পদ্মার চরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। ১০% সাই-ফক্স।
বেশ কিছুদিন থেকেই বন্ধু ফেরদৌস বলছিল চলো আমরা পদ্মার চর থেকে ঘুরে আসি। আমি শুরু থেকেই তার প্রস্তাবে রাজি ছিলাম। কিন্তু নানারকম ব্যস্ততার কারণে আর যাওয়া হচ্ছিল না। অবশ্য আমাদের সাথে আমাদের আরেক বন্ধু প্রদীপেরও যাওয়ার কথা ছিলো। আমরা চিন্তা করেছিলাম তিন বন্ধু মিলে ঘুরতে গেলে ভালই মজা হবে। এই মৌসুমে চরে ঘুরতে গেলে একটি অন্যরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা যায়। এটা পদ্মাপারের লোক ছাড়া খুব একটা ভালো বুঝতে পারবেনা।
এই ঋতুতে চর গুলো এক ভিন্ন রূপে ধরা দেবে আপনার চোখে। সেটা এক ধরনের বুনো সৌন্দর্য। হয়তো সাজানো গোছানো পরিপাটি কিছু নয়। কিন্তু দেখতে ভালো লাগবে। আমরা যারা শহরের ইট পাথরের দেয়ালে বন্দি থাকি। তাদের কাছে এটার এক অন্যরকম আবেদন আছে। এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাই সময় সুযোগ হলেই প্রকৃতির সান্নিধ্যে চলে যাই। যাইহোক বেশ কিছুদিন থেকেই পরিকল্পনা হচ্ছিল কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন হচ্ছিলো না।
শেষ পর্যন্ত কয়েকদিন আগে বন্ধুকে বললাম চলো আজ আমরা পদ্মার চরে ঘুরতে যাই। সেও রাজি হয়ে গেলো। সেদিন আকাশ ছিল কিছুটা মেঘলা। যার ফলে আমরা ভেবেছিলাম আজকের দিনটাই ঘোরাফেরা জন্য ভালো হবে। কারন সেখানে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। যার ফলে একটু ভালো আবহাওয়া থাকলে ভালো হয়। কিন্তু বের হওয়ার পর বুঝতে পারলাম আকাশে মেঘ দেখে ভুল ধারণা করেছি। বাইরে প্রচন্ড গরম। দরদর করে ঘামছিলাম দুজনেই। কিন্তু যেহেতু বাসা থেকে বের হয়েছি তাই আর ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আজকে আমাদের ভ্রমণ সম্পন্ন করে তারপরেই ফিরবো।
দুজনে সরাসরি চলে গেলাম ধলার মোড় নামক স্থানে। সেখান থেকে খেয়া পারাপারে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে পৌছে দেখি ঘাটে অনেকগুলি মোটরসাইকেল দাঁড়ানো। বুঝতে পারলাম চরে চলাচলের জন্য এখন এগুলিই প্রধান বাহন। অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ পর ঘোড়ার গাড়ি ও দেখতে পেয়েছি। যদিও সেগুলি মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়। যাই হোক আমরা সেখানে নেমে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক হাঁটতে শুরু করলাম। সোজা রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছিলাম আর রাস্তার দু'পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।
অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম অল্প কিছুদিনের ভিতর কিভাবে এখানে এতো জনবসতি গড়ে উঠলো। কিছুদূর আগানোর পর দেখতে পেলাম ভূমিহীন মানুষদের জন্য বানানো প্রকল্পের ঘর গুলি। এগুলি দেখে ভালই লাগলো। এইগুলি দেখলেই মনে হয় কিছু নিরাশ্রয় মানুষ তাদের একটা ঠিকানা খুঁজে পেঁয়েছে। যাইহোক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে চলছিলাম।
