রুম নাম্বার ৪০২

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago (edited)

Screenshot_20221028-153226_Messenger.jpg

ক্যান্ট পাবলিকের হোস্টেলের ৪০২ নাম্বার রুম, জীবনে আমাকে কি দিয়েছে , এটা বলা বেশ মুশকিল । কি দেয়নি সেটা ভাবাটাই বেশ কঠিন । এই যে শামীম , সুজনের মতো বন্ধু আর তৌফিক ভাইয়ের মতো এমন মানুষ গুলোর সঙ্গে কপাল গুনে পরিচয় হয়েছিল, এটাই তো আমার কাছে বড় প্রাপ্তি ।

আজ যখন বছর কয়েক পরে, নিজের মত করে সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মাঝরাতে ভাবছি, তখন মুহুর্তেই ভিতরটা যেন বেশ নড়েচড়ে উঠেছে । ফেলে আসা দিনগুলো তো আর চাইলেই ফিরে পাওয়া যায় না । তবে মুহূর্তগুলোকে চাইলেই বেশ ভালোভাবেই স্মৃতিচারণ করা যায় ।

ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আর যাইহোক জীবনের গতিপথের সঠিক সূত্র আমার জানা ছিল না ।জীবন কোন দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল, কি হচ্ছিল এসব নিয়ে খুব একটা আহামরি মাথাব্যথা ছিল না আমার। পড়াশুনা আমাকে আসলে অনেক আগে থেকেই টানতো না । ঐযে নিয়ম করে একই জিনিস বারবার পড়া , মুখস্ত করা আর সেইসব মস্তিষ্ক ভরে রাখা , এইসবে সেই সময় থেকেই বেশ কষ্ট হতো আমার ।

আমি আসলে জীবনটাকে , দেখতে ও ভাবতে ভালোবাসি । এই যে আজ যেমন বহুকাল পরে সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছি । সেই মানুষগুলোর কথা চিন্তা করছি , যাদের সঙ্গে জীবনের একটা সময় বেশ ভালো সময় কেটেছিল ।

৪০২ নাম্বার রুম, বাহির থেকে পরিবেশটা একদম ছিমছাম মনেহলেও ভিতরের পরিবেশটা সম্পূর্ণ আলাদা । যে কেউ ঢুকেই যেন ভিন্ন একটা রাজ্যে সহজে চলে আসতে পারবে । আসলে সেই অদ্ভুত পরিবেশটার কারিগর স্বয়ং আমরা নিজেরাই ছিলাম।

যদি আমার দাবার সম্পর্কে টুকটাক হাতে খড়ির কথা বলা যায় , সেই ক্ষেত্রে সুজনের নামটাই আগে আসবে । আমি বুঝে উঠতে পারতাম না, এতো পড়াশোনার ফাঁকে ও কেমনে দাবা খেলতো । সেই ছোট ট্রাঙ্কে গোয়েন্দা সিরিজের সব বই আর একদিকে ভর্তি বাহারি রকমের বিস্কুট-চানাচুরের প্যাকেট দিয়ে। আর এককোণায় ছোট্ট একটা দাবার বক্স , গুটি গুলোতে আবার চুম্বক লাগানো আছে ।

পড়াশোনাতে আমার মন থাকতো না বললেই চলে । তবে আমার মন গিয়ে থাকতো সেই ট্রাঙ্কের ভিতরে । গোয়েন্দা সিরিজের সব বই ও বিস্কুটের প্যাকেট গুলোর প্রতি যেন আমার আলাদা একটা নজর থাকতো । এটা যদিও সুজন বুঝতো , ও শুধু আমাকে বলতো , তুই আমার সঙ্গে রোজ দাবা খেলবি আর আমি তোকে বিস্কুট খাওয়াবো ।

জানালার পাশের যে বিছানাটা তাতে ছিল তৌফিক ভাই । তার পাশের বিছানায় সুজন, মাঝখানে আমি আর তার পাশে শামীম ।
রাত কিংবা দিন, কোনই চিন্তা নেই । আমাদের যখন যা মন চাইতো ঠিক সেই ভাবেই চলতো সময়গুলো । কি করিনি সেই সময়, রাতের বেলাও ঘরের ভিতরে শর্টপিচ খেলাধুলা, পিকনিক, লাফালাফি-ঝাঁপাঝাঁপি আর সকালবেলা যখন স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে যেত । ঠিক সেই সময়ে বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে , খাটের নিচে ঢুকে যেতাম আর সেখানে তৈরি হতো আলাদা একটা অঙ্গরাজ্য । যেটা বাহির থেকে ভুলেও বোঝার কোন উপায় ছিল না । হোস্টেল থেকে মাঝে মাঝেই চেকিং হতো , কে স্কুলে যাচ্ছে আর কে যাচ্ছে না এই সব বিষয়ে ।

ঐ হলদে রঙের ভবনটাতে আমি মনেকরি যারাই থেকেছে, তাদের মাঝেই কিছু ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা আছে বা তারা নিজেরাই ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে । পুরো হোস্টেল ভর্তি স্কুল কলেজ পড়ুয়া নবীন কিছু প্রাণ । তাই সেখানে আসলে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক । একেকটা রুম যেন ছিল একেকটা অভিজ্ঞতার ভান্ডার ।

