হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলা || পর্ব ১ - ষাঁড় দৌড় ||

in আমার বাংলা ব্লগ8 days ago (edited)

আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন আছেন আপনারা? আমি গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী কয়েকটি খেলা নিয়ে একটি সিরিজ লেখার পরিকল্পনা করেছি যেখানে আমি পুরোপুরি বিলুপ্ত কিংবা বিলুপ্তপ্রায় খেলা নিয়ে আলোচনা করব। আজকে থাকছে প্রথম পর্ব যেখানে আমি কথা বলব ষাঁড়ের দৌড় প্রতিযোগিতা খেলা নিয়ে।

KeralaBullSurfing.jpg

Source with License

নাম ও সময়

ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলাদেশ ক্রীড়াপ্রিয় একটি জাতি। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘিরে আছে কৃষকদের নিয়ে। আমরা এখনও কৃষি নির্ভর জাতি। আধুনিক প্রযক্তির মেশিন আসার আগেও আমরা কৃষির জন্য গরুর উপর নির্ভরশীল ছিলাম। যখন কৃষকের হাতে কোন কাজ থাকত না, এবং গরু দিয়ে করানোর মত হালচাষেরও প্রয়োজন হয়নি তখনই এই খেলার আয়োজন করা হত। অর্থাৎ, এক ফসল তোলার পর আরেক ফসল বুনার আগে যে সময়টা পাওয়া যেত তখনকার কোন সময়ই এই খেলার আয়োজন করা হত।

উপকরণ

যেহেতু খেলাটিই গরু-ভিত্তিক এজন্য অবশ্যই গরু লাগত। যেনতেন গরু না, লাগতো শক্তিশালী এবং খুব দ্রুত দৌড়াতে সক্ষম এমন কয়েকটি ষাঁড়। বেশির ভাগ প্রতিযোগীই একজোড়া ষাঁড় নিয়ে নিজের দল বানাতেন। ষাঁড়গুলোর গলায় রশি বেঁধে পিছনে নিয়ে যাওয়া হত আর সেখানে একটি জমি চাষের মই বাঁধা থাকত যেখানে মূল খেলোয়াড় দাঁড়িয়ে ষাঁড়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড় একসাথে তিনটা বা চারটি ষাঁড় নিয়েও প্রদর্শনীতে নামত। তবে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সকলেরই সমান ষাঁড় নিয়ে নামতে হত।

কোথায় অনুষ্ঠিত হত, কখন হত

বিরান জমিতে এই খেলা অনুষ্ঠিত হত। ঠিক বিরান বলাটা অনুচিত। কারণ, খেলাটি ফসলী জমিতেই হত, কিন্তু তখন ফসল বোনা হতনা। বর্ষায় হালচাষের আগে জমিতে পানি থাকা অবস্থায় কিংবা শীতে হালচাষের পর এই খেলার আয়োজন করা হত। মাঠের আকার হত বেশ দীর্ঘ। কখনও কখনও সেটা এক মাইলব্যাপীও হত। আমি যতবার গিয়েছি, মোটামুটি অর্ধ কিলোমিটার প্রতিযোগিতা দেখেছি। কিন্তু বয়স্কদের কাছে শুনেছি এক মাইল হত আগেরকার দিনের জনপ্রিয় প্রতিযোগিতাগুলো।

প্রতিযোগিতা

বেশ কয়েকজন দৌড়বিধ তাদের ষাঁড় নিয়ে দৌড়ে অংশ নেয়। আগেরদিনে ১০জন বা তারও বেশি প্রতিযোগি অংশ নিত। কিন্তু এখন আর এই প্রতিযোগিতাই নেই। কোথাও হলে দেখা যায় ২, ৩ জন অংশ নিচ্ছে। মূল প্রতিযোগী মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে ষাঁড়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। ষাঁড়ের সামনে থাকে একজন। প্রথম দিকে ষাঁড়গুলোকে ক্ষেপিয়ে দেওয়া থাকে তার কাজ। এরপর ষাঁড় পুরোদমে দৌড়াতে শুরু করলে তিনি সরে যান। এই দুইজন খেলোয়াড়কেই অত্যন্ত দক্ষ হতে হয়। কারণ সামান্য ত্রুটির জন্য হতে পারে ভয়ানক রকমের দুর্ঘটনা। প্রাণে মারা যাওয়াও অসম্ভব কিছু নয় এক্ষেত্রে।