কিন্তু কিছু দূর হাঁটার পরে আমি বুঝতে পারলাম আমি আর বেশিদুর আগাতে পারবোনা। কারণ পায়ের ব্যাথাটা তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। তারপরেও কষ্ট করে হেঁটে আগাতে লাগলাম। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর একটি জায়গায় পৌঁছলাম। যেখানে আগে সবাই বাঁশের সাঁকো দিয়ে পার হতো। কিন্তু সেই সাঁকোটি এখন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তাছাড়া সাকোর নিচে এখন আর পানি নেই। যার ফলে সবাই পাশে একটি পায়ে হাঁটা পথ বানিয়ে নিয়েছে। সে দিক দিয়েই সবাই যাতায়াত করে। সেটা পায়ে হেঁটেই হোক অথবা মোটরসাইকেল নিয়ে হোক।
আমাদের সামনে দুটি মোটরসাইকেল যাচ্ছিলো। মোটরসাইকেল দু'টোতে তিনটি করে বস্তা পরিবহন করছিলো। আমাদের সামনেই একটি মোটরসাইকেল থেকে একটি বস্তা পড়ে গেলো। মোটরসাইকেল ওয়ালা আমাদের সাহায্য চাইলো। আমি আর বন্ধু ফেরদৌস দুজন মিলে বস্তাটি মোটরসাইকেলে উঠিয়ে দিলাম। তারপর মোটর সাইকেল ওয়ালা সেখান থেকে চলে গেলো। আমরা কিছু দূর আগানোর পর দেখি আবার সেই মোটরসাইকেল থেকে একটি বস্তা পড়ে গিয়েছে। আমরা তখন সেই মোটরসাইকেল ওয়ালাকে পরামর্শ দিলাম ভালোমতো বেঁধে নিতে তাহলে আর পড়বে না। সেই মোটরসাইকেল ওয়ালা একজন ঘোড়ার গাড়ির চালকের সাহায্য নিয়ে বস্তাটা তার মোটরসাইকেলে তুলে নিলো। তারপর সেখান থেকে চলে গেলো।
আমরা দুই বন্ধু গল্প করতে করতে সামনের দিকে আগাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে আমি অনুভব করলাম আমার কোমরে বেশ ব্যথা হচ্ছে। বুঝতে পারলাম আর আগাতে পারবো না। এই সমস্যাটা আমার অনেক আগে থেকেই হয়। দীর্ঘদিন হাঁটাচলা বন্ধ থাকলে তারপর একসাথে বেশিদূর হাটতে গেলে। তখন এমন কোমরে ব্যথা হয়। এর ভেতরে নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছে। এখন এখানে মসজিদ কোথায় খুঁজে পাই?
পরে স্থানীয় কিছু লোকজনের কাছ থেকে শুনে জানতে পারলাম অল্প একটু সামনেই একটা মসজিদ আছে। শুনে কষ্ট করে সেই মসজিদ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছালাম। কিন্তু সেখানে পর্যন্ত পৌঁছতে আমার কষ্ট হয়েছিলো। কোমরের ব্যথাটা বেশ বেড়েছিল ততক্ষণে। যাইহোক মসজিদে পৌঁছে বেশ কিছুক্ষণ ফ্যানের নিচে বসে রেস্ট নিলাম। তারপর সেখানে নামাজ আদায় করলাম। নামাজ পড়ার পর আমি বললাম এখন আর হাঁটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এখান থেকে মোটরসাইকেলে করে ঘাট পর্যন্ত ফিরতে হবে।
অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির ফলে কিছুটা ক্ষুধাও অনুভব করছিলাম। চিন্তা করছিলাম সেখান থেকে কিছু খাওয়া দরকার। কিন্তু তেমন কিছুই পেলাম না খাওয়ার মতো। মসজিদের সামনে একটি চায়ের দোকান ছিলো। সেখান থেকে দুজনে চা খেলাম। আমরা সামনেই বড় বিল্ডিং দেখতে পেয়ে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি? তারা জানালো এটা মাতৃমঙ্গল হাসপাতাল। এখানে মা ও শিশুদের সেবা দেয়া হয়। হাসপাতালটি দেখে খুবই ভালো লাগলো। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও যে মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা পৌঁছেছে এটা খুবই আশার কথা। সেখানে স্কুল-কলেজও দেখতে পেলাম।
এই চরের কথা চিন্তা করে অবাক লাগছিলো। মাত্র কয়েক বছর আগেও এখানটা জনমানব শূন্য ছিলো। অথচ মাত্র কয়েক বছরের ভেতরে চরে এখন বেশ বড় একটি জনবসতি গড়ে উঠেছে। অবশ্য এখন চরে যারা বসতি গড়েছে তারা সবাই এখানকার বাসিন্দা ছিলো। মনে পড়ে গেলো ১৯৯৭/৯৮ সালের দিকে ব্যাপক নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছিলো এখানকার মানুষেরা। যার ফলে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলো। সহায়-সম্বল হারিয়ে সকলের দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো।
আজ আবার ২০/২৫ বছর পর তাদের সেই হারানো চরে আবার তারা ফিরে এসেছে। নদী এই ভাঙ্গা গড়ার খেলাটি নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। মনে পড়ে তখন আমরা স্কুলে পড়তাম। একদিন শুনতে পেলাম পদ্মায় প্রচন্ড নদী ভাঙ্গন হচ্ছে। বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। তখন প্রায়ই স্কুল থেকে এখানে আসতাম দেখার জন্য। আজ আবার সেই হারিয়ে যাওয়া চর জেগে উঠেছে। সেখানকার পুরনো বাসিন্দারা একে একে সবাই ফিরে আসছে। ছোটবেলায় শুনেছিলাম নদীর ভাঙ্গা গড়ার খেলা নাকি দীর্ঘদিন পর পর হয়। কিন্তু মাত্র বিশ পঁচিশ বছরের ভেতর আবার সেটা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে এটা কখনো চিন্তা করিনি।
সবকিছু মিলিয়ে আজকে চরে ঘোরার অভিজ্ঞতাটা বেশ ভালো ছিলো। আমরা মোটরসাইকেলে করে অল্পক্ষণের ভেতরেই ঘাটে এসে পৌঁছলাম। কিন্তু আমরা ঘাটে আসলেও ওপার থেকে খেয়ানৌকা না আসা পর্যন্ত আমাদের ওপারে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। সেখানে আমরা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর যখন ইঞ্জিনচালিত নৌকা এসে উপস্থিত হলো। তখন আমরা ওপারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নদীতে প্রচন্ড স্রোত ছিলো। তাই এই নৌকাগুলোকে বেশ খানিকটা পথ ঘুরে আসতে হয়। অল্পক্ষণের ভেতরে আমরা ওপারে পৌঁছে গেলাম। তারপর দুজন দুজনের বাড়ির দিকে চলে গেলাম।
আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। পরবর্তীতে আপনাদের সাথে দেখা হবে অন্য কোন নতুন লেখা নিয়ে। সে পর্যন্ত সবাই ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন।
ফটোগ্রাফির জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র | হুয়াই নোভা 2i |
---|---|
ফটোগ্রাফার | @rupok |
স্থান | পদ্মার চর |
Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power
250 SP | 500 SP | 1000 SP | 2000 SP | 5000 SP |
ভাইয়া আপনার পদ্মার পাড় ভ্রমনের গল্পটা বেশ দারুন ছিল। জমিয়ে তুলেছিলেন, তবে যখন আপনার কোমর এবং পায়ের ব্যথা জানান দিচ্ছে তখন হয়তো আপনার ফিরে যাওয়া উচিত ছিল। তবুও অদম্য শক্তি নিয়ে বন্ধু ফেরদৌস ভাইকে নিয়ে চললেন সৌন্দর্য উপভোগের জন্য। তবে আপনার মুখের গল্পটা শুনে বুঝতে পারলাম আপনি পদ্মার পাড়ে এসে আপনার স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছুই মনে করতে পেরেছেন। এবং আমরা জানতে পেরেছি এই চর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল, আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগে। আবার সেই বিশ পঁচিশ বছর পরে পুনরায় আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে জেনে আমার কাছে একটু অবাকই লাগছে। এবং সেখানকার পুরনো বাসিন্দারা জনবসতি গড়ে তুলছে সত্যি বিষয়টা খুবই আনন্দের। আর এত সুন্দর করে আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য আপনার প্রতি রইল আন্তরিক অভিনন্দন।
এখনো কিছুটা শারীরিক সমস্যা থাকার দরুন ভালোমতো ঘোরাফেরা করতে পারছিনা। এজন্য যতদিন শরীর ভালো থাকে ততদিন চেষ্টা করবেন যতটা সম্ভব ঘোরাফেরা করতে।
ঠিক বলেছেন ভাইয়া এই সময় নদীর চরে গেলে আসলেই অন্যরকম সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায়। এখন চর গুলো আর আগের মত নেই এমন এক সময় ছিল নদীর চর গুলো শুধুই মরুভূমির মতো বালু আর বালু। কালের বিবর্তনে চরের মধ্যে এখন জনবসতি গড়ে উঠেছে কোথাও কোথাও আবার বাজারও দেখতে পাওয়া যায়। যাই হোক আপনি পদ্মার চরের অনেক সুন্দর সুন্দর কিছু ফটোগ্রাফি আমাদের মাঝে তুলে ধরেছেন দেখে খুব ভালো লাগলো। আর নদী ভাঙ্গনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লোক গুলো আবার চরে ফিরে তাদের বসতি গড়ে তুলতে পেরেছে এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে। পদ্মার চরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
লোক গুলো যে আবার নিজেদের পুরনো ঠিকানায় ফিরতে পেরেছে এটা দেখে আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে।
পদ্মার চরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটি বেশ দারুণ ছিলো। আসলেই নদীর চরে গেলে আসলেই অন্যরকম সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায়। অসম্ভব সুন্দর ফটোগ্রাফির মাধ্যমে আপনার সুন্দর অভিজ্ঞতাটি আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।
আমরা বন্ধুবান্ধবরা অনেক আগে থেকেই এই সমস্ত এলাকায় মাঝে মাঝে ঘুরতে আসি। তবে এবার ঘুরতে গিয়েছিলাম অনেকদিন পর।
এখন পর্যন্ত পদ্মার চরে কখনো যাওয়া হয়নি,, তবে আপনি যেভাবে উপস্থাপন করলেন আমার তো এখনো যেতে ইচ্ছা করছে। তবে একদিন অবশ্যই যাব এবং আপনাকে নিয়েই ঘুরবো,, ধন্যবাদ আপনাকে।।।
চলে আসেন যেকোনো সময়। তারপর দুজনে ঘুরতে বের হবো।
এইসব জায়গায় ঘুরতে আসলে খুব ভালো লাগে ভাই , কিন্তু কখনই সেই ভাগ্য হয়ে ওঠে না। আপনি আপনার বন্ধুদের সাথে খুব ভালো সময় কাটিয়েছেন তা আপনার পোস্ট পড়ে এবং ফটোগ্রাফি গুলো দেখেই বুঝতে পেরেছি। আর সেই সাথে আমাদের সাথে দারুন কিছু ফটোগ্রাফি শেয়ার করেছেন অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
এই সমস্ত জায়গাতে ঘুরতে আসলেই অনেক ভালো লাগে।
পদ্মার চরে ঘুরে আসার জন্য আপনারা তিন বন্ধু মিলে যে প্লান করেছেন সেই প্লান অনুযায়ী বের হলেন। কিন্তু বের হওয়ার সময় আপনারা আকাশ মেঘলা দেখে বের হয়েছিলেন যাতে ঘুরে মজা পাওয়া যায় কিন্তু বের হতেই গরম শুরু হয়ে গেল। এর পরবর্তীতে যখন আবার একটা স্থানে জনবসতিহীন ছিল সেই জায়গায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জনবসতি গড়ে উঠেছে বিষয়টি দেখে খুবই অবাক হয়েছেন আপনি। পরিশেষে চায়ের দোকান থেকে চা খেয়েছেন। সব মিলিয়ে দিনটি খুবই ভালো কাটিয়েছেন ।ধন্যবাদ আপনাকে।