ছিপছিপে গরনের হালকা পাতলা লম্বা ছেলেটা দাঁড়িয়ে থেকে যখন ব্যাটে বল লাগিয়ে দৌড় দিচ্ছিল, অপর প্রান্ত থেকে বল করছিলাম আমি নতুবা শামীম । আমার তো এখনো মনে আছে , সেই সময়ে যদি তৌফিক ভাই বা সুজনের নিজস্ব ব্যাট বল না থাকতো, তাহলে হয়তো বিকেলবেলা করে ক্রিকেট খেলাটা চালিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যেত ।

এত নিয়মকানুনের জীবন আমার আসলে ভালো লাগতো না । বিশেষ করে পড়াশোনার ক্ষেত্রে , সেই ছোটবেলা থেকেই ঘাটতি ছিল । আমার আসলে পড়াশোনার থেকেও বেশি ভালো লাগতো, সেই দুরন্তপনা জীবন গুলো দেখতে ও সেগুলো নিয়ে ভাবতে । অতঃপর বাড়িতে বলেই দিলাম আমাকে দ্বারা এখানে আর পড়াশোনা হবে না । তোমরা যত তাড়াতাড়ি পারো, এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো ।

তাই মাঝপথেই ক্যান্ট পাবলিক থেকে বিদায় । ক্যান্ট পাবলিক আমাকে কি দিয়েছে , এটা বলাবাহুল্য । আর যদি সেই হোস্টেলের কথা বলতেই হয় , তাহলে শামীম সুজনের মতো বন্ধু আর তৌফিক ভাইয়ের মত বড় ভাই । একবার সে কি কড়া শাসন, শুধু যে আমাকে একাই শাসন করেছিল তা কিন্তু না । বারান্দাতে দাঁড় করিয়ে রেখে মোটামুটি সুজন আর আমাকে বেশ ভালই শাসন করেছিল সেবার তৌফিক ভাই ।

আমি খুব দ্রুতই ইতি টেনে ছিলাম ৪০২ নাম্বার রুমের । তবে সেই রুমের স্মৃতিগুলো এখনো আমাকে বেশ ভালোই ভাবিয়ে তোলে । জীবনে কখনো ভূত দেখিনি , তবে ভূত সেজে যে মানুষকে ভয় দেখানো যায় , সেরকম মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিলাম সেই রুমেই ।

কতটা বছর দেখতে দেখতে চলে গেল । মাঝে যদিও একবার সেই মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেই বগুড়া শহরে । তখন সম্ভবত কলেজ পড়ুয়া ছাত্র আমরা আর সেই সময় তো তৌফিক ভাই মেরিনে চাকরি করতো । সুজন তো সেবার ঘটা করেই বলল , সন্ধ্যাবেলা শামীমের মেসে আসিস , তৌফিক ভাই আসবে ।

সময় কি শুধু পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন করে দেয় , এমনটা যদি ভাবা যায় তাহলে মনে হয় সেটা নিতান্তই ভুল হবে । সময় আসলে শারীরিক গঠনের পরিবর্তনেও বেশ ভূমিকা রাখে । সেই সন্ধ্যায় আমি তৌফিক ভাইকে দেখে সম্পূর্ণ অবাক । হালকা ছিপছিপে গরনের মানুষটা কত শক্তপোক্ত হয়েছে , দিনরাত এখন সে জাহাজে সময় কাটায় । কখনো এই বন্দর নতুবা দেশ বিদেশের বন্দরে ।

আবারো দীর্ঘ সময়ের বিরতি । সেদিন যখন মেসেঞ্জারে কথা হলো সুজনের সঙ্গে। তখন আমি নিজেই বাবা হয়ে গিয়েছি । এখন আমার ঘরে বউ-বাচ্চা আছে । তবে ওদিকে সুজন এখনো একাই থেকে গিয়েছে । যখন তৌফিক ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলাম । সে এক কথায় বলল , ভাইয়া আর মেরিনে নেই । সেবার সুজনের কাছ থেকে তৌফিক ভাইয়ের সোশ্যাল মিডিয়ার আইডি লিংকটা নিয়ে ছিলাম । অতঃপর রিকোয়েস্ট দিয়ে সঙ্গে ছোট্ট একটা খুদেবার্তা পাঠিয়ে দিলাম । ভাই আমি সেই শুভ, যাকে আপনি ভূতের ভয় দেখিয়ে ছিলেন ।

কদিন বাদেই রিকোয়েস্ট একসেপ্ট হয়েছিল । তারপর ভেবেছিলাম যে কথা বলব কিন্তু কিভাবে কথা শুরু করব, সেটাই আসলে ভেবে উঠতে পারছিলাম না । এমনিতেই বয়সে বড়, তার ভিতরে আবার বন্ধুর বড় ভাই । তবে একদিক থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে , সে আগে থেকেই বেশ আন্তরিক । হয়তো সেই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করেই, পরবর্তীতে আলাপচারিতা হয়েছিল।

