রহিমের জীবন এবং সর্বনাশা পদ্মা নদী (গল্প-১ম পর্ব)। ১০% প্রিয় লাজুক খ্যাঁক এর জন্য।
রহিম একমনে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। কি দেখছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। সে প্রায়ই এমন নদীর পাড়ে বসে থাকে। এলাকার লোকজন মনে করে রহিম নদী খুব ভালোবাসে তাই এভাবে নদীর পাড়ে বসে থাকে। ও কথা বলে খুবই কম। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ও কারো সাথে কথা বলে না। আসলেই নদীর দিকে তাকিয়ে সে তার পুরনো দিনের কথা মনে করছে। এই নদীর কাছে তার অনেক প্রশ্ন। নদীর এই শান্ত রূপ দেখে সে অবাক হয়ে এটা চিন্তা করছে। ভরা বর্ষায় এই নদী এমন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে কিভাবে। নিমিষের ভিতর মানুষের জীবন ধ্বংস করে দেয়।
রহিম এখন পুরোপুরি একা। একটা সময় তাদের একটা সুখী পরিবার ছিল। সচ্ছলতা হয়তো ছিল না কিন্তু চমৎকার একটা পরিবার ছিল তার। মা ছিলো, বাবা ছিল, ভাই ছিল, বোন ছিল। এখন সে পুরোপুরি একা। সর্বনাশা পদ্মা নদী তার কাছ থেকে সব ছিনিয়ে নিয়েছে।
তারা ছিল ৩ ভাই বোন। রহিমের বাবা চরে কৃষি কাজ করতো আর অবসরে নদীতে মাছ ধরতো। সংসারে স্বচ্ছলতা না থাকলেও মোটামুটি ভাবে দিন চলে যাচ্ছিল। অন্য আর দশটা সংসারের মতো তাদের সংসারেও হাসি কান্না দুঃখ সবই ছিল। জায়গা জমি রহিমের বাবার তেমন ছিল না। সে অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করত। জমি বলতে শুধু ভিটাটাই ছিল। সেখানে মোটামুটি ভালই তাদের দিন চলে যাচ্ছিল। রহিম চরের একমাত্র প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা করতো। পড়ালেখা আসলে খুব একটা হোতো না। সেখানে বন্ধুদের সাথে মারামারি আড্ডাবাজি এগুলোই বেশি চলত।
তার পরেও স্কুলে যাওয়ার কারণে সে পড়তে শিখেছে লিখতে শিখেছে। এটা নিয়ে তার বাবা-মার অনেক গর্ব ছিল। কারণ তারা দুজনই নিরক্ষর। রহিম তার বাবার কাছ থেকে অনেক রকম গল্প শোনে। কখনো গভীর রাতে নদী থেকে মাছ ধরার গল্প, কখনো নদী ভাঙ্গনের গল্প, কখনো ভুতের গল্প। কিন্তু তার কাছে সবচাইতে ভয়ের গল্প মনে হোতো নদী ভাঙ্গনের গল্প।
যদিও এর আগে সে কখনো নদী ভাঙ্গন দেখেনি তেমনভাবে। দু'বছর আগে যখন তাদের চরে ভাঙ্গন শুরু হল। তখন হঠাৎ সে বুঝতে পারল নদী ভাঙ্গন সে যতটা ভয়াবহ মনে করেছিল আসলে তার থেকেও অনেক বেশি ভয়ানক। তাদের চরের লোকজনের মুখে তখন দিনরাত একই কথা। সবাই শুধু নদী ভাঙ্গন নিয়ে আলাপ করছিল। এলাকার মুরুব্বিরা প্রতিদিন চেয়ারম্যানের কাছে যেত ভাঙ্গন ঠেকানোর ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করার জন্য। চেয়ারম্যান তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিল যাতে ভাঙ্গন রোধ করার একটা ব্যবস্থা করা যায়। কারণ নদীভাঙনে তারো ক্ষতি হবে।তার এলাকার ভোটার কমে যাবে। যার ফলে সে অনেক চেষ্টা করেছিল নদী ভাঙ্গন ঠেকানোর। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ভয়ঙ্কর সর্বনাশা পদ্মা নদীর প্রবল আক্রোশের কাছে কোনো বাধাই টেকেনি।
একবার শুধু সরকারি দপ্তরের কিছু লোক এসে কয়েক ট্রলার বোঝাই বালির ব্যাগ পানির ভিতর ফেলে চলে যায়। যদিও এলাকার লোকজন তাদের কে বলেছিল অন্য জায়গায় বালির ব্যাগ ফেলতে। কিন্তু তারা তাদের কথায় কর্ণপাত করেনি। রহিম প্রতিদিন নদীর পাড়ে যেত দেখতে যে নদী ভাঙ্গন তাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে আর কতদূর আছে। শুধু সেই না এলাকার অনেকেই যেত এটা মাপার জন্য। রহিম তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অনেকেই তাদের বাড়িঘর ছেড়ে শহরের দিকে চলে যাচ্ছে। তাদের চোখের সামনেই অনেকের বাড়িঘর মুহূর্তে নদীর ভিতর চলে যাচ্ছিল। এটা দেখে রহিম শিউরে ওঠে। তার শিশুমনে প্রবল ভয়ের সঞ্চার হয়।
সে চিন্তা করতে থাকে যদি তাদের এভাবে চলে যেতে হয়। তাহলে তারা কোথায় যাবে? সেখানে কি এত সুন্দর পরিবেশ পাবে থাকার জন্য? সে লোকজনের মুখে শুনেছে শহরের পরিবেশ নাকি খুবই খারাপ। চারপাশে শুধু লোকজনের ভীড় আর ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধ। এজন্য সে কখনোই শহরে যেতে চায়না। তাছাড়া তার বন্ধু-বান্ধব সবাই তো এখানেই থাকে। সে তাদেরকে ছেড়ে কোথায় যাবে?
