর ওয়ার্ডবয় মিলে অপারেশন রুমে দীর্ঘ সময়ের অপারেশনের মাধ্যমে অবশেষে রোগীকে কিছুটা ভালো অবস্থায় নিয়ে আসা গিয়েছিল। সত্যি বলতে গেলে কি, এই সব অপারেশনের রোগী গুলো অপারেশন হওয়ার পরেও পূর্বের অবস্থায় ফিরতে বহুদিন সময় লেগে যায়। তাদের তো হসপিটালেই দীর্ঘ সময় থাকতে হয়। বলা যায় একপ্রকার তাদের সাথে আমাদের সুসম্পর্কই তৈরি হয়ে যায়।

সার্জারি ওয়ার্ডের কথাগুলো মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। সেদিন যখন সারারাত ডিউটি করে ভোর রাতের দিকে হসপিটাল থেকে বের হচ্ছিলাম, তখনও সেই কুকুরগুলো আমাকে প্রথমে দেখে আবারও ঘেউঘেউ করছিল। তবে যখনই আমি ল্যাম্পপোস্টের উজ্জল আলোর নিচে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, তখন আবার কুকুরগুলো আমার চেহারা দেখে মুহূর্তেই চুপ হয়ে গিয়েছেল।

কুকুর কিন্তু মানুষের মত না। সম্ভবত তারপরে টানা চার মাস সার্জারি ওয়ার্ডে ডিউটি করেছিলাম। মাঝে মাঝে ওয়ার্ডে ঢোকার সময় কুকুর গুলোকে পাউরুটি ছুঁড়ে দিয়ে ছিলাম। তারপরে কোনদিনও আর আমাকে দেখলে ওরা ঘেউঘেউ করেনি। হোক সেটা দিনের বেলা-সন্ধ্যাবেলা অথবা রাত্রিবেলা নতুবা ভোরবেলা। বরং আমাকে দেখলেই ওরা চুপচাপ হয়ে যেত। কেন হতো তা আমি জানি না , তবে এতটুকু বুঝি ওরাই প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে জানে। যা মানুষ করতে জানে না।

Banner-15.png

ডিসকর্ড লিংক
https://discord.gg/VtARrTn6ht


20211003_112202.gif


JOIN WITH US ON DISCORD SERVER

banner-abb4.png

Follow @amarbanglablog for last updates


Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power

250 SP500 SP1000 SP2000 SP5000 SP

Heroism_3rd.png


VOTE @bangla.witness as witness


witness_vote.png

OR

SET @rme as your proxy

witness_proxy_vote.png

Sort:  
 last year 

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা অকৃতজ্ঞ। কিন্তু কুকুরগুলো ঠিক আপনাকে মনে রেখেছে। তাদেরকে যে খাবার দিয়েছেন সেটা তারা ভালোভাবেই খেয়াল করেছে। সার্জারি বিভাগের সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। আসলে ইমারজেন্সি কেসগুলো হ্যান্ডেল করা সত্যি অনেক ঝামেলার ব্যাপার। ভাইয়া আপনার পোস্ট পড়ে অনেক ভালো লাগলো।

 last year 

ধন্যবাদ আপু আপনার সাবলীল মন্তব্যের জন্য 🙏

 last year 

ভাইয়া আপনার পোস্ট পড়ছিলাম আর মনে মনে আপনাকে সেই ডাক্তারের পোশাকে কল্পনা করছিলাম। অনেক ভালোই কাজ করতেন তখন। কেন যে পেশাটা ছাড়লেন সেটাই বুঝতে পারলাম না। তবে এ কথাটি বেশ সত্য যে মানুষের চেয়ে কুকুর অত্যন্ত কৃতজ্ঞ একটি প্রাণী। কিছু পাউরুটি খেয়ে তারা আপনাকে খুব সহজে চিনে নিল। অথচ এমন মানুষ আছে চাইনিজও বহুবার খাওয়ালে সুযোগ পেলে আপনার ক্ষতি করতে দ্বিধাবোধ করে না।

 last year 

অথচ এমন মানুষ আছে চাইনিজও বহুবার খাওয়ালে সুযোগ পেলে আপনার ক্ষতি করতে দ্বিধাবোধ করে না।

যথার্থ বলেছেন আপু।

 last year 

অপারেশন রুমে ঢুকেছি সেই সকালবেলা বের হতে হতে কখন যে বিকেল হয়ে গিয়েছে বা কখন যে সন্ধ্যা, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই।

একজন ভালো ডাক্তারের অনেক ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয়।তাছাড়া মুখের থেতলে যাওয়া ,চোয়াল ভাঙ্গা এগুলো অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ কাজ।যেটা আপনি আপনার ডিউটির সময় বুঝেছিলেন।আসলেই কুকুরদের অনুভূতি আছে তাই তারা সবই বোঝে।ধন্যবাদ ভাইয়া,আপনার জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য।

 last year 

ধন্যবাদ আপু, ব্যাপারটি বুঝতে পারার জন্য। 🙏

 last year 

ভাইয়া, আপনার এই পোস্টটি পড়ে সার্জারি সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারলাম। সব থেকে বেশি ভালো লাগলো যে প্রফেসরদের সাথে আপনার সার্জারি ওয়ার্ডে থাকার সুযোগ হয়েছিল এটা জানতে পেরে। খুবই সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য প্রিয় ভাইয়া আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

 last year 

ধন্যবাদ ভাই আপনার সহজ সরল সাবলীল মন্তব্যের জন্য।

Coin Marketplace

STEEM 0.16
TRX 0.15
JST 0.028
BTC 55885.64
ETH 2358.26
USDT 1.00
SBD 2.31