শেফালি | (১০% পেআউট লাজুক খ্যাঁক)
আজ থেকে প্রায় ৮-৯ বছর আগের কথা। তখন আমি কেবল ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। স্কুল শেষে বাসায় এসে কলিং বেল টিপতেই গেট খুলে দিল ৮-১০ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। আমি অবাগ হয়ে তাকাতেই চোখ বড় বড় করে বলতে শুরু করল- "আমার নাম শেফালি। বাপে সবজি বেঁচে, মায় কাম করে, বাড়ি ময়মনসিংহ, ছোট একটা ভাই আছে, নাম রাসেল, শিয়ালবাড়ি থাকি। আপনার মায়ে আমারে লইয়া আইছে, আপনার বোনের লোগে খেলার লাইগা।" বলেই উধাও হয়ে গেল। আবার কোথা থেকে এসে বলল- "আপনার মায়ের মাথা ধরছে, ওই রুমে যাওয়া মানা। পা ধুইয়া ঘরে যান।" এবার আমার সত্যিই রাগ উঠে গেল। স্কুলের ব্যাগ ফেলে মাকে গিয়ে বললাম, এই জিনিস কোথাথেকে আমদানি করলে? এক্ষুনি বিদায় কর। মা হেসে আমাকে বললেন মেয়েটা খুব ভালো রে! রোজ ওর মায়ের সাথে এসে টিচার্স রুমে বসে থাকে। ভাবলাম নিয়ে আসি, মেয়েটাও ভালো থাকবে , রিমঝিমেরও একটা সঙ্গী হবে। তবে মা যাই বলুক আমার কিন্তু ওকে একেবারেই সহ্য হলো না।
পরদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে দেখি ও ছবি আঁকবে বলে আমার নোট খাতার পৃষ্ঠা তেলে ভিজিয়েছে। সেই তেলে ভেজা কাগজ আবার আমার সমাজ বইয়ের উপর রেখে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকতেছে। আমি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুললাম। আমার মায়েরও যেমন কান্ড, পরদিন ওর জন্যে এক বাক্স রঙ আর একটা ছবি আঁকার খাতা নিয়ে এলেন। আমার কেবলই মনে হতে লাগল ও বুঝি অচিরেই আমার জায়গা দখল করে নেবে। পরের সপ্তাহে কোচিং এর অংক পরীক্ষায় ১০০ তে পেলাম ৮। বাবা আমার সব বই খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। রাগে আমার শখের রেকেটও ভেঙে ফেললেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কেও ভাতও খেতে ডাকল না। অনেক রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার টেবিলের উপর একটা কাগজ। খুলে দেখি আসলে ওটা একটা ছবি, দেখতে পেলাম এক গোঁফধারী লোক এক হাতে একটা ভাঙা রেকেট ধরে রেখেছে, আরেক হাতে একটা ছোট ছেলের কান ধরে রেখেছে। ছেলেটা কাঁদছে। বুঝতে পারলাম আমার ছবি আঁকছে। আমি রাগ করেও কেন যেন আবার হেসে ফেললাম। পরদিন জিজ্ঞেস করলাম কিরে বড় হয়ে আর্টিস্ট হবি নাকি?
ও মাথা নাড়ল।
-"না।"
-তাহলে?
-"ডাক্তার আপা হমু।"
-তারপর কি সবাইকে মাগনা চিকিৎসা করবি ?