রহিম তার বাবা-মার ভেতরেও একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করে। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না যে কি করবে। কারণ রহিমের বাবা কৃষিকাজ ছাড়া আর অন্য তেমন কোনো কাজ পারে না। কিন্তু শহরতো কৃষিকাজের কোনো সুযোগ নেই। শহরে যে ধরনের কাজ আছে সে কাজ সে করতে পারবে না। রহিমের বাবা-মা একমনে শুধু আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে যেন নদী ভাঙ্গন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু রহিমের বাবা ঠিকই বুঝতে পারছিল যে ভাঙ্গন এবার থামবে না। পুরো চরকে গ্রাস করে নেবে।
রহিমের স্কুল থেকে নদীভাঙ্গন অনেকটা দূরে ছিলো। সেটা সে গতকাল ও দেখে এসেছে। কিন্তু পরদিন সকালে সে গিয়ে দেখে স্কুল আর নেই। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। এই দৃশ্য দেখে রহিমের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। মনে হয় সে নড়াচড়া শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তারপর সে এক দৌড়ে বাড়িতে এসে তার মাকে বলে মা স্কুল নদীর ভেতর চলে গিয়েছে। ওর মা ওর কথা বিশ্বাস করে না। বলে চলতো গিয়ে দেখে আসি। সেও এ দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যায়। প্রচন্ড ভয়ে তার মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তখন রহিমের মা নিশ্চিত হয়ে যায় যে আর দুই তিন দিন এর ভেতরেই তাদের বাড়ি ও নদী গর্ভে হারিয়ে যাবে। একমাত্র মাথাগোঁজার ঠাঁই হারানোর চিন্তায় রহিমের মা একদম মুষড়ে পড়ে। (চলবে)

Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power
250 SP | 500 SP | 1000 SP | 2000 SP | 5000 SP |

🇧🇩🇧🇩ধন্যবাদ🇧🇩🇧🇩
আমি রূপক। আমি একজন বাংলাদেশী। আমি বাঙালি। আমি বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করতে ভালোবাসি। আমি আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটিকেও ভালোবাসি।
ভাইয়া আপনার পোষ্টটি পড়ে আমার অনেক খারাপ লেগেছে ।সত্যি নদীভাঙ্গন দুর্যোগ কিন্তু এটি মোকাবেলা করা অসম্ভব যদিও আমরা সে রকম কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনা প্রশাসনকে ।নদী ভাঙ্গনের ফলে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ,অসহায় হয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ ,হাজারো পরিবার
নষ্ট হচ্ছে স্কুল-কলেজ মসজিদসহ গরীব অসহায় মানুষদের বাড়িঘর ।তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে যাচ্ছে। রহিম সর্বনাশা পদ্মা দিকে তাকিয়ে সে সবই ভাবে শুষ্ক মৌসুমে পদ্ম বৃদ্ধ কিন্তু বর্ষা মৌসুমে ভরা যৌবন প্রাপ্ত হয় সবকিছু গ্রাস করে নিচ্ছে। পর্দার ভয়াল থাবায় স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় কেননা তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে চলে যায়। তারা তাদের চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে তাদের বাড়িঘর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নদীগর্ভে চলে যাবে ।তারা চিন্তায় পড়ে যায় কিভাবে কোথায় যাবে তারা? আসলে বাস্তবতা এমনই কখন কার জীবনে কি নেমে আসে আমরা কেউ জানিনা। ভাই আপনি নদীর এলাকার মানুষদের নিয়ে সুন্দরভাবে বাস্তব ঘটনা তুলে ধরেছেন