আয়োজন

আগেকার দিনে জমিদার ও মোড়লরা এসবের আয়োজন করত। বর্তমানে যেহেতু জমিদারি প্রথা নেই তাই স্থানীয় নেতৃত্ব কিংবা ক্রীড়ামোদীরা আয়োজন করে থাকে কালে ভদ্রে। তারিখ আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। চারদিকে চলে প্রচারণা। খেলার দিন উৎসুক জনতার আগমনে মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। দর্শককে আনন্দ দেয়ার জন্য খেলোয়াড়েরা আগেই নিজেদের ষাঁড়গুলোকে নিয়ে একটি প্রদর্শনী দৌড় দিয়ে থাকে। নিজেদের প্রস্তুতিও হয়, মানুষও খুশি হয়। ষাঁড়ের খুর, মই, রশি সবকিছুই শেষবারের মত পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। খেলোয়াড় দুইজনও মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নেয়। কারণ সবাই জানে কতটুকু রিস্কি এই খেলা!

এক সময় শুরু হয় খেলা। এই খেলা যারা নিজ চোখে দেখেছেন তারা জানেন এর অনুভূতি। যতবারই আমি দেখেছি, একদম শুরুতে দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে, চিৎকার করে খেলোয়াড়দের সমর্থন ইত্যাদি দেয়া হয়। যখনই রেস শুরু হয় আর ষাঁড়গুলো মোটামুটি মাঝপথে চলে আসে, সবার মধ্যেই এক ভিন্ন উত্তেজনা কাজ করে। সবাই চুপ হয়ে অন্য এক উৎকণ্ঠায় থাকে! কি হয় কি হয়! ষাঁড় তো ছুটছেই। খুবই তীব্র বেগে। যেন চোখে ধুলো দিয়ে পালাচ্ছে! একসময় সব শান্ত হয়ে যায়। স্তিমিত মানুষ যেন আবার জেগে ওঠে। অন্য রকম এক অনুভূতি! আপনি যদি কখনও না দেখে থাকেন, তবে কখনই অনুভব করবেন না শেষ মুহূর্তে একজন দর্শক হিসাবে কি অনুভূতি হয়! খেলোয়াড়দের কথা বাদই দিলাম।


পাঠক, এই ছিল গ্রাম-বাংলার এক ঐতিহ্যবাহী খেলা ষাঁড় দৌড় নিয়ে আমার আলোচনা। কেমন লাগলো তা অবশ্যই জানাবেন। আগামী পর্বে আলোচনা করব অন্য কোন বিলুপ্তপ্রায় খেলা নিয়ে। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ্য থাকবেন এই কামনা রইল।


আমার সম্পর্কে
আমি মুহাম্মদ সাব্বির আকিব। জন্মসূত্রে একজন বাংলাদেশি। জেলাঃ চাঁদপুর, থানাঃ ফরিদগঞ্জ। থাকি ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানাধীন দক্ষিণ গাজীরচট নামক স্থানে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রসায়নে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেছি। বর্তমানে একটি ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট হিসাবে কর্মরত রয়েছি। বিবাহিত এবং আল্লাহ একটি পুত্র সন্তানের জনক করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
Sort:  
 8 days ago 

আসলে এই খেলা গুলো আগে আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে হতো। তবে সময়ের কারণে এখন আর এই সমস্ত খেলা গুলো লক্ষ্য করা যায় না। সেই শ্রেণীর মানুষগুলোই আর সমাজে তেমন একটা নেই বলে চলে। তবে এই খেলা গুলো আমাদের ঐতিহ্য বজায় রাখতো।

 8 days ago 

ঠিক বলেছেন ভাই।

 5 days ago 

WOW! Thank you.

Coin Marketplace

STEEM 0.18
TRX 0.14
JST 0.029
BTC 60385.18
ETH 2658.57
USDT 1.00
SBD 2.47