ও বড় মানুষের মত মুখ করে বলল, "না,কিন্তু মাগনা সিভিট দিমু সবাইরে।" আমি হো হো করে হেসে উঠলাম সেই সাথে আবিষ্কার করলাম ও যেন ঠিক আমার ছোট বোনের মতোই বাঁকা করে কথা বলে। কিছুদিন পরে ওকে আমার বোনের স্কুলেই ভর্তি করানো হল। আমার বার্ষিক পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তবে দেখতাম রোজ সকালে দুজনে মিলে স্কুলে যায়। মাঝে মাঝে আমার জন্য ঝালমুড়ি আনে।
এর মধ্যেই একদিন গেলাম জাতীয় বৃক্ষ মেলায়। গিয়ে দেখি ওদের কাছে শেফালি ফুলের গাছ আছে। কি মনে করে যেন কিনে ফেললাম একটা গাছ। নিজের নামের গাছ পেয়ে শেফালির খুশি আর কে দেখে। বলাই বাহুল্য, ওর যত্নেই গাছটির শ্রী ফিরে আসছিল। এরপর একদিন হঠাৎ স্কুল থেকে ফিরে এসে শুনলাম ওকে নাকি ওর মা গার্মেন্টস এ ঝুট কাপড় কুড়ানোর জন্য নিয়ে গেছে। পরে নাকি ওরা ভাল চাকরি দেবে। শেফালি নাকি কেঁদেছিল, তবুও ওর মা ওকে নিয়ে গেছে। কেন জানি না আমার একটু মন খারাপ হল। বাসাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রুমে এসে দেখে ওর ড্রয়িং খাতার ফুল লতা পাতা আঁকানোর কয়েকটা পৃষ্ঠা। আমার মনটা অনেক বেশি খারাপ হয়ে গেল। অদূরেই শেফালি গাছটায় প্রথম কলি এসেছে। আমার কেবল মনে পড়ল ও বেচারি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলেন। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বললেন তাজরিন ফ্যাশন নামের এক গার্মেন্টস এ আগুন লেগেছে। টিভি খুলে দেখলাম লাশের সারি। মা খবর আনলেন সেখানে শেফালিও ছিল। এতো মৃত্যু, এতো হাহাকার তবুও আমি স্বার্থপরের মতো প্রার্থনা করলাম, হে সৃষ্টিকর্তা! তুমি শেফালিকে বাঁচিও, না পরম করুণাময় আমার কথা শুনেন নি। হাজারো নাম না জানা লাশের সাথে পুড়ে ছাই হয়ে মিশে গেছে আমাদের শেফালি। ধূসর ধুলো হয়ে উড়ে গেছে দীর্ঘশ্বাসের সাথে।
গতকাল ছাদে উঠে দেখি, অসময়ে শেফালি গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। রুপালি নক্ষত্রের এক গুচ্ছ শুভ্র পবিত্রতা নিয়ে ফুটে আছে শেফালি। ভালো থাক, ও ওখানেই ভালো থাক।
গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে কাল্পনিক চরিত্র দিয়ে লেখা। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার তাজরিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে আগুন লেগে কমপক্ষে ১১৭ জন কর্মী মারা যান এবং ২০০ জন আহত হন যেটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক কারখানায় আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার মধ্যে প্রথম।
ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্য।🙏🙏 ভালো লাগলে অবশ্যই কমেন্ট করে আপনার অনুভূতি জানাবেন।💖💖
অনেক সুন্দর লিখেছেন ভাই সবার জন্য দোয়া করি আল্লাহ যেন সবাই কে বেহেস্ত নসিব করুন আমিন
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।💖
আপনার জন্য শুভকামনা রইলো ভাইয়া 🥀
খুবই মর্মান্তিক হৃদয় বিতরক একটি ঘটনা,আল্লাহ যেন সবাইকে ধৈর্য ধারন করার তৌফিক দান করেন
ধন্যবাদ ।💖
সত্যি ,এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার গল্প।কিন্তু ভাইয়া আমার জানতে ইচ্ছে করছে, সত্যিই কি শেফালী নামে কোনো মেয়ে আপনাদের বাড়ি ছিল।আমি বিস্মিত!ধন্যবাদ আপনাকে।
না। শেফালি চরিত্রটি কাল্পনিক কিন্তু ঘটনাটি সত্য। একটা গল্প লিখার প্রচেষ্টা। 😅😅😅