।আশা করছি পরবর্তী পোস্টে আরো কিছু জানতে পারবো ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ আপনাকে আপু।
সত্যিই এটি খুবই খারাপ লাগছে রহিমের একটি সুখী পরিবার ছিল এবং সর্বনাশা পদ্মা নদী তার কাছ থেকে পুরোপুরি ছিনিয়ে নেয়।সত্যিই আপনার গল্পটি দেখে বুঝলাম রহিমের বাবা খুবই গরীব ছিল তাদের মোটামুটিভাবে দিনগুলা চলে যেত।আসলে নদী ভাঙ্গনের গল্প এর আগেও শুনেছি। এটি খুবই মারাত্মক মানুষের জীবন এক নিমিষেই শেষ হয়ে যেতে পারে। শহরের পরিবেশ টা আসলেই অনেক আবর্জনা দুর্গন্ধ এবং প্রচুর মানুষের ভিড়। সত্যিই অনেক খারাপ লাগলো নদী ভাঙ্গনের ফলে রহিমের স্কুলটাও ডুবে গেল। সত্যি ভাইয়া আরো শোনার জন্য আগ্রহ হলো। আমরা অপেক্ষা করলাম দ্বিতীয় পর্বের জন্য।
ভাইয়া আজকে আপনার পোস্টটি পড়ে খুব খারাপ লাগছে। এই নদী ভাঙ্গনের ফলে প্রতিবছর হাজারো হাজারো মানুষ অসহায় হয়ে যায়, লক্ষ লক্ষ মানুষের জমি নদীগর্বে হারিয়ে যায়।কত শত শত মানুষের ঘর বাড়ি , স্কুল, ধ্বংস হয়ে যায় কত মানুষ পথের ভিকারি হয়ে যায়। এক নিমিষে মানুষের জীবন নষ্ট করে দেয়। সত্যি ভাইয়া পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। আমার এ রকম গল্প পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়। আবার পড়তে ও ইচ্ছা করে। পরবর্তী পর্ব পড়ার অপেক্ষায় রইলাম ভাইয়া।
দিদি আপনি যে আমার লেখা গল্প পড়েছেন এটা জেনে আমার খুবই ভালো লাগছে। বউদি পরবর্তী পর্ব লেখা হলে আপনাকে আমি জানিয়ে দেবো। অসংখ্য ধন্যবাদ বৌদি। আপনাদের জন্য সব সময় মঙ্গল কামনা করি।
ভাইয়া আপনি অনেক সুন্দর ভাবে গল্পটা লিখেছেন। আমি এই গল্প পড়ে অনেক কষ্ট পেলাম। কারন আমার একজন আপন মানুষ আজ ও এই কষ্ট ভোগ করছেন, তাদের জীবন ধারা অনেক কস্টের, আর সেটা আমার নিজের চোখে দেখা, তবে এই গল্প আমার মনের অনেক বড় একটা জাইগা নিয়ে বসেছে। পরের গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
বাহ ভাইয়া!
আপনি যে কতোটা ভালো গল্প লিখেন তার প্রকাশ করতে পারছিনা।সত্যি বলছি আমি আপনার গল্পের প্রতিটি লাইন খুব মন দিয়ে পরি।কয়েক বছর আগেও আমি টিভিতে এই দৃশ্য দেখেছিলাম।
ধন্যবাদ আপনাকে আপু।
চড় এলাকার জীবনযাত্রা এমনি ভয়ে ভয়ে ই কেটে থাকে ।কারন পদ্মানদীর ভাঙ্গন সব কুড়িয়ে নিয়ে যায় ।এতে রহিমে মত হাজারো পরিবার অসোহায় হয়ে যায় সব কিছু হারিয়ে ।এজন্য সরকারের উচিৎ শক্ত পোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া ।আপনার পরবর্তী পর্বের আশায় রইলাম ।ভালোই লেগেছে ভাই ।ধন্যবাদ আপনাকে এতো সুন্দর গল্প শেয়ার করারজন্য ।
ধন্যবাদ আপনাকে।
এটা শুনে দুঃখিত, আমি আশা করি এটি শীঘ্রই ঠিক করা যাবে @rupok
ভাইয়া খুবই সুন্দর একটি পোস্ট করেছেন কিন্তু আপনার এ পোস্টটি পড়ে সত্যি ভাইয়া আমার মন খুবই খারাপ হয়ে গেল। প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনের কারণে শত শত ঘর-বাড়ি, স্কুল-কলেজ ধ্বংস হয়ে যায়। হাজার হাজার জমি নদী সাগরের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সত্যি ভাইয়া কত যে মানুষ নিঃস্ব অসহায় পথের ভিখারী হয়ে যায়। ভাইয়া আপনার পরবর্তী পোস্টটি আমার পড়তে খুব ইচ্ছা করতেছে। অনেক অনেক শুভকামনা রইল ভাই আপনার জন্য।
ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।