অপরপ্রান্ত থেকেও বেশ ভালই সাড়া দিয়েছিল তৌফিক ভাই । টুকটাক কথা হয়েই গেল , ভালোই লাগলো , সে আগেও যেরকম সঠিক কথাবার্তা বলে উপদেশ দিত এখনো ঠিক সেভাবেই কথা চালিয়ে গেল । সে আর মেরিনে নেই , সে আসলে নিজের মতো করে জীবনটাকে দেখার চেষ্টা করছে ঐ দূর প্রবাসে থেকে ।

আজ হয়তো বন্ধু শামীম সুজন আর তৌফিক ভাই কেউ আমার পাশে নেই । তবে চাইলেও একত্রিত হওয়া খুবই কষ্টসাধ্য । তবে মাঝরাতে যখন ভাবছি সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা , সেই রুমের কথা তখন যেন আধ্যাত্মিক প্রশান্তি পাচ্ছি ।

আর কখনো দেখা হবে কিনা সেই মানুষগুলোর সঙ্গে তাও জানিনা । তবে চাই ভালো থাকুক সেই মানুষগুলো । কারণ তারা আমার শৈশব স্মৃতির অনেকটা অংশ জুড়ে আছে ।

ভালো থাকিস শামীম, সুজন আর ভালো থাকবেন তৌফিক ভাই , ঐ দূরপ্রবাসে ।

Banner-3.png

ডিসকর্ড লিংক:
https://discord.gg/VtARrTn6ht


20211003_112202.gif


JOIN WITH US ON DISCORD SERVER

banner-abb4.png

Follow @amarbanglablog for last updates


Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power

250 SP500 SP1000 SP2000 SP5000 SP

Heroism_3rd.png


VOTE @bangla.witness as witness


witness_vote.png

OR

SET @rme as your proxy

witness_proxy_vote.png

Sort:  
 2 years ago 

ভাইয়া আপনার হোস্টেল জীবনের রুম নাম্বার ৪০২ এর স্মৃতি পড়ে নিজের স্টুডেন্ট লাইফের অনেক স্মৃতি মনে পরে গেল। আমার মনে হয় সবার জীবনেই এমন কিছু বন্ধু আর বড় ভাইয়া থাকে যাদেরকে আমরা চাইলেও ভুলতে পারি না। আপনি তাহলে সেই সেভেন থেকেই হোস্টেল জীবন কাটিয়েছেন। অনেজ মজার ছিল আপনার লাইফটা। পড়ে ভালই লাগলো। শামীম, সুজন আর তৌফিক ভাইয়ের জন্য শুভ কামনা রইল। ধন্যবাদ ভাইয়া।

 2 years ago 

অনেক ভাল লাগলো ভাইয়া আপনার ফেলে আসা অতীতের কিছু অংশ পড়ে। এক সময় যে মানুষগুলো এতটা কাছে ছিল, তারা আজ কোথায়, কতদূরে তাই না? আমিও এমনটা ভাবি, হয়ত তাদের সাথে আর কখনও দেখাও হবে না। তবুও মনে মনে খুঁজি আর মাঝ রাতে ঘুম না আসা রাতে সেই স্মৃতি ভেবে প্রশান্তি খুঁজি। অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া শেয়ার করার জন্য। অনেক শুভকামনা ভাইয়া আপনাকে।

 2 years ago 

হুম এইটা সত্য যখন মাঝে মাঝে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণ করা যায় , তখন ভিন্ন রকম একটা প্রশান্তির সঞ্চারণ হয় নিজের মাঝে । ধন্যবাদ আপনার সাবলীল মন্তব্যের জন্য।

 2 years ago 

ভাইয়া আপনার ৪০২ নম্বর রুমের স্মৃতিচারণ এর সাথে সাথে আমিও বারবার আমার শৈশবে ফিরে যাচ্ছিলাম। শৈশবের সময়টা আসলেই অন্যরকম ছিল। তখন মনে হতো যে এসব খুব কষ্টকর । কিন্তু এখন মনে হয় যে ওই সময়টাই খুব ভালো ছিল। অনেক সময় এমন হয় যে খুব পরিচিত কারো সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকলে হঠাৎ করে কি দিয়ে কথা শুরু হবে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। যাক অপরপ্রান্ত থেকে তৌফিক ভাইয়ের ভালো সাড়া পাওয়ার কারণে নিশ্চয়ই আলাপ অনেক হয়েছে। ভালো লাগলো লেখাগুলো পড়ে।

 2 years ago 

দীর্ঘ সময় আলাপ হয়েছিল আপু । যেহেতু দূর প্রবাসে থাকে সেখানকার জীবন যাত্রার সম্পর্কেও শুনে ছিলাম আপু । ধন্যবাদ আমার অনুভূতি বোঝার জন্য আপু ।

Coin Marketplace

STEEM 0.19
TRX 0.16
JST 0.034
BTC 64333.84
ETH 2760.35
USDT 1.00
SBD